Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব - ৬)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব - ৬)

বিন্দু ডট কম

একটা আলতো আলোর আভা স্পর্শ করছিল তরুলতার ঠোঁটদুটিকে।তরুলতা দেখল সে তার ঘরের বিছানায় শুয়ে।খানিকটা সে পিছনে ফিরে যাবার চেষ্টা করছিল।মরামের রাস্তা-অখিলেশবাবু-প্রজাপতি।তারপর?তারপর অন্ধকার। তারপর?তারপর এই যে!আলোর আভা!কিন্তু মাঝের সময়টুকু? ধড়মড় করে উঠে পড়ে সে।তার পরণে গতকালের হলুদ নীল জামদানি শাড়ি।কিন্তু সদর দরজায় তো সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল।তাকে এখানে এনে দিল কে?ঘড়ি দেখলো তরুলতা।সকাল আটটা দশ!আজ তো ব্যাঙ্কে অডিট!কী হবে?ভাবতে ভাবতেই ড্রয়িং রুমে গিয়ে চমকে গেল সে।সোফায় তার দিকে পিঠ করে ফোনে কথা বলছেন অখিলেশবাবু।বসবার ঘরের কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই সে দেখতে পেল তার বাড়ির সামনেই অখিলেশবাবুর গাড়ি পার্ক করা।তবে কি গতকাল অখিলেশবাবু বাড়ি ফেরেননি!!তরুলতার উপস্থিতির কথা বুঝতে পেরেই অখিলেশবাবু 'আই উইল হ্যাং অন নাউ।উইল কর ইউ লেটার' বলে ফোন কেঠে দিলেন অখিলেশবাবু।তার চোখের দিকে চেয়ে কী বলা উচিত বুঝতে পারছিল না তরুলতা।কী বলা উচিত তার এখন?কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত?না দুঃখপ্রকাশ করা উচিত।অবশ্য অখিলেশবাবু তার মনের দোলাচল কাটিয়ে দিলেন সহজেই। -এখন শরীর কেমন? -এখন ঠিক আছি।সত্যিই কাল যে কীই হলো? -ও কিছু না।এখানকার হাসপাতালে আমার একজন চেনাজানা ডাক্তার আছে।ওনাকে বললাম।বলল রক্তাল্পতা থেকে এইরকম সিনকোপ হতেই পারে।খান না তো কিছুই। তরুলতা একটু বিব্রত হয়।রক্তাল্পতার নিজস্ব মেয়েলি কারণ আছে তার।শুধুই খাওয়ার অভাব নয়।গেল তিনদিন তলপেটে অসহ্য ব্যথা।রক্তের বেগ ন্যাপকিনের বন্ধন মানছে না কিছুতেই। -কয়েকটি আয়রন ক্যাপসুল এনে রেখেছি সকালে।রোজ একটা করে খেতে হবে। -আপনাকে চা করে দিই? -নাহ।আমি টি ড্রিঙ্কার নই।আমাকে বেরোতে হবে।আজ তো অডিট। -আমিও তৈরি হয়ে নিচ্ছি।তরুলতা হঠাৎ বাস্তবে ফিরে আসে।অফিসে গতকাল সব কাজ শেষ করে আসতে পারেনি সে। -নো।তোমার আজ ছুটি। -অনেকগুলো ফাইল আনফিনিশড আছে স্যার। -লীভ দেম টু মি।আমি সামলে নেব।তুমি আজ ছুটি নেবে।আমি সকলকে বলে দিয়েছি।কাল ফোর্থ স্যাটারডে।এমনিই ছুটি।রেস্ট নাও।সোমবার জয়েন করবে। তরুলতার কোনও আপত্তি মানলেন না অখিলেশবাবু।দরজা খুলতে গিয়ে হঠাৎ নিজেরই অজান্তে তরুলতার হাত চলে গেল অখিলেশবাবুর ব্লেজারের দিকে।গতকাল প্রজাপতি ধরবার সময় ব্লেজারের কাঁধের পিছন দিকে মাটি লেগে গেছে।সেটা ঝেড়ে দিল সে।অখিলেশবাবু মিষ্টি হেসে বললেন, 'থ্যাঙ্কু। সাবধানে থেকো।টেক রেস্ট।আমি পারলে সন্ধ্যায় একবার খোঁজ নিয়ে যাবো।'
