Wed 12 November 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব - ২৭)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব - ২৭)

শহরতলির ইতিকথা

শহরের অধিবাসীদের বিনোদনের জন্য গড়ে ওঠা' শ্রীকৃষ্ণ টকীজ' আজ বহুদিন হলো বন্ধ আছে। লাইব্রেরির কাছেই রাস্তার উল্টোদিকে, মানে পশ্চিম দিকে ওটা; এখন সেখানে, ম্যাজিক শো'র মত বড় বড় অনুষ্ঠান,থিয়েটার ইত্যাদি হয়ে থাকে; রমাদের বাড়ির ভাড়াটিয়াথাকা কালে,মা'র সঙ্গে এসে রাজীব ঐ হলের দোতলায় বসেছে; বর্তমানে,লাইব্রেরির কাছেই রাস্তার ঐ উল্টোদিকে নতুন সিনেমা হল হয়েছে,নাম 'স্বপ্নপুরী'; প্রথম ছবি 'সবার উপরে' দিয়ে শুরু; সেদিন শো ছিল একেবারে ফ্রি, বিনি-পয়সায় বিনোদন,তো স্বাভাবিক ভাবেই দর্শক সমাগম ছিল যথেষ্ট। ঐ সিনেমা হলকে ঘিরে আবার নতুন করে, লাইব্রেরির সন্নিহিত অঞ্চল হয়ে উঠেছে জমজমাট; অদূরেই রয়েছে অঞ্চলের পুলিশ-ফাঁড়ি ও রাস্তার সামনা-সামনি উল্টো দিকে ধুঁকে ধুঁকে চলা 'বল্লভ নন্দন চ্যারিটেবল হসপিটাল'। এই সেবা - প্রতিষ্ঠানে আছেন একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তার; উনিই এ অঞ্চলের ম্যালেরিয়া - আক্রান্ত মানুষের ভরসা - স্থল ছিলেন।

ম্যালেরিয়ার ভয়ে,বহু মানুষ পিতৃপুরুষদের ভিটে ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে, এ অঞ্চলের ভাঙ্গা, পোড়ো বাড়িগুলো তার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ডাক্তার বাবু,সত্যিই ডাক্তার, ভগবান, সেই মড়কের সময়, তিনি ও তাঁর কম্পাউন্ডার 'একা কুম্ভ রক্ষা করে নকল বুঁদিগড়'র মত এ অঞ্চলকে ম্যালেরিয়ার ছোবল থেকে রক্ষা করেছেন;বৃটিশ সরকারের অবদানও কম নয়। কাছের কারখানার এক ইউরোপিয়ান সাহেব,দেশে ফিরে যাবার আগে নিজের বিলিতি চার-চাকার গাড়িটা ডাক্তার বাবুকে উপহার স্বরূপ দিয়ে যান। ডাক্তার, ভগবান কি না!

সিনেমা হলের সামনে রাস্তার উল্টোদিকে (গঙ্গার দিকে) রয়েছে,চা-ঘুগনির দোকান,পানের দোকান ,মিষ্টিও সিঙ্গাড়ার দোকান ---সারি সারি রিক্সার দাঁড়িয়ে থাকার স্থান, হয়েছে অর্থনৈতিক ক্রিয়া-কর্মের নতুন যজ্ঞ -স্থল।মিষ্টির দোকানের মালিক, বড় রসিক লোক,উদ্বাস্ত হয়ে এদেশে এসে কেষ্ট ঘোষও ওর ভাই মনা,অক্লান্ত পরিশ্রম করে,আজ এ অবস্থায় এসেছে। কেষ্ট ঘোষ,রাত তিনটেয় ঘুম থেকে উঠে,সাইকেল চালিয়ে ব্যাণ্ডেল অঞ্চলের খাটাল থেকে মোষের দুধ সংগ্রহ করে,দুধের কেঁড়ে সাইকেলে ঝুলিয়ে, সেই কাকভোর থেকেই বাড়ি বাড়ি দুধ দিয়ে আসছে;এটাই ওর প্রথম ব্যবসা এ বাংলায়,জাত ব্যবসাও বলা যেতে পারে।

