Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ছোটদের জন্যে বড়দের লেখায় সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে ঊশ্রী মুখোপাধ্যায় (নব্বইয়ের গল্প - ৫)

maro news
ছোটদের জন্যে বড়দের লেখায় সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে ঊশ্রী মুখোপাধ্যায় (নব্বইয়ের গল্প - ৫)

রবীন্দ্র-নজরুল বা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা

--"হ্যালো হ‍্যালো মাইক টেস্টিন ওয়ান টু থিরি ফোর--- নমোসকার! পল্লীর অধিবাসীবৃন্দকে জানানো যাইতেছে যে আজ সন্ধে সাতটায়,(কি করছিস কেলো, সাত ঘটিকায় বল!)সরি, সাত ঘটিকায় এক সুন্দর সরনালী(স্বর্ণালী) সন্ধ্যায় সুস্থ সামোসকৃতিক অনুসঠানের আয়োজন করেছে নিউ বয়েজ ক্লাব। সকলকে সাদর আমন্ত্রণ"।( প্রচুর 'স' এর অনুপ্রাস এবং দোষ সমেত) বছর দশ পনেরো আগেও বৈশাখ জৈষ্ঠের বিকেলবেলা মাইকে এরকম ঘোষণা পাড়ার মোড়ে প্রায়শই শোনা যেত। তখনও পাড়ায় পাড়ায় এসময় হত রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যা। ব্যাপারটা অনেকটা এক ক্ষুরে দুজনের মাথা মুড়ানোর মত। জন্মদিন দুজনেরই কাছাকাছি তাই রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল ইসলাম দুজনেই কোন না কোন ক্লাবের বা দলের ফাংশনের থিম। কি ভাগ্য তখন 'অনুপ্রেরণা' ছিল না। সেসব ফাংশন হত দুরকম-- পাড়ার ক্লাবের বা কোনো দলের আর বিভিন্ন গান বা নাচের স্কুলের। বলা বাহুল‍্য প্রথমটার উৎকর্ষ দ্বিতীয়টির থেকে কম হলেও মজা ছিল অনেক বেশি।সেজন্যই দ্বিতীয়টির প্রসঙ্গে এযাত্রা যাচ্ছি না, প্রথমটি একাই একশো। আমরা, বালখিল‍্যরা ছিলাম দর্শক, ফলে চেনা পৃথিবী এক সন্ধের জন্য স্বপ্নের দেশ হলে ভালোই লাগত। ব্যাপারটা হত এরকম। মাইকে ঐ 'স' এর অনুপ্রাসযুক্ত ঘোষণার পরেই সাজো সাজো রব। তার আগেই তক্তা দিয়ে স্টেজ বাঁধা হয়ে গেছে, তাতে বিয়েবাড়ির ম্যারাপের কাপড়, মাঝে একটু কালো বা সাদা। অবশ্যই অবস্হাভেদে তারতম্য থাকত, যেমন চণ্ডীমণ্ডপ বা কমিউনিটি হল, আবার কারো বাড়ির উঠান বা হলঘর‌ও। তবে ক্লাবের ফাংশন হলে তক্তার স্টেজ‌ই হত। সে মঞ্চ যাই হোক মঞ্চের মাঝখানে অবধারিত থাকত রবীন্দ্রনাথের দাড়িশোভিত এবং নজরুলের বাবরি শোভিত দুখানি মালাপরানো ছবি। অথবা সেক্রেটারী বা প্রেসিডেন্টের একটা মাল‍্যদান পর্ব থাকত‌ই। তাঁরা নিজেরাও পরতেন(কে মালা পরাবে তাই নিয়ে পাড়ার বাচ্চাদের জোর রেষারেষি চলত, কারণ অনেকসময়ই মালাটা পরানেওয়ালার‌ই দখলে যেত), রবি ঠাকুর নজরুল ইসলামকেও পরাতেন। ও হ্যাঁ, মাল‍্যদানের আগে হত উদ্বোধনী সঙ্গীত, কুমারী বুল্টি বা কুমারী টুম্পা জাতীয় কেউ একজন লালপাড় সাদা শাড়ির সঙ্গে লাল ফিতে বেঁধে হারমোনিয়াম বাগিয়ে ধরে তারস্বরে গাইত, "সবারে করি আহ্বান, আ আ আ আআ আআ", সঙ্গে সঙ্গতে রঙিন পাঞ্জাবির ওপর পাউডারে সাদা ঘাড় গলার তবলচি। বেশ অ্যালার্ম এর মত এফেক্ট হত, পাড়ার লোক ফাংশন দেখতে হাজির হয়ে পড়ত। অবশ্য আমাদের মত সাততাড়াতাড়ি চেয়ার দখল করা বালখিল‍্যের দলের কথা আলাদা। উদ্বোধন সঙ্গীতের পর বক্তৃতা। সে এক বিরক্তিকর সময়, নাচ গান নেই, খালি বুড়োদের বকবক। আরে তখন কি আর জানতাম যে ক্লাবের ফা‌ংশনে চাঁদার পরিমাণ আর বক্তৃতার সময়ের সমানুপাত? ওসব জানতে আরো সময় লেগেছিল। তা থাকগে,তখন ওসব শুনে সময় নষ্ট না করে ঢু়ঁ মারতাম স্টেজের পেছনে, যাকে বলে গ্রীনরুমে। সে এক আশ্চর্য জায়গা, যেখানে কয়েকজন লোক, যাদের সবাই মেকাপম‍্যান আর ড্রেসারম‍্যান বলে তারা সব চেনা মানুষকেই বদলে দিচ্ছে। সকালবেলাই যে দিদির সঙ্গে মারপিট করে লজেন্স খেয়ে নিলাম, সন্ধেবেলা তাকেই আর চিনতে পারি না। বড়বড় করে চোখ এঁকে, গালে ঠোঁটে লালরং মাখিয়ে, চকচকে জামাকাপড় পরিয়ে, চুল বেঁধে কিরকম সাজিয়ে দিয়েছে! চারপাশে কত রকম শিশি, তুলি, রং, অভ্র!!