- 3
- 0
পৌষ সংক্রান্তির পিঠা খাওয়া নিয়ে বেগম সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন, “পৌষ মাসের পিঠা খেতে বসে, খুশিতে বিষম খেয়ে আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে, মায়ের বকুনি পেয়ে।”
বাঙলার মায়েরা কত রকম পিঠা বানাতেন! তার কাছে কেক-পেস্ট্রি, পিজ্জা-পাস্তা, ধোসা, ধোকলা দ্শ বিশ গোল খায় আজও। ভাপা পিঠা, পাটিসাপটা, পাকন পিঠা, পুলি পিঠা, মিঠা পিঠা, চিতই পিঠা, পাতা পিঠা, ঝাল পিঠা, নারকেল পিঠা নাম শুনলেই জিভে জল গড়ায়। কোনও কোনও মা ছিলেন নিপুন শিল্পী। তাঁরা বানাতেন নকশা পিঠা, ঝিনুক পিঠা, জামদানি পিঠা, সূর্যমুখী পিঠা, গোলাপ পিঠা ইত্যাদি। এছাড়া ক্ষীরপুলি, নারকেলপুলি, আনারকলি, দুধসাগর, দুধপুলি, রসপুলি, দুধরাজ সন্দেশ, আন্দশা, মালপোয়া, পাজোয়া নামধারী মিষ্টির কথা কি ভোলা যায়? তা হলে আজও আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াবাসী বাঙালিরা এই দিনে পিঠা উৎসব করে কেন! ঝাড়খণ্ডে সিংভূম ও ধলভূম পরগণার পাশাপাশি বাঙলার বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায়; ঝাড়গ্রামে ও আসানসোলের আদিবাসী ও নিম্নবর্ণের সমাজে পালিত হয় টুসু উৎসব। টুসু লৌকিক দেবী। মেয়েদের উৎসব। লক্ষণ ভাণ্ডারী লিখেছেন “দলে দলে কুমারীরা গায় টুসু গান”। তার কবিতায় আছে – মকরসংক্রান্তি আজি কর পূণ্যস্নান, অজয় নদীতে আজি টুসুর ভাসান। ভোর হলে সকলেই টুসু নিয়ে আসে, ফুলমালা নিয়ে টুসু নদী জলে ভাসে।
টুসু গানের মূল উপজীব্য লৌকিক ও দেহজ প্রেম। গানে কল্পনা, দুঃখ, আনন্দ, মেয়েলি দ্বন্দ্ব, ঈর্ষা, অভীপ্সা, বিদ্বেষের পাশাপাশি সামাজিক অভিজ্ঞতা ও সমকালীন রাজনীতি ছাপ পড়ে। বাঙলাকে বিহারের সঙ্গে সংযুক্তির বিরুদ্ধে পুরুলিয়াকে বাঙলার মধ্যে রাখার জন্য বিরাট আন্দোলনে টুসু সত্যাগ্রহ হয়েছিল। টুসু পরবে পুজোর পর মেয়েরা টুসুর দোলা নদীতে বা জলাশয়ে ভাসান দেয়। ‘টুসু’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে তুষ থেকে। তুষ মৃত ধানের দেহ। সেই মৃতদেহকে ভাসান দিয়ে নতুন ফসলের আবাহনই টুসুর মূল বার্তা।
আরেকটি প্রাচীন কবিতা পড়ে নিই। ‘পৌষ পার্বণ” কবিতায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছেন,
“ঘোর জাঁক বাজে শাঁক যত সব রামা।
কুটিছে তণ্ডুল সুখে করি ধামা ধামা।।
বাউনি আউনি ঝড়া পোড়া আখ্যা আর।
মেয়েদের নব শাস্ত্র অশেষ প্রকার।।
উনুনে ছাউনি করি বাউনি বাঁধিয়া।
চাউনি কর্ত্তার পানে কাঁদুনি কাঁদিয়া।।
'চেয়ে দেখ সংসারেতে কতগুলি ছেলে
কহ দেখি কি হইবে নয় রেক চেলে?
ক্ষুদকুঁড়া গুঁড়া করি কুটিলাম ঢেঁকি।
কেমনে চালাই সব তুমি হলে ঢেঁকি।।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতার এই আউনি বাউনি হল পৌষ পার্বনের আরেক লৌকিক উৎসব। এর আগের নাম ‘আগলওয়া’। এই উতসবের কথা আছে গবেষক তারাপদ মাইতির ‘আউনি বাউনি’ এবং ড. দুলাল চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ’ গ্রন্থে। আউনি বাউনি শস্যের উৎসব। অগ্রহায়ন মাস ছিল হিম ঋতুর প্রথম মাস। হেমন্তের পাকা আমন ধান ছিল বছরের প্রথম পাকা ফসল। আমনের কাহন কাহন ধান ঘরে উঠলে পর কৃষকের মনে আনন্দের হাসি ছড়াতো। বছরের প্রথম ফসলকে অতিপবিত্র ও সৌভাগ্যদায়ক মনে করে কৃষকরমনী তিনছড়া করে ধানের শিসের সঙ্গে মুলোর ফুল, সরষে ফুল, আমপাতার বিনুনি তৈরি করতেন। তারই নাম ‘আউনি বাউনি’। এই আউনি বাউনি বাঁধা হতো ধানের গোলায়, ঢেঁকিতে, বাক্সপেটরায়, আলমারীতে, ট্রাঙ্ক বা তোরঙ্গে আর চালের জালায়। ঘরের ও গোয়াল ঘরের খড়ের চালায় গুঁজে দেওয়া হয় আউনি বাউনি। নজর রাখা হতো, সারা বছর যেন সেটি সেখানে সমর্যাদায় থাকে। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। হারায় না ন্সেই সংস্কৃতি, যার শিকড় থাকে গ্রামে। গ্রামে গ্রামে আজও কৃষক রমনীরা আউনি বাউনি বাঁধেন। নানা রকমের পিঠা বানান পৌষ পার্বনে। কিন্তু সারা দেশের কৃষকের মাথায় আজ চেপে বসেছে সর্বনেশে তিন আইন। নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকরা তো নানা রাজ্যে রাস্তার উপরে অবস্থান করছেন। এ পর্যন্ত মারা গিয়েছেন ৫০ জনের বেশি কৃষক। কৃষকদের মনেই তো আজ আনন্দ নেই। কৃষক রমনীরা কি আউনি বাউনি বাঁধছেন? পৌষ পার্বন কি আর আগের মতো থাকবে?
0 Comments.