- 3
- 0
জন্মদিনের সন্ধ্যেটা হইহুল্লোড় করে কেটে যায়। বাচ্ছাদের চেঁচামেচির চোটে আর তাদের মায়েদের সাথে গল্পগুজব করে পিয়ালীর মাথা থেকে দুপুরের ঘটনা টা বেরিয়ে যায়। কিন্তু সবাই চলে যেতেই আবার কেমন একটা ভয় ঘিরে ধরে তাকে। প্রত্যেক টা মুহূর্ত ঋক কে চোখে চোখে রাখতে হয় তাকে। বন্ধ ফ্রিজের ভিতর থেকে মাঝেমধ্যেই ধুপধাপ শব্দ হয় যেন অথচ খুললেই সব যেমন ছিল তেমন। রৌনক কে কিছু বলা বৃথা, সে কোনোভাবেই এসব মানতে চায় না। আর এইকদিনের মধ্যেই আবার ফ্ল্যাট বদল করে অন্য কোথাও যাওয়া যে কোনোমতেই সম্ভব না তা পিয়ালী জানে খুব ভালো করে। একদিন মাঝরাতে পিয়ালীর ঘুম ভেঙে যায় ঋক এর স্পর্শ না পেয়ে। ঋক তার মা কে জড়িয়ে ধরে ঘুমোয়, পিয়ালী ঘুমের মধ্যেও অনুভব করতে পারে ঋক ঠিকঠাক ঘুমোচ্ছে কিনা। কিন্তু সেদিন হাত বাড়িয়ে দেখে বুঝলো বিছানায় ঋকের জায়গাটা খালি। ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ে পিয়ালী, কু গাইতে থাকে তার মন। রৌনক কে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে দুজনে মিলে খুঁজতে থাকে গোটা ফ্ল্যাটের সব ঘর, বাথরুম, কিচেন। কিচেন থেকে বেরোতে গিয়ে পিয়ালীর চোখ যায় দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্রিজটার দিকে। এক অজানা ভয় গ্রাস করে পিয়ালী কে। ছুটে কাছে গিয়ে দেখে যা ভেবেছিল ঠিক তাই। ফ্রিজের পাশে দেওয়ালের ধার দিয়ে সার করে রাখা রয়েছে সমস্ত জিনিস যা ফ্রিজের ভিতরে ছিল। ভিতরের ট্রেগুলোকে সুন্দর করে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো রয়েছে। ফ্রিজের দরজা টা খুলতেই দেখা যায় ঋক কে, হাঁটু মুড়ে দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে বসে রয়েছে। ' ঋইইইক' বলে চেঁচিয়ে ওকে ছুঁতেই চমকে ওঠে পিয়ালী, বরফের মত ঠান্ডা ঋকের গা। রৌনক কোলে করে বের করে এনে বিছানায় শুইয়ে মোটা চাদর দিয়ে ঢাকা দিয়ে দেয় ওকে। - কি হবে আমার ছেলেটার ? কতক্ষন ওর ভিতরে ওভাবে ছিল কে জানে! গা টা এতো ঠান্ডা কেন! ওর কিছু হয়ে গেলে আমি কিন্তু.. - আঃ চুপ করো না। কিচ্ছু হবেনা। আমি ডাক্তার ডেকে আনছি। অত ঠান্ডায় বসে থাকলে গা তো ঠান্ডা হবেই, ঠিক হয়ে যাবে দেখো। এই বলে রৌনক বেরিয়ে যায় ডাক্তারের খোঁজে। ঋক অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকে, গা তার বরফের মত ঠান্ডা, পিয়ালী চোখের জল ফেলতে ফেলতে সেবা করে যায় সারারাত, পায়ে বুকে পিঠে গরম তেল মালিশ করে দেয়, যদি ছেলেটার গা টা একটু গরম হয়, যদি জ্ঞান ফেরে! সারারাত হন্যে হয়ে খুঁজে ভোরের দিকে এক ডাক্তারবাবু কে আনতে সক্ষম হয় রৌনক। সব শুনে ডাক্তার ও অবাক হলেন। কার্তিক মাসের শুরুতে অত গরম ও নেই যে অতটুকু ছেলে ঘুমের মধ্যে উঠে গিয়ে সব নামিয়ে ফ্রিজে ঢুকে বসে থাকবে, তাছাড়া ঠান্ডা লাগল তো নিজে থেকেই বেরিয়ে আসতো, তাহলে ওর ভিতর জ্ঞান হারালো কি করে! কোনো কিছুর সদুত্তর পাওয়া গেলো না, কেই বা দেবে উত্তর? যে উত্তর দিতে পারতো সে তো চোখ ই খুলছে না। - এই ওষুধ দুটো খাইয়ে দেখুন, জোর করে মুখ টা হা করিয়ে