- 102
- 0
সেরেংগেটির থর্ন ট্রিতে প্রথম রাত এবং দ্বিতীয় দিনের গেম ড্রাইভ...
আফ্রিকার এক অন্যতম গভীর জঙ্গল সেরেংগেটিতে আজ প্রথম রাত কাটাব! সারাদিন সেরেংগেটির ধূ ধূ সাভানায় গেম ড্রাইভ করে সন্ধের মুখে এসে উঠলাম টেন্ট ক্যাম্প - 'থর্ন ট্রি' তে। অপূর্ব পরিবেশ। অসাধারণ ক্যাম্প সাইট।
গাড়ি থেকে সতর্ক হয়ে নামতেই ক্যাম্পের তিনজন কর্মচারী আমাদের মালপত্র সব নিয়ে নিলেন। আমরা ওদের অনুসরণ করে এসে রিসেপশনে ঢুকতেই হাতে চলে এলো রোল করা সাদা তোয়ালে। গরম জলে ভেজা সেই তোয়ালে দিয়ে হাত- মুখ ভালো করে মুছে নিলাম। বেশ আরাম হলো। ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। এর পর এলো শরবত ও কুকিজ। শুরুতেই এমন আপ্যায়ন মুগ্ধ করে দিল।
তার পর ওদের ম্যানেজার অল্প বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ যুবক এগিয়ে এসে বলল, টেন্টের সব নিয়ম কানুন। অসতর্ক ভাবে কখনোই যেন এপাশ ওপাশে চলে না যাই। ওয়াই ফাই পাওয়া যাবে একমাত্র রিসেপশনে। ঘরে নয়। ডিনার টাইম, ব্রেক ফাস্ট টাইম সব বলে বুঝিয়ে শেষে বলল, এবার আমরা টেন্টে গিয়ে রেস্ট নিতে পারি।
সন্ধে হয়ে গেছে। আকাশ জুড়ে সূর্যাস্তের রঙিন ছটা। খুব সুন্দর লাগছিল অরণ্যের এই আবহ ও আকাশ। রিসেপশন থেকে আমাদের টেন্ট বেশ কিছুটা দূরে, একদম ফেন্সিং এর কাছে। তার পর ধূ ধূ হলুদ অরণ্য।
টেন্টে ওরাই পৌঁছে দিয়ে গেল। বেশ আধুনিক ও সুসজ্জিত টেন্ট। আমাদের তিনজন থাকার মত ঘর ও বিছানা রয়েছে। মশারি তো চমৎকার। মন খুশ হয়ে গেল টেন্টের ভেতর সজ্জা দেখে।
টেন্টে নিজেদের মালপত্র গুছিয়ে নিলাম। পর পর দু'রাত থাকব। তাই ব্যবহার করার মত দরকারী জিনিসগুলো ঠিক ঠিক জায়গায় সাজিয়ে রাখলাম। তার পর চটজলদি ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম রিসেপশন কাম ডাইনিং হলে। ওখানেই চা -কফি -সুরা সব আছে। এবং আছে ওয়াই ফাই। এখানে এসে এবার দেখি ছোট্ট রিসেপশন জমজমাট। নানান দেশের অনেক পর্যটক ভিড় করে বসে আড্ডা, গল্প ও মোবাইল ব্যবহার করছে। আমরা কফি নিয়ে বসলাম। ওয়াই ফাইয়ের সাহায্যে নেট অন করে কিছু কাজও করে নিলাম। আমার তো "সবুজ পাঠ - অন্যভুবন" সঙ্গে সঙ্গে যায়। পৃথিবীর যেখানেই যাই, যে প্রান্তেই থাকি না কেন, স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারি না। আমার প্রিয় দিদিমণিরা সব আপডেট নিয়মিত দিয়ে যায়, আমি সময় সুযোগ মত সেগুলো দেখে নিয়ে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজের কথা বলে নিই। দিব্যি চলছে এভাবে আমার ভ্রমণ ও অন্যভুবন!..
