Thu 13 November 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি || পুপুর ডায়েরি - ৮১ ||

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি || পুপুর ডায়েরি - ৮১ ||

পুপুর ডায়েরি

জীবন এক মায়াবী যাত্রা। যাত্রীরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে।

কখনো আনন্দ পায় পথের বাঁকে।

কখনো বন্ধুর পথের পাথুরে কোনো অংশ, ব্যথা দেয় পায়ের তলায়।

কখনো হঠাৎ করে পথের পাশে ফুলের ঝাড়, প্রজাপতি আর মসৃণ সরণি আশ্চর্য আলোয় উজ্জ্বল করে তোলে যাত্রীর মন।

কত মানুষ এসে পড়ে সহযাত্রী হতে।

প্রত্যেকের নিজস্ব যাত্রার ভাগে কিছু সময় হয়ত, অন্য কারো সাথে পা মিলিয়ে চলার থাকে।

কে ঠিক করে যাত্রাপথের নির্দেশ কে জানে।

খোঁজে অনেক মানুষই।

কখনো ক্ষোভে, কখনো ধন্যবাদ জানানোর ইচ্ছেতে।

রহস্যময় পথপ্রদর্শক কোথায় বসে মিটিমিটি হাসেন, কে জানে।

দিন কয়েক আগে, রাস পূর্ণিমা ছিলো।

রাস পূর্ণিমা আমার ছোট্ট বেলার নরম গরম স্মৃতি।

টালিগঞ্জ নামক জায়গায়, মণ্ডলদের অনেকখানি জমি ছিল। জমিদার হয়ত তাদের বলা হত তখন।

আমরা বড় হবার সময়, তাদের শূন্য হয়ে যাওয়া বড়ো রাজবাড়ী, ছোটো রাজবাড়ী নামের মহল দেখতে পেতাম। স্থানীয় লোক সেগুলিকে রাস বাড়ি ও বলতো। একটি মস্ত একতলা মহল ছিল ভিতরে বাগান টাগান সমেত। বুড়ো মানুষরা বলতেন, ওটি মণ্ডলদের নায়েবের মহল ছিলো এক কালে।

পুপুর বাবা কাকা পিসিদের সময়ে, এখানে একজন প্রত্নতাত্ত্বিক মানুষ, তাঁর পরিবারসহ বাস করতেন।

আরও খানিক গঙ্গার দিকে এগিয়ে গেলে, রাসবাড়ির আগেই পড়ত, প্রায় পাঁচ মানুষ গভীর এক বিশাল গর্ত।

তার ঢালু গা বেয়ে ক্ষুদ্র মানুষ আর গরু ছাগল ও নেমে যেত। সেও বড়রা বলতেন, মণ্ডলদের পুকুর।

তার পাড় ধরে, রাস বাড়ি নামক এখনকার ফাঁকা ধু ধু বাড়ি, যেখানে কুমোরপাড়া গড়ে উঠেছে, সেখানে মাটির খেলনা, মাটির ঠাকুর বানিয়ে রোদে দিতে দেখা যায়।

সেও পিছনে ফেলে, এগিয়ে গেলে যাকে আদি গঙ্গা বলে, তার দেখা মেলে।

সরু হয়ে, পলিতে শুকিয়ে যাওয়া জলধারার ডাকনাম টালির নালা। কোন একজন টালি সাহেব, তার ওপরে ব্রিজ বানিয়ে বরিশার চণ্ডীপুজো করা পুরোনো সাবেক কলকাতার সাথে, নতুন গজিয়ে ওঠা কলকাতার দক্ষিণ ভাগের যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন।

সেই নামেই বুঝি টিপু সুলতানের বন্দী করে রাখা ছেলেদের মসজিদ সংলগ্ন জমিকে চিহ্নিত করেছিল বৃটিশ সরকার। টালিগঞ্জ।

সেই গঙ্গাবক্ষ থেকেই পঞ্চমুণ্ডির আসন নিয়ে উঠেছে পঞ্চানন শিবের মন্দির। চারপাশের মানুষ সেই লাল টুকটুকে, নন্দীকেশ্বরের পিঠে বসা ঠাকুর, আর পাশেই তাঁর শক্তি গন্ধেশ্বরী দেবীকে, পরম ভক্তি ভরে পুজো করেন।

রাস পূর্ণিমা আসে যখন, কদম ফুল ফোটে ।

কদম ফুলের প্রতি পুপুর অনেক দিনের লোভ।

হলুদ রঙ গায়ের ওপর এই যে সাদা সাদা রোঁয়ার আস্তরণে, যেন রোদের রশ্মির মত, নাকি গোল পূর্ণিমার চাঁদের মতন, সারা গাছ আলো করে ফুটে থাকে। কদম গাছের তলায় রাধারাণী শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে সারা রাত আনন্দ করেন, আর সাথে সব সখী মনে করে সকলের সাথেই নেচে চলেছেন শ্রীকৃষ্ণ, তবেই ত রাস।

পুপুর ঠাকুমা রাসের মেলা থেকে ট্যামটেমি কিনে দেন।

একখানা মাটির সরার ওপরে পাতলা কাগজ সাঁটা। সে কাগজের ওপর, আলতার মত কি জানি রঙ দিয়ে আঁকিবুঁকি করা থাকে । ফুলের মত আলপনা।

 মাটির সরার নিচে পাতলা কাঠের এক জোড়া চাকা লাগানো । আর পাতলা বাখারির টুকরো তিন কোনা করে লাগানো থাকে ওই পাতলা কাগজের ওপরে।

ট্যামটেমির চাকার পাশ দিয়ে লম্বা দড়ি বাঁধা।

দুটো ছোট কঞ্চির টুকরো আটকে রাখা আছে তিন কোনা বাখারির গায়ে।

আজব যন্ত্রখানা।

দড়ি ধরে টানলেই ট্যামটেমি এগিয়ে চলে মালিকের পিছু পিছু।

তিন কোনা বাখারির সাথে বাঁধা কঞ্চি ওঠে নামে চাকা ঘোরার সাথে।

পাতলা কাগজের গায়ে আওয়াজ ওঠে,

ট্যামট্যাম ট্যামট্যাম।

আরও কতকিছু কিনে পাঠান ঠাকুমা।

ছোট ছোট পোড়া মাটির হাঁড়ি কড়া উনুন পুতুল, শিল নোড়া ও। এই সব পাওয়া যায় রাসের মেলাতে।

রাস পূর্ণিমা।

ছয়ের দশকের কাছে এসে, চাঁদের আলোর খোঁজ করি।

কুয়াশায়, ধুলোর আস্তরণে ঢাকা আজকের তথাকথিত আধুনিক কলকাতার আকাশে চাঁদ থাকলেও দেখতে পাওয়া মুশকিল।

তীক্ষ্ণ নজর, চিত্রশিল্পে পটু বন্ধুদের কাছে বায়না করি।

এই, চাঁদ পাওয়া যাবে কিঞ্চিৎ?

সেই যে জ্যোছনা, সে তো আমার সঙ্গে আড়ি করে চলেই গেলো। দাও কেউ একটু তাকে ধরে।

দেয় বন্ধুরা।

তারা জীবনের যাত্রাপথে একসাথে চলেছে অনেক কাল।

অনেক আদর, অনেক ঝগড়াঝাটি, অনেক খুনসুটি, চোখের জল, মুখের