এসব তো জীবনে দেখিনি। তার মধ্যে চোখ পিটপিট করার জন্য দুবার বকা খেল মেকআপ ম‍্যানের কাছে। কি মজা!এসব দেখে আর সেখান থেকে নড়ার নাম নেই, আর একে একে ছোটদের ভিড় বাড়ছেই। এমন সময় সাজ অসমাপ্ত রেখেই প্রায় তেড়ে এল বড় দিদিদের একজন," কি হচ্ছে এখানে? সবাই রেডি হচ্ছে সবাইকে পরে স্টেজে দেখবে, এখন যাও"। বকা খেয়ে আবার ব্যাক টু নিজের জায়গা। ততক্ষণে বক্তৃতা শেষ, আসল প্রোগ্রাম শুরু। আসল প্রোগ্রাম, মানে নৃত‍্যনাট‍্য বা নাটক। তখন এইসব ফাংশনে রবীন্দ্রনাথের নৃত‍্যনাট‍্য বা নজরুলের নৃত‍্যালেখ‍্য হত। শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা অভিনীত হত বেশিরভাগ সময়েই। চন্ডালিকা র মা যখন মন্ত্র পড়ত, ভূতপ্রেত ডাকত, জড়িয়ে ধরতাম পাশের বন্ধুকে। শ্যামায় কোটাল এসে উত্তীয়কে মেরে ফেললে ফোঁপাতে শুরু করতাম, চিত্রাঙ্গদা শেষ দৃশ্যে বেনারসি শাড়ি আর বৌভাতের ফুলের গয়না পড়ে "আমি চিত্রাঙ্গদা রাজেন্দ্রনন্দিনী" নাচলেও সেটা তখন বেমানান মনে হত না একটুও। আর মঞ্চে নিজের দিদিকে দেখতে পেলে আর ফুর্তি দেখে কে। দিদি দিদি বলে চিৎকার, বড়দের ধমক, গাল ফুলিয়ে বসে বাকি ফাংশন দেখা। ফাংশন এর শেষে হঠাৎ কাঁধে হাত, গ্রীণরুমের সেই রাগী দিদি। মাথার রঙিন পালকের সাজটা খুলে হাতে ধরিয়ে দিল, "খুব বকেছি না রে তখন"? ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে নিজের দিদিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতাম।(সেই গ্রীন রুমের 'রাগী দিদি' এখন আমার সহকর্মী, আর গল্পটা শুনে খুব হাসে) তারপর সব শেষ হলে অনেক রাত্রে বাড়ি। সেদিন ঝগড়া মারামারি কিচ্ছু না করে নিজের দিদিকে জড়িয়ে ধরে ঘুম, যদি রাতের বেলা অর্জুন, আনন্দ, চন্ডালিকার মা ওরম কিছু একটা হয়ে ও চলে যায়!! সময় পাল্টালো, একদিন নিজের দল‌ও হল। এতদিন দর্শকদের আসন থেকে দেখা ফাংশন একটা অন্য রূপে সামনে এল। আরো অপরূপ কিছু স্মৃতি জমিয়ে রাখার মাধ্যম হয়ে এল রিহার্সাল। রিহার্সাল এর সময়ের ঝগড়াঝাঁটি, খুনসুটি, হাসাহাসি, মজা আর খাওয়াদাওয়া মন ভালো করে দিত। গানের পাশাপাশি তৈরী হত প‍্যারডি, 'ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে' হয়ে যেত 'ওরে ভাই ছাগল ঢুকেছে বনে বনে'। পাশাপাশি আমাদের আনন্দ দিদিদের স্মৃতিচারণ এর কারণ হয়েও দাঁড়াতো। তাদের কাছে শুনেছি রিহার্সালের পর সবাই মিলে পাশের পুকুরে স্নান করার, স্টেজে সাজগোজ করা সুন্দরী মেয়েদের দেখতে গিয়ে পুরুষ ভূমিকার গায়কদের গান ভুলে যাওয়ার, বজ্রসেন সেজে দিদির আমার স্কুলে চলে আসার গল্প। ফাংশনের দিন সকালে ছিল সাফাই অভিযান। ঝাড়ু ডিপার্টমেন্ট, পোঁছা ডিপার্টমেন্ট, রীতিমতো পরিষ্কারের নামে ফাংশনের জায়গায় ফিল্ড মার্চিং চলত। আর সব শেষ হলে সবাই মিলে কচুরি, আলুরদম,ডিমের ঝোল, মিষ্টি--পংক্তিভোজ। আসলে সবথেকে বেশি আনন্দ ছিল সবাই মিলে কাজ করার, কিছু একটা গড়ে তোলার। এসব সময় থাকে না, প্রাত‍্যহিকতা,ব‍্যস্ততায় হারিয়ে যায়। তবে রেশটুকু থেকে যায় ঠিক। স্মৃতিতে, চিন্তায়, মনে। একরাশ ভালোলাগায়। সেদিনের রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যা না থাকলেও তার ছায়া থেকে যায় আজকের বিজয়া সম্মিলনীতে, ঘরোয়া জলসায়। সেই পাড়ার ছেলেদের যেমন খুশি অনুষ্ঠান এর বদলে আজকের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পেশাদারিত্ব অনেক বেশি, কিন্তু নিজস্বতা? কে জানে! ওটুকু মনেই থাক।যত্নে রাখব। সবাইকে শারদীয়ার অনেক শুভেচ্ছা।

চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register