Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ছোটদের জন্য বড়দের লেখায় সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে ঊশ্রী মুখোপাধ্যায় (নব্বইয়ের গল্প - ১২)

maro news
ছোটদের জন্য বড়দের লেখায় সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে ঊশ্রী মুখোপাধ্যায় (নব্বইয়ের গল্প - ১২)

মগজাস্ত্র বনাম অ্যাডভেঞ্চার

একটা ব‍্যাপার নিয়ে আমাদের প্রজন্ম, মানে নব্বইয়ের দশকে ছোটবেলা কাটানো ছেলেপুলেরা বেশ কলার তুলে রেলা নিতেই পারে। সেটা আর কিছু নয়, তাদের অনেকেরই জোরদার ব‌ইপোকা হ‌ওয়া। মাফ করবেন, কিন্তু আজকের ভিস‍্যুয়াল,ইন্টারনেট,সামাজিক মাধ্যম যতই উপযোগী হোক না কেন, ব‌ইএর বিকল্প সেগুলো নয়, হবেও না। আসলে আমাদের অনেকেই যে অসাধারণ ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করি তার অনেকটা জুড়েই ছিল এইসব শিশুসাহিত্য। বড়রা লিখতেন ছোটদের জন্য, সেইসব লেখার ছোটবড় চরিত্ররা হয়ে উঠত আমাদের বন্ধু। হয়তো সেজন্যই মানসিক অবসাদ কাটিয়ে উঠতে আজও সুবিধা হয়, ছুঁতে পারে না বন্ধুহীনতা। চোখের সামনের দৃশ্য ছেড়ে বন্ধ চোখের কল্পনা নিয়ে যেতে পারে আজও যেখানে খুশি, পেরিয়ে দেয় দেশকালের গন্ডি। এরকম একটা গল্প শুনেছিলাম দিদির মুখে। আমি তখন সবে জন্মেছি, মা আমায় নিয়ে মামার বাড়ি। বাড়িতে বাবা, জেঠু বড়মা কাকু ঠাম্মা সবাই থাকলেও মায়ের অভাবে কষ্ট পেত ছ বছরের দিদি। এরকম সময়েই বাবা একদিন অফিস ফেরত ওর হাতে তুলে দিয়েছিল 'তিব্বতে টিনটিন'( tintin in Tibet)। একটা কমবয়সী, প্রায় বাচ্চা ছেলে, এক বয়স্ক সঙ্গী আর সাদা কুকুর নিয়ে বরফের দুর্গম পথ ধরে তিব্বতে যাচ্ছে, ইয়েতির হাত থেকে বন্ধুকে বাঁচাবে বলে, একটা ছ'বছরের মেয়েকে মুগ্ধ করতে তা ছিল যথেষ্টর‌ও বেশি। দিদির আরো মুগ্ধতার কারণ ছিল টিনটিনের কমবয়স। এমনকি বহুদিন ওর এরকম ধারণাও ছিল, যে টিনটিন ওর‌ই বয়সী, বন্ধু। বড় হতে হতে টিনটিনের আরো কমিকস পড়েছে ও, পরে আমিও, ধারণা নিশ্চয়ই বদলেছে, কিন্তু বন্ধুত্ব আজ‌ও এক‌ইরকম। ঠিক এরকমই বন্ধুত্ব ছিল ক‍্যাবলা, প‍্যালা আর হাবুল সেনের সঙ্গে, যাদের গুল গল্প শুনিয়ে প্রায়শই ভালোমন্দ খেত 'পটলডাঙার টেনিদা'। জীবনে প্রথমবার চিড়িয়াখানায় বাঘের ডাক শুনে 'কুট্টিমামা' বলে চেঁচিয়ে ওঠা আমারও মনে পড়ে যেত টেনিদা আর তার সঙ্গীদের ডুয়ার্স অভিযান। প্রাইমারি থেকে সেকেন্ডারি স্কুলে ওঠার পর একটা নতুন পিরিয়ড যোগ হয়েছিল রুটিনে, লাইব্রেরি পিরিয়ড। মনে