ভোরবেলা সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে রাস্তায় চলা;ঘন্টি শুনলেই লোকে বোঝে কেষ্ট ঘোষ রাস্তা অতিক্রম করে চলেছে,একেবারে সময় নির্দিষ্ট, কোনো হেরফের নেই; খদ্দের সব বাঁধা, তবু যে কেউ ডেকে দুধ হবে কেষ্ট, জিজ্ঞেস করলে, কেষ্ট ঘোষ না বলবে না; অতিরিক্ত দুধ বিক্রি করতে তার অসুবিধা নেই। কেষ্ট ঘোষের দুধের কেঁড়ে তো ম্যাজিসিয়ান পিসি সরকারের 'পট অফ দি গ্যাঞ্জেস', যতই দুধ দাও না কেন,আবার ঠিক পূরণ হয়ে যাবে; অতিরিক্ত দুধ কাউকে দেবার পর, মিউনিসিপ্যালিটির কলের মুখে পোয়াটা ধরে সমপরিমান জল কেঁড়েতে ঢালবে, না কোনো ভেজাল না, ফ্রেস মিউনিসিপ্যালিটির জল; জিজ্ঞেস করলে বলবে, "তিন টাকায় কিইন্যায়, তিন টাকায় দিতে হইবো, তো, জল দিব না, দুধ দিব!সত্যিই তো! না,সে কোনোদিন টাকা চায় না, লোকে যখন দেবে তখন নেবে, মুখে আছে সদা কৃষ্ণ নাম, আহা কী বাহার, কী মধুর সে নাম,যে বলে সে আনন্দে, যে শোনে সেও করে বিরাজ আনন্দে---।

ঠিক দশটায়, দুধ দিয়ে সিনেমা হলের সামনে খাবারের দোকানে এসে ভাই মনাকে ছেড়ে দেবে।সকাল বেলায় দোকান খোলে ভাই মনা;ধূপ-ধুনো দেয়;কেষ্ট ঘোষের হুকুম,প্রতিদিন সকালে যেন সিনেমা হলের গেটে ধূপ-ধুনো দেখিয়ে প্রণাম করা হয়।সিনেমা-হলই ওদের লক্ষ্মীঠাকরুণ, ওর যত্নের যেন ত্রুটি না হয়। মনা বাড়িতে গিয়ে টিফিন খেয়ে,দাদাও কর্মচারীর টিফিন নিয়ে আসে। দোকানের কর্মচারীকে নিয়ে মনা, সকাল বেলায় চার পেতে সিঙ্গারা ও চার ট্রে অমৃতি(ছোটো ও বড় সাইজের)করে রাখে; প্রায়দিনই বেলা এগারোটার মধ্যেই প্রায় সবই বিক্রি হয়ে যায়; ম্যাটিনির শো দুটো থেকে শুরু, তাই সিঙ্গাড়ার লেচিতে পুর পুরে, আকৃতি দিয়ে, রেডি করে বারকোশে রেখে, সে ও কর্মচারী, বেলা দেড়টা- দু'টোয় খেতে যায়। কেষ্ট ঘোষ, নির্জন দুপুরে দোকানের টাটে বসে থেকে ভাবে,কী করে উদ্বাস্তু অবস্থা থেকে আজ---। বাড়িতে পোষ্য অনেক আছে, প্রত্যেককে হুকুম করে, "দেহ,আমরা সুযোগ পাই নাই, তোরে সুযোগ কইরা দিছি, ভালো কইরা পড়াশোনা কইরা মানুষ হ, নইলে সাত জনম গরুর সেবা করতে হইবো।"