"থর্ন ট্রি" র ম্যানেজার ছেলেটির সঙ্গে ভাব করে নিয়ে এবার গল্প জুড়ে দিলাম। গল্প করছি আর বিয়ারে চুমুক দিচ্ছি। এই বিয়ারের নাম "সেরেংগেটি"! চার ডলারে এক বোতল। "কিলিমাঞ্জেরোর", "সাফারি" নামেরও বিয়ার আছে। কাল খাব ঠিক করে রাখলাম। বিয়ার খেতে খেতে গল্পের ছলে অনেক কথা জানলাম ওর কাছে।
সেরেংগেটি পার্ক তিন ভাগে বিভক্ত - Serengeti Plains, Serengeti Corridor, Northern Serengeti.
আজ সারাদিন আমরা সেরেংগেটি প্লেইনস ও করিডরে ঘুরে বেড়ালাম।
সেরেংগেটিতে নানা ভাবে ঘুরে বেড়ানো যায়। অনেক ধরণের সুব্যবস্থা রয়েছে। যেমন -
১. Game Drive
২. Baloon Safaris
৩. Walking
৪. Bird Watching
৫.Filming & Photographic Safaris
৬. Rhino Viewing Experience
৭. Bush Meals
আমরা গেম ড্রাইভই শুধু করব বলে এসেছি।
বেলুন সাফারি আমি মিশরে করেছিলাম। এখানে শুনলাম অনেক খরচ। মিশরে একশো ডলার লেগেছিল নীল নদের ধারে বেলুন রাইড করতে। সেরেংগেটির সাভানায় লাগবে পাঁচশো ডলার!.. এই রেট শুনে আমাদের উৎসাহের বেলুন গেলো চুপসে!..
সাড়ে সাতটা বাজে। জঙ্গলের পরিবেশ কেমন নিঝুম হয়ে গেছে। গভীর অন্ধকারে ডুবে সেরেংগেটি। আকাশ থমথমে। মেঘ ভাসছে। সোলার লাইটের মৃদু আলোয় আবছা চারপাশ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমি একটু ওয়াশরুমে যাব বলে হঠাৎ বেরিয়ে পড়ে হাঁটা দিয়েছিলাম একা। চকিতেই দৌড়ে এসে একজন আমাকে থামায়, "নো নো। ডোন্ট গো অ্যালোন!.." ওদেরই কর্মচারী তার পর আমাকে নিয়ে চলল ওয়াশরুমের কাছে। এবং ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। এতটুকু ঢিলেমি চলবে না!.. কে যে কখন সামনে চলে আসবে, আক্রমণ করে বসবে, কিচ্ছু বলা যায় না!..
ডাইনিং রুমে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার বেশ জমেছিল। আমাদের চারপাশে নানান দেশের মানুষ, নানান ভাষায় কথা বলছে। গল্প করতে করতে ডিনার করছে। ডিনারে অনেক অপশন। পছন্দের খাবার প্লেটে তুলে খেয়ে নিলাম।
আজ আর রাত গভীর করলাম না। ক্যাম্প সাইট নটার সময় একদম নিস্তব্ধ। নিঝুম। শেষ বারের মত টেন্টের ছোট্ট জানালাটা দিয়ে সেরেংগেটির রাতের আকাশটাকে দেখলাম। আহা বৃষ্টি ধোয়া আকাশে তারারা সব মিটিমিটি জ্বলছে। এমন আকাশের নীচে দু'দন্ড দাঁড়িয়ে থাকতে বড় ইচ্ছে করে। কিন্তু উপায় তো নেই। আমি এখন রাতের সেটেংগেটিতে!..চারদিকে বন্যপ্রাণ। কে যে কোথা থেকে হঠাৎ উদয় হবে কে জানে! তাই গুডনাইট সেরেংগেটি। ক্লান্ত শরীর বিছানার আরামে নিমেষেই নিদ্রামগন হয়ে গেল!..