পড়ছে, প্রতি মঙ্গলবার হত ক্লাসটা, টিফিনের পরেই। টিফিন শুরু হতে না হতেই সবাই লাইন দিতাম লাইব্রেরির সামনের করিডোরে। উদ্দেশ্য সবথেকে পছন্দসই ব‌ই সব্বার‌ আগে বেছে নেওয়া। তাও একটা হুটোপাটি হত‌ই, হাতাহাতিও বাদ যেতনা। লাইব্রেরিয়ান দিদি ব‌ই টেবিলে রাখার আগেই চিলের দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ, যাতে ব‌ই টেবিলে পড়া মাত্রই ছোঁ মেরে তুলে নেওয়া যায়। অনেকসময় বন্ধুদের সঙ্গেও বন্দোবস্ত করা থাকত কে কোন সপ্তাহে কোন ব‌ই নেবে। অদ্ভুতভাবে চাহিদা থাকত হাসির গল্প, ভূতের গল্প বা রহস্য গল্পের। এভাবেই অজান্তে আমরা জানতে পারছিলাম বাংলা শিশুসাহিত‍্যের দিকপাল লেখকদের কথা। অজান্তেই কারণ চরিত্ররা ছিল বেশি পরিচিত, স্রষ্টা ততটা নয়। এভাবেই পরিচিত আর প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন, মানিক-জয়ন্ত, ঘনাদা, বিমল কুমার, ফেলুদা। অবশ্য শেষ দুজনের ব‍্যাপার ছিল একটু আলাদা, যখের ধন আর সোনার কেল্লা তো আগেই টিভিতে দেখা হয়ে গিয়েছিল! কিছুটা বলিউডি ধাঁচ থাকলেও কম প্রিয় ছিল না পান্ডব গোয়েন্দারা। আর একদিকে তাঁর অদ্ভুতুড়ে চরিত্রদের নিয়ে ঝলমল করতেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, যেখানে চোর ডাকাত‌ও হত ভালোমানুষ, পরীক্ষায় অঙ্কে তেরো পেলেও যাওয়া যেত অ্যাডভেঞ্চারে, বন্ধু হত ভালো ভূতের দল, গোয়েন্দা বরদাচরণ গরুর গুঁতো খেয়ে ভির্মি খেতেন। পাশাপাশি দেব সাহিত্য কুটিরের অনুবাদ পড়ে পরিচিত হয়েছিলাম মার্ক টোয়েন, চার্লস ডিকেন্স, রবার্ট লুই স্টিভেনশন, আর্থার কনান ডয়েল এর মত সাহিত্যিক দের সঙ্গেও। আর দেশ কাল অবস্হার ফারাক থাকলেও টেনিদার মত টম স‌ইয়ার‌ও হয়ে যেত কাছের মানুষ, অপুর মত‌ই মন খারাপ হয়ে যেত অলিভার টুইস্ট এর দুঃখে। এছাড়াও কুমায়ুন রুদ্রপ্রয়াগের জঙ্গলে মানুষখেকো বাঘ বা চিতার পেছনে জিম করবেট, বা কেনেথ অ্যান্ডারসনের সঙ্গে বন্দুক হাতে ঘুরতাম আমরাও, মনে মনে। এভাবেই নিজেদের সীমিত জীবনেও তৈরি হয়েছিল এক সব পেয়েছির জগৎ। তবে অ্যাডভেঞ্চার ভালো না বুদ্ধি খাটিয়ে রহস‍্যভেদ, তাই নিয়ে তখন তর্ক‌ও হত বেশ। তবে সে অনেকটা সচিন ভালো না সৌরভ, সেরকম। আসলে দুই ধরনের লেখার প্রতিই ছিল যথেষ্ট ভালো লাগা, তর্ক হত অনেকটাই খেলার ছলে। আরো বড় হয়ে রস পেয়েছি শরদিন্দু র লেখায়, শুধু ব্যোমকেশ না, ঐতিহাসিক রচনাতেও। আমার বা আমার মত অনেকেরই কৈশোর এদের কাছে ঋণী।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register