ঢুকিয়ে দেবেন। বারো ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে হসপিটালে নিয়ে যাবেন, আর বেশি দেরি করবেন না। মনে একরাশ প্রশ্ন থাকলেও প্রেসক্রিপশনে দুটো ওষুধের নাম লিখে দিয়ে চলে যান ডাক্তার। সারাদিন সব কাজ ভুলে বসে থাকে পিয়ালী ঋকের পাশে। সেই রাত থেকে টানা জেগে বসে থাকায় বেলার দিকে চোখ দুটো লেগে আসে পিয়ালীর। কখন হালকা ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল পিয়ালী নিজেও জানে না, হঠাৎ শুনতে পেল তার খুব কাছে কেউ যেন বলছে - মম্মি, মম্মি... এটাতো ঋকের গলা, এক ঝটকায় পিয়ালীর তন্দ্রা কেটে যায়, সে তাকিয়ে দেখে ঋক তার দিকেই তাকিয়ে আছে, ঠোঁটে একটা বাকা হাসি আর কেমন একটা ঘোলাটে চোখ করে। তবে এসব পিয়ালীর নজরে পড়ে না। সে তখন জড়িয়ে ধরেছে ছোট্ট ঋক কে। ঋক ও পিয়ালীর গলা জড়িয়ে ধরে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পিয়ালী বলে, - তুই ঠিক হয়ে গেছিস সোনা.. দাঁড়া আমি এক্ষুনি তোর বাবাকে ডেকে আনি।
ড্রয়িং রুমের চেয়ারে এতক্ষন বসেছিল রৌনক। তার আর আজ অফিস যাওয়া হয়নি। ছেলের জ্ঞান না ফিরলে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে , পিয়ালীর একার পক্ষে সম্ভব নয়, এইতো কদিন হল এখানে এসেছে, এখনও কিছুই চেনেনা এখানকার। ওই কদিন পিয়ালী বারবার বলছিল, ফ্রিজটায় কিছু একটা অসুবিধে তো আছে আর ঋক বারবার ফ্রিজে ঢোকার চেষ্টা করে, কিন্তু রৌনক সে সব কথা তুচ্ছ বলে এড়িয়ে যায়। কিন্তু আজ যা হল তাতে তো বিষয়টা আর অত সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সত্যি কি তবে পুরনো জিনিস এনে ভুল করলো সে? হয়ত তার পিয়ালীর কথা শোনা উচিত ছিল, নতুন জিনিস কেনাই ঠিক ছিল। কিন্তু এমন কি হতে পারে? ফ্রিজটা তো জড়বস্তু, তার ভিতর তো প্রাণ নেই যে সে লোকের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে! হতে পারে পুরোটাই কাকতালীয়, এর সঙ্গে ফ্রিজের নতুন পুরনো হওয়ার কোনো কারণ নেই। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই পিয়ালীর ডাক শুনতে পায় রৌনক। - শুনছো ঋকের জ্ঞান ফিরেছে। কি বলছ? সত্যি? স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রৌনক। - হ্যাঁ এইতো আমায় জড়িয়ে ধরে ছিল মাম বলে। দেখবে চলো। কথাটা বলে থেমে যায় পিয়ালী, ঋক তো তাকে মাম বলে কিন্তু এখন অন্য কি একটা বলে ডাকলো না? সাথে সাথেই দৌড়ে আবার ঘরে যায় পিয়ালী, পিছন পিছন রৌনক ও, তবে এসে দেখে ঋক আগের মতোই অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। সারা শরীর অস্বাভাবিক ঠান্ডা, যেন বরফের তৈরি, জ্ঞান ফেরার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। ঋক ঋক বলে ডেকেও আর কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। - কোথায় পিয়ালী? ওর তো জ্ঞান ফেরেনি। - বিশ্বাস করো। ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তাহলে কি আবার জ্ঞান হারালো! - আমার মনে হয় আর দেরি না করে আমরা ওকে হসপিটালে নিয়েই যাই। এভাবে ফেলে রাখা ঠিক হচ্ছে না।
0 Comments.