- 13
- 0
সম্পাদকীয়
শীত আসতে শুরু করেছে। আর শীত এলেই আমাদের নরম রোদের সিঁড়ি বেয়ে ফিরে যাওয়া অতীতে । তেমনই আজ সাবান অপেরার কথা মনে পড়ল। আর সেই কথাই রইল পাঠকের দরবারে ।
তখন বোকা বাক্স সবে আসতে শুরু করেছে। দূরদর্শনে খবর পড়তেন দেবদুলাল বন্দ্যপধ্যায়, ছন্দা সেন প্রমুখ। ঘোষিকার ভূমিকায় চৈতালি, শাশ্বতী| মধুমন্তি, কমলিকা আরেকটু পরে। সাপ্তাহিকীতে পঙ্কজ সাহা। রাত আটটার পর দিল্লীর খবর। যেই নটা বাজল অমনি চল মন 'টিনসেল টাউন'। বোধহয় মুম্বাইতে তৈরি হয়ে সম্প্রচারিত হত 'সাবান অপেরা' দিল্লী থেকে। 'ইয়ে যো হ্যায় জিন্দাগি', নুক্কাড়, হা্মলগ, বুনিয়াদ, এয়ার হোসটেঁস, বডি লাইন সিরিজ, চুনউতি, সুনীল গাভাস্কার প্রেসেনটস। রোববার সকালের লুচি সাদা আলুর তরকারীর পর স্পাইডার ম্যান, কাচ্চি ধুপ, সাথে 'রসনা' সরবত আর সার্ফের ললিতা জি। 'রজনী' র পর মাংস ভাত আর তারপরই পরীক্ষার গুঁতো সামলাতে পড়তে বসা। ধুর ছাই ভাবব না শেষটুকু।
নুক্কারের সেই গুরু আর টিচারজির প্রেম, হিরো হতে চাওয়া হরির হিরোপনা, খপ্রির ঢুলু ঢুলু মাতাল চোখের মাতলামো আর শেষ এপিসোডে সেই বিখ্যাত ক্রিকেট ম্যাচ। নুক্কার ছিল গলির বস্তির নবাব বাদশাদের আরব্য রজনী। আর তাদের সাথে এক হয়ে যেতে বাধা কি। শুক্কুরবারের আধ ঘণ্টার মামলা। যেমন চিত্রনাট্য, তেমনি নির্দেশনা, তেমনি অভিনয়। ভালো কাজ বোকা বাক্সতেও হয়েছিল। এখন হয় কিনা জানি না।
বডি লাইন সিরিজের লারউড , উফ কি দৃপ্ত ভঙ্গী, বল করছেন ডন ব্রাডম্যান কে| স্যার ডনের মাথায়,গায়ে বল লাগছে , আমরা শিউরে উঠছি বোকা বাক্সর এপারে মন তখন অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের টেস্ট সিরিজে, কোথায় তখন দক্ষিণ কলকাতার এঁদো গলি।
হামলোগে অশোক কুমার কালো চশমা পরে কিছু বলতেন, বুঝতাম না কি বলছেন তবে অভিনব চতুর্বেদী মনে দোলা দিয়েছিল প্রথমবার। 'নানহে'র চরিত্র। সেই নীল চোখের গভীর দৃষ্টি।
'ইয়ে যো হ্যায় জিন্দেগী'র সতিশ শাহ কি অসম্ভব অভিনয় দক্ষতা, পরে তিনি বড়পর্দা শাসন করেছেন। আজও করছেন। এয়ার হসটেঁসের কিটু গিদওয়ানিকে দেখে 'মাই আম্বিশন' ইংরেজি রচনায় লিখে ফেলল এক বান্ধবী এয়ার হসটেঁস হবেই। আমারও একটু শখ জেগেছিল মনে মনে, বাবার ধমক খেয়ে লিখলাম 'ঐতিহাসিক'। অবশ্য স্মৃতির ইতিহাস রচনা ছাড়া আর কিছু করা হল না।
চুনউতির আরিফ জাকারিয়া| কি অভিনয়, কি মোহময় আবেদন, আহা। সব সময় কি আর বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেড়ে বাবা বাড়ী থাকলেই টি.ভি বন্ধ। বুধবারের চিত্রহার উফ ভগবান বাবা সন্ধ্যেটা বেড়িয়ে যাক। গিলব সুরের ডোজ সঙ্গে 'মোহ মোহ কি ধাগে'তে জড়িয়ে যাবে হৃদকমলের পাপড়িগুলি।
নুক্কার, বডি লাইন সিরিজ, সুনীল গাভাস্কার প্রেসেনটস বাবার সাথেই বসে দেখতাম বাধা ছিল না।
শারুখ তখন ছোট পর্দায় সার্কাস, ফৌজিতে । ভারি মিষ্টি লাগত। কে জানত আমরা কলেজে উঠতে উঠতে ইনিই 'কি কি' করে কিরণকে ডাকবে।
কাচ্চি ধুপের অলকা ('ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া' র ভাগ্যশ্রী) , তিনটে বোনের গল্প, পিতৃহীন এরা। মা চাকরি করেন।কলেজ না গিয়ে ঘরের কাজ করে অলকা তাঁর সাথে নিখিলের প্রেম , নিখিল গৃহশিক্ষক| এই নিখিল ,আশুতোষ গয়াত্রিকার ( বিখ্যাত পরিচালক এখন)। মাঝের বোনটা টম বয়, লেখিকা। লেখিকা বোনের সব কবিতা ,গল্প ছিঁড়ে ফেলে ছোট বোন। ছোট দুটো বোনের সবসময় ঝগড়া। শেষ এপিসোডে নিখিল অলকার প্রেমের শুভ পরিণতি। কবিতা হারানো , দিদির জীবনে প্রেমিক আসায় বিরক্ত লেখিকা বোনকে সামলায় বিদুষী মা আর দিদি। নির্দেশনায় কালজয়ী অভিনেতা 'অমল পালেকার'। ভালো কাজ বোকা বাক্সতেও এককালে হত।
তবে ওই যে যেদিন গোধূলি মেঘলা হয়ে থাকে, ছাদের বাগানের ঝিঙে ফুলেরা, জুইরা , বেগুনী জারুলরা প্রাণপণে রঙ ছড়ায় স্যাতস্যাতে বিকেলে, সেদিন নকল দুনিয়ার টেকনোলজি থেকে সত্যি হয়ে যায় সব সাবান অপেরার চরিত্ররা অনায়সেই।
নাহ। সেদিন আর কোন কাজ হয় না।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।
ইন্দ্রাণী ঘোষ
0 Comments.