ম্যটিনি শো'র হাফ-টাইমের আগেই টাটকা সিঙ্গারা উঠে আসে পেতেতে; হাতে গরম খাদ্যবস্তুর লোভে পেতে খালি হতে দেরি হয় না। আবার পরের হাফ শুরু হলে, একটা প্লেটে করে সদ্য ভাজা দুটো সিঙ্গাড়া ও একটা বড় সাইজের অমৃতি নিয়ে কর্মচারীকে, সিনেমার অপারেটরের কাছে পাঠায়; কেষ্ট ঘোষের কাছে অপারেটর হচ্ছে,মা লক্ষ্মীর বাহন, তার তুষ্টি হলে,মাও খুশি থাকবে।

রজত মাঝে মাঝে, শীতকালে সন্ধে বেলায় মনা ঘোষের দোকানে এসে, এক গ্লাস গরম দুধ খেয়ে থাকে। একদিন হলো কী,রাত ন'টা--সাড়ে ন'টা নাগাদ,ট্যুইশান শেষ করে দোকানে এসেছে; সিনেমার শেষ শো'র হাফ টাইম হয়ে, আবার শো আরম্ভ হয়েছে; দোকান, একরকম ফাঁকাই বলা যেতে পারে;রজত,দুধ চাইতেই,কেষ্ট ঘোষ ভিতরে গিয়ে,এক গ্লাস দুধ এনে দিল;

 টাটৈ বসে আছে মনা ঘোষ। দুধের চুমুক দিতেই,রজত বুঝতে পারলো,কেষ্ট ঘোষের কেরামতি;চেঁচামেচি করতেই,কেষ্টঘোষ বলে,"রাগস ক্যান,তুই দুধ চাইচস,তোরে দুধ দিছি,দ্রোণাচার্য,পোলারে পিটুলিগোলা দিছিল,আমি তো তোরে,কড়াই'র তলার শেষ টুকু জল মিসাইয়া দিছি,তোরে তো পয়সার কথা কই নাই।" রজত রেগে বলে,"আচ্ছা,কেষ্টদা,তুমি দুধে কতটা পরিমাণ জল দিতে পারো?"কেষ্ট ঘোষের উত্তর,"নির্ভর করে,দামের উপর।"

 "তিনটাকায় দুধ দেবে?"

  "হ্যাঁ,দিব"।

"আড়াই টাকায়?"!

 "হ্যা,দিব"।

"দু'টাকায়?"

"দিব,তবে, সাদা রং বোধ হয় রাখতে পারুম না।"

এর পর তো রজতের পক্ষে রাগ করে থাকা সম্ভব হয় না;সে হাসতে হাসতে বলে,"তুমি সত্যি করেই জাত গয়লা - ঘোষ।"

জন্মাষ্টমীতে বাড়িতেই হয় সাতদিন ধরে হরিনাম সংকীর্তন; তো, সারা বছরের ব্যবসার জন্য করা পাপ, সব ধুয়ে সাফ।

দোকানের অদূরেই রয়েছে,অঞ্চলের নামকরা ডাক্তার সাধুর চেম্বার;রোগী উপচে পড়ছে,ছোটোখাটো হসপিটাল বললেও অত্যুক্তি হবে না:চার নম্বর রুটের বাসের কন্ডাকটররা নাম দিয়েছে চেম্বার স্টপেজ।সকাল থেকে, রোগীও তাদের আত্মীয়রা চেম্বারে বসে থাকে;কেষ্ট ঘোষের দোকানেই তারা জলখাবার সাড়ে;সুতরাং ঘোষেদের দোকান সকাল থেকেই থাকে জমজমাট। নিকট আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এক বৃহৎ পরিবারের কর্তা যে কেষ্ট ঘোষ,নিঃস্ব,উদ্বাস্ত হয়ে এসে চাটুজ্যেদের পুজো দালানে ঠাঁই নেয়;তাদের মত আরো এক পরিবার ঐ দালানে আশ্রয় পায়।এ অঞ্চলের মানুষের কাছে তারা কৃতজ্ঞ, এ অঞ্চলই মানুষই তাদের প্রকৃত স্বজন।

চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register