দ্বিতীয় দিনের গেম ড্রাইভে ব্রেক ফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়লাম। প্যাক্ড লাঞ্চ গাড়িতে দিয়ে দিয়েছে থর্ন ট্রি থেকে। জুলিয়াস গাড়ি ছাড়ার আগে একটু ব্রিফ করে দিল, আজ আমরা কোন দিকে যাব। সাইটিং এর চান্স আছে কিনা, বৃষ্টির পূর্বাভাষ নেই সে কথাও বলল।
ল্যান্ড রোভার গড়াতে শুরু করেছে, জুলিয়াস বলল, "কাল গুড স্লিপ হয়েছে স্যার?"
আমরা তিনজনেই বললাম, "একদম সাউন্ড স্লিপ!."
"রাতে কোনও কিছুর শব্দ পান নি?"
"কিসের শব্দ?"
'রাতে তো কাল দুটো কেপ বাফেলো চলে এসেছিল ক্যাম্প সাইটে"
"তাই নাকি!"
"ইয়েস। বাট নাইট গার্ডরা কাউকে কিছু বুঝতে দেয় নি। কেপ বাফেলোদুটোকে বের করে দেয় ক্যাম্প সাইট থেকে।"
এমন ভয়ংকর গল্প শুনে সকালের যেটুকু আলিস্যি ছিল, সব দূর হয়ে গেল। চনমনে হয়ে উঠলাম।
ল্যান্ড রোভার ছুটতে শুরু করল। সেরেংগেটির এমন একটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে যে শুধু এভাবে গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ালেই মন খুশ হয়ে যায়। এই জঙ্গলের ভূ- প্রকৃতির বৈচিত্র্যগুলো হলো- লেক ও লেক পাশ্ববর্তী জলাভূমি, সাভানা তৃণভূমি, কাঁটাগাছের ঝোপ সহ পাহাড় টিলা এবং চিরহরিৎ বনভূমি। এমন বৈচিত্র্যময় বিস্তীর্ণ জঙ্গলে বেড়ানোর আনন্দে মশগুল হয়ে দু-চোখ ভরে দেখতে দেখতে চললাম।
পথের ধারের একটা অচেনা গাছের ডালপালা দেখিয়ে জুলিয়াস বলল, এটা 'সসেজি ট্রি।' দেখতে খানিক কাঁঠাল পাতার মত। অনেক ওয়াইল্ড পাম দেখলাম। বেশ বড় বড় এই বুনো পামগাছগুলো। আকাশিয়া গাছ চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। ইউফোবিয়া ক্যাকটাস চেনাল জুলিয়াস।
হঠাৎ কোথা থেকে যেন উড়ে চলে এলো গাড়ির সামনে অনেক 'গিনে ফাউ।' চাইনিজ মুরগীর মত পাখিগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। সামনে একটা জলাশয় আসছে। কালো ঘোলা জল। সেই নোংরা জলে জলহস্তির দেখা পেলাম অনেক। সারা শরীর ডুবিয়ে ওরা অগুনতি রয়েছে। মাঝে মাঝে একটু নাক তুলে ছোট ছোট চোখ দিয়ে চাইছে, ছবিতে ঠিক ধরতেও পারছি না। জুলিয়াস গাড়িটাকে জলাশয়ের খুব কাছে নিয়ে গেল। তখন আরও ভালো করে এই জলহস্তির দলটাকে দেখলাম। কিন্তু জলের দুর্গন্ধে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। এবার হঠাৎ চোখে পড়ে এই জঙ্গলের বিখ্যাত দুই নাইল কুমীর। রোদ পোহাচ্ছে জলের ধারের ঘাসজমিতে। বেশ বড় সাইজের দুই কুমীর দেখে মজা পেলাম। ছবিও তোলা হলো। নাইল কুমীরদের কথা খুব শুনে এসেছিলাম। তাই দেখতে পেয়ে বেশ আনন্দ হলো।