বাড়ির সামনে থেকে ডানা মেলে অখিলেশবাবুর সাদা গাড়ি উড়ে চলে যায়।তরুলতার কেমন যেন একা লাগে এইবার।শুভব্রতর কোনও মিসড কল নেই সারাদিন।আচ্ছা।গতকাল যদি ওই অপরিচিত লোকটা না থাকতো,তাহলে কী হতো তার?পড়ে থাকতো রাস্তায়?সারারাত?কী এমন রাজ্যোদ্ধার করছে শুভব্রত!সোফায় গা এলিয়ে শুভব্রতকে পরপর রিং করতে তৃতীয় বার তার ফোনে ফোন লাগলো।ওপার থেকে শুভব্রতর কন্ঠস্বর কোনও অপরিচিতের কন্ঠস্বর মনে হলো তার।স্বর শুনতেই বাঁধভাঙা জলের মতো ধেয়ে এল অভিমানের জলরাশি। -গতকাল সারাদিন ফোন করলে না কেন আমাকে? -একদম সময় পাইনি গো।জানো?আমার পত্রিকাটা বোধহয় আর প্রেস ছাপবে না... -টু হেল উইথ ইয়োর পত্রিকা। তরুলতার এই হঠাৎ আক্রোশের কারণ খুঁজে পায় না শুভব্রত।তরুলতা বলে চলে। -তোমার বউ মরলো না বাঁচলো,খবর রাখো তুমি?আমাকে নিজের বউ বলে পরিচয় দাও কী করে... বলেই ফোন কেটে দিল সে।পেটের নীচ দিকে মোচড় দিচ্ছে আবার।বাথরুমে যেতে হবে।একতাল রক্তের ডেলা বেরিয়ে গেল অনায়াসে।মুখচোখে জল দিয়ে ফিরে এসে সে আবিষ্কার করলো পড়ার টেবিলে তাড়াহুড়োতে নিজের প্রজাপতির খাতা ফেলে গেছেন অখিলেশবাবু।খাতাটা দেখে শুভব্রতর ওপর জমে ওঠা রাগ মুহূর্তে মিলিয়ে গেল তার।মজার মানুষ এই অখিলেশবাবু।ব্যাঙ্কে অমন দাম্ভিক রগচটা।অথচ এখানে কেমন মিষ্টি ছেলেমানুষ।প্রতি পাতায় অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় প্রজাপতিদের সংরক্ষণ করা।নীচে নিজস্ব টীকা।কারো নাম চাঁদনরি,কারো নাম তিতিয়া।এই তিতিয়া নামটি ভারী পছন্দ হয়ে গেল তার।সমিগ্ধকে নিয়ে কতো সন্দেহ শুভব্রতর।অথচ ছেলেটাকে সেভাবে চেনেই না সে।দু একবার মাত্র আলাপ।কিন্তু অখিলেশবাবুর প্রজাপতিখাতা দেখতে দেখতে তার মনে হলো শুভব্রতর সন্দেহ অমূলক হয়তো নয়।তার মধ্যেও যেন কেমন একটা গুটিবন্ধন ভেদ করবার ইচ্ছে জেগে উঠছে।বেলা বাড়ছে।রান্না করতে হবে।ফ্রিজে একটু চিকেন আনা আছে।জমিয়ে মাংস রান্না করলে কেমন হয়?তারপর চান করবে সে।অনেকদিন পর প্রাণভরে।জল উষ্ণ করে বিন্দু বিন্দু জল তার শরীর বেয়ে নেমে আসবে নীচে।নাহ।আর দুর্বলতা নেই।জড়তা নেই।যেন সমস্ত ক্লান্তি শুষে নিচ্ছে ওই প্রজাপতির খাতাটি।