গিনে ফাউ, জলহস্তী, নাইল কুমীরের পরেই পেয়ে গেলাম লম্বা গলা দুই জিরাফ। জিরাফ দেখতে খুব ভালো লাগে। কেমন সারা গায়ে ডোরা কাটা লম্বা গলার এই প্রাণীটাকে বেশ শান্ত, নিজের মত থাকতে দেখি। জিরাফ আরবী শব্দ " সালাফা", মানে হলো খুব দ্রুত ছুটতে পারে। জিরাফকে সত্যিই ছুটতে দেখেছি গত কয়েক দিনে অনেকবার।
বেলা একটু একটু করে বাড়ছে। রোদ ঝলমলে হয়ে উঠছে সেরেংগেটি। গেম ড্রাইভের আরও গাড়ি চোখে পড়ছে। সবাই কেমন ছুটে বেড়াচ্ছে। এই ছুটে বেড়ানোর মজাটাই খুব উপভোগ্য।
আজও একটা হলুদ রঙের স্কুল বাস চোখে পড়ল। বাস ভর্তি ছাত্র ছাত্রী। ওরা গেম ড্রাইভের আনন্দ উপভোগ করছে। আমি দূর থেকেই টা টা করলাম, ওরাও হাসতে হাসতে টা টা করল আমাদের।
থমসন গ্যাজেল অনেকগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই জঙ্গলে দলে দলে থমসন গ্যাজেল, ইমপালা ও টোপি বারবার দেখা যায়। মাঝে মাঝে তফাত করতে পারি না। ভুল হয়ে যায়। আসলে আমি বন্যপ্রাণ দেখার চেয়ে বনকে দেখি মন দিয়ে বেশি। বন আমার মনহরণ করে নেয় সবার আগে।
একটা ফিশ ঈগল উড়ে এসে বসল গাছের ডালে। ওর ঠোঁটে শিকার ধরা কোনও মাছ। জুলিয়াস গাড়িকে ছোটাচ্ছে আর সতর্ক চোখদুটো জঙ্গলের ঝোপঝাড়কে দেখছে। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে তাকিয়ে থাকল একটু দূরের এক ঝোপের দিকে। তার পর গাড়ি নিয়ে চলে এলো সেই ঝোপের একদম কাছে। ওমা! কি বলব। আমরা তো ভয়ে কথা বন্ধ করে দিয়ে চোখ বড় বড় করে দেখছি, ঝোপের আড়ালে এক মস্ত বড় মহারাজ কেমন শান্ত হয়ে নিদ্রা দিচ্ছেন!...দ্য গ্রেট লায়ন!.. একদম হাত বাড়ালেই সিংহের শরীরটা ছোঁয়া যায়। ধন্য জুলিয়াসের চোখ ও অ্যান্টিসিপেশন।
আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখলাম এত কাছ থেকে সেরেংগেটির সিংহকে। সেরেংগেটি বিখ্যাত এই সব সিংহের জন্যই। প্রায় তিন হাজার সিংহ আছে এই মহারণ্যে। বিখ্যাত বিখ্যাত সেই সব সিংহের নামও অনেকেই জানে- স্কারফেস, মুসাফা, বব জুনিয়র।
বন্যেরা বনে সুন্দর!.. কথাটা এই সব ভুবন বিখ্যাত বনে এলে খুব ভালো উপলব্ধি করা যায়। মস্ত বড় সিংহটা কি সুন্দর ঘুমিয়ে রয়েছে। কোথাও কোনও শব্দ নেই। কোলাহল নেই। দিন বয়ে চলেছে শান্ত, নিস্তরঙ্গ ভাবে। আমরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রকৃতিও দেখছি আবার থেকে থেকেই বনের প্রাণীদের দেখছি স্বমহিমায়। এ দেখার, এ বেড়ানোর কোনও তুলনা হয় না!
পাগলা হাতি কিনা বুঝতে পারছি না, একটু দূর থেকে দেখলাম একটা দলছুট একলা হাতি খুব শূঁড় নেড়ে, লেজ দুলিয়ে, কান ঝাঁকিয়ে কেমন অস্থির ভাবে ছটফট করছে। দেখে ভয় লাগল। পাগলা হাতি ভয়ংকর হয়। কোনওদিন দেখি নি, শুনেছি অনেক। তাই এমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকা হাতিটাকে দেখে ভয়ে ভয়ে জুলিয়াসকে বললাম, "আমাদের দিকে তেড়ে আসবে না তো?"
জুলিয়াস বেশ সিরিয়াস হয়ে বলল, "আমরা ওদিকে এখন আর যাব না। " তার পর গাড়ি ঘুরিয়ে অন্যপথে ছুটতে শুরু করল।
গভীর জঙ্গলের পথে কিছুদূর ছুটে এসে অবাক হয়ে দেখি একটা ল্যান্ড ক্রুজারের পেছনের চাকা নরম মাটিতে আটকে গেঁথে গেছে। চাকা আর ঘুরছে না। গাড়ি থেকে দুই সাহেব, মেম সাহেবরা নেমে এসেছেন। ড্রাইভার বিচলিত। জুলিয়াস সোয়াহিলিতে ঐ গাড়ির ড্রাইভারকে কি সব বলল। দেখতে দেখতে আরও অনেক গাড়ি চলে এসেছে। এই ধূ ধূ জঙ্গলে এমন গাড়ি আটকে যাওয়ার দৃশ্য দেখে সবাই বেশ চিন্তিত। আমরা সবাই গাড়িটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এবার হঠাৎ দেখি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গাড়ি চলে এলো লোক লস্কর নিয়ে। ওরাই জোর কদমে চেষ্টা করে গাড়ির চাকা মাটি থেকে তুলে ফেলল। এমন সফল অপারেশন দেখে আমরা সবাই আনন্দে খুব জোরে হাততালি দিয়ে উঠলাম। জঙ্গল কেঁপে উঠল। পরে মনে হয়েছিল, জঙ্গলে এভাবে হল্লা চিল্লা করে হাততালি দেওয়াটা ঠিক হয় নি!..
জুলিয়াস লাঞ্চ টাইম ঘোষণা করল। প্যাক্ড লাঞ্চ রয়েছে গাড়িতে। এবার একটা জায়গা নির্বাচন করে খাওয়া শুরু করতে হবে। জুলিয়াস দু'একটা জায়গা দেখলো, গাছের ছায়া খুঁজলো, কিন্তু কোনওটাই দেখলাম ওর পছন্দ হলো না। ঠিক নিরাপদ মনে হলো না। শেষে বলল, "গাড়িতে বসেই খেয়ে নিন।"
গেম ড্রাইভে জঙ্গলের আবহে বসে লাঞ্চ করাটা বেশ থ্রিলিং। এমন বিশাল অরণ্য- প্রান্তরে, অসংখ্য বন্যপ্রাণীদের মাঝে দুরু দুরু বুকে চিকেন রোস্ট, এগ স্যান্ডউইচ, চকলেট, ফ্রুট জুস তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া - এই না হলে জীবন কালিদা!..
ওয়াকিটকিতে মাঝে মাঝেই খবর আসে সোয়াহিলি ভাষায়। আমরা বুঝি না। জুলিয়াস বোঝে এবং সেই মত গাড়ি ড্রাইভ করে ছোটে। এই মাত্র খবর এলো লেপার্ড দেখা গেছে!.. ছুট ছুট ছুট!..
ল্যান্ড রোভার দুরন্ত গতিতে ছুটতে শুরু করল। পথে অনেক জেব্রা, থমসন গ্যাজেল দেখলাম। দূরে তিনটে লম্বা গলার জিরাফ গলা উচিয়ে গাছের পাতা চিবোচ্ছে। এসব এখন নিছকই দেখা। আসল দেখার জন্য মন উচাটন - লেপার্ড দেখব এখন!..
লেপার্ড যে এমন আদুরে খোকা হবে ভাবতে পারি নি!..আমরা অন্তত পঁচিশটা গাড়ির আড়াল থেকে স্পষ্ট দেখলাম একটা চার সাড়ে চার ফুটের অসম্ভব সুন্দর লেপার্ড গাছের মগডালে শরীর এলিয়ে ডালটাকে জড়িয়ে কি সুন্দর বিউটি স্লিপ দিচ্ছে!.. সাদা কালো ছোপ ছোপ এই লেপার্ডকে দেখে মনে হচ্ছিল একটু আদর করে দিই!..চুপ!.. চুপ!.. মহারাজ নিদ্রা গিয়েছেন। কোনও শব্দ কোরো না!.. গোলোযোগ সইতে পারেন না!..মনোজ মিত্রর নরক গুলজার নাটকের এই গানটা আমার মনে পড়ে গেল লেপার্ডকে দেখার জন্য অন্তত তিরিশটা গাড়ির জমায়েত ও ফিসফিস শব্দ শুনে!..