দুপুর গড়িয়ে কখন বিকেল হয়ে গেল।কিসের জন্য অপেক্ষা করছে তরুলতা?সূর্য ডুবে গেল পশ্চিমে।এই পশ্চিম দিকে একটা বড় শিড়িষগাছ তরুলতার সানসেট আড়াল করে দেয়।কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো আজ তো আর সে ব্যাঙ্কে নেই।অন্ধকার নামতে নামতেই তরুলতা দেখলো তার শরীরে জেগে উঠছে প্রজাপতির স্পন্দন।অপেক্ষা অপেক্ষা অপেক্ষা। বসবার ঘরে আলতো টিভি চালিয়ে ভিতরের অজানা উত্তেজনাকে প্রশমিত করতে চায় সে।স্ক্রিনে ফুটে ওঠে রান্নাঘরের ছবি।তারপর আলো ছায়া।তারপর সদর দরজায় জোছনা এসে পড়ে।অখিলেশবাবুর গাড়ি ঢুকছে তার কম্পাউন্ডে।দরজার দিকে হাত বাড়াবার আগেই ছিটকিনি খুলে দেয় তরুলতা।অখিলেশবাবু ঢুকতেই তার জন্য মিষ্টি জল এনে দেয় সে।তারপর তার দিকে এগিয়ে দেয় প্রজাপতির খাতাটা।অখিলেশবাবু খানিকটা থমকে সেই খাতাটা হাতে তুলে নেয় ছেলেমানুষের মতো। দেখে হাসি পেয়ে যায় তরুলতার।সেই হাসি স্পর্শ করে অখিলেশের পৌরুষকে। -হাসলেন যে? -অত্তো বড় ব্যাঙ্কের অত্তো গম্ভীর একজন মানুষের বুকের ভিতর যে এমন এক ছোট্ট লেপিডপটেরিস্ট লুকিয়ে ছিল কে জানতো?
তরুলতার বিস্ময়ের প্রত্যুত্তরে অবাক চাহনিতে তাকিয়ে থাকে অখিলেশ।তার সামনে এক জোড়া চাঁদনরি ডানা মেলে এখুনি পরাগ সঞ্চয় করতে বসেছে যেন এক প্রজাপতি। -আমার বুকের মধ্যে আর কী কী আছে বলো দেখি? কী হয় তরুলতার!সে কি এক ঝটকায় খুলে ফেলবে অখিলেশের জামার বোতামগুলো?এ কি ভাবছে সে?সে তো বিবাহিত!তবে কি সে পাগলিনী হয়ে উঠলো?মনে মনে এতো সব ভাবলেও মুখে কিছুই বলল না তরুলতা।চুপ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।অখিলেশ এবার তার দুই কাঁধ ধরে বসিয়ে দিল সোফায়।আর তখনই দেখলো তার দুই চোখে জল।সেই জল জলপ্রপাতের মতো ভাসিয়ে দিচ্ছে দুই কূল।যেন আগ্নেয় জল।সেই জল স্পর্শ করার অধিকার তার আছে কি? মুখ ঢেকে খানিক চুপ থেকে এবার তরুলতা অখিলেশের দিকে সজল চোখে তাকায়।সেই চাহনিতে দুঃখ নেই,ক্রোধ নেই,আছে শুধুই অসহায়তা। -পারবে অখিলেশ?পারবে তুমি?আমার এই চোখের জল মুছে দিতে? -পারবো।তুমি অনুমতি দিলে। -দিলাম। -তবে চলো। -কোথায়? -আজ সারাদিন শুধু হিসেব নিকেশ করে গেছি।কাল বেহিসেবি হই চলো।দুইজনে যাই চলো লোদাশুলির জঙ্গল।যাবে? তিরতির করে কাঁপছে তরুলতা।তার কথা বলবার শক্তি নেই।শুধু মাথা নাড়িয়ে সে জানান দেয়। সে যাবে যাবে যাবে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register