অনেক অপেক্ষার পর তিনি জাগলেন!.. ঘুম ভাঙ্গা চোখে কি মারাত্মক একটা লুক ছুড়ে দিলেন আমাদের দিকে, সব কটা ক্যামেরা লুফে নিল এই কোটি টাকার বিরল দৃশ্য!.. উফ কি অসম্ভব সুন্দর সেই চাউনি লেপার্ডের!.. হলিউডের হিরোরা হেরে ভূত হয়ে গেল! আমরা ধন্য হলাম এই দুর্ধর্ষ মাস্তান সুলভ চেয়ে দেখার দৃশ্যের সাক্ষী হতে পেরে। কি সুন্দর, কি আনন্দ যে হয়েছিল এই লেপার্ড দেখে একদম চোখের সামনে থেকে। জুলিয়াসকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম। ও গাড়ির পজিশন এত সুন্দর জানে করতে, আমরা অত ভিড়ের মধ্যেও লেপার্ডকে নিঁখুত পর্যবক্ষণে দেখে দারুন আনন্দ পেয়েছি।
লেপার্ড দেখার পর গেম ড্রাইভ আর জমল না। আসলে পায়েস খেয়ে ফেলেছি তো!..
বিকেল ফুরিয়ে সন্ধে নেমে আসছে। এরপরও কিছু ঘোরাঘুরি হলো। বন্যপ্রাণীদের আবারও দেখা পেয়েছি। পর পর দুদিন সেরেংগেটিতে গেম ড্রাইভ করে মন আনন্দে ভরপুর ও পরিপূর্ণ।
ফিরে চলেছি ক্যাম্প সাইটে। সন্ধের অস্তরাগে আকাশ মায়াবী রঙিন হয়ে ধরা দিল চোখে। মুসাফির মন আর আমার এই সাত জনমের সৌভাগ্যর জন্য সারা পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এসব দৃশ্য দেখার সুযোগ ঘটে যায় বারবার, তাই মনের আনন্দে হাসি কাঁদি গান গাই। আজও এমন অপরূপ সানসেট দৃশ্য দেখতে দেখতে নিজের ভাগ্যকে নিজেই শাবাশ বলছিলাম বারবার ! আর রবিঠাকুর গুণ গুণ করছিলেন বুকের ভেতর," আজি হৃদয় আমার যায় যে ভেসে.. কোন্-সে অসম্ভবের দেশে.."
ক্যাম্প সাইটের কাছাকাছি এসে পথের এক বাঁকে হঠাৎ দেখি একটা হাতি-পরিবার দুলে দুলে যাচ্ছে! এলিফ্যান্ট ফ্যামিলির ইভনিং ওয়াক! এক দুই তিন...গুনে দেখলাম সাতটা হাতি চলেছে সপরিবারে!..সবার ছোট হাতিটা মাঝখানে। ছোট্ট সোনা, চাঁদের কণা!..
হাতি চলেছে আগে আগে, পিছে চলেছি আমরা!..
সেরেংগেটিতে সন্ধে নেমে গেল। সবুজ অন্ধকারে জঙ্গল কেমন নিঝুম এখন। শান্ত নির্জন এই সেরেংগেটিকে দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম আমাদের রাত ঠিকানা সেই "থর্ন ট্রির"কাছে। দ্বিতীয় রাতও কাটবে এই জঙ্গলে। এই অসাধারণ ক্যাম্পে। দূর থেকে দেখলাম ক্যাম্পের দুই প্রহরী গেটের কাছে সার্চ লাইট জ্বেলে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য!..
সার্চ লাইটদুটো জ্বলছে যেন বাঘের চোখের মত জ্বল জ্বল করে!..
ক্রমশ....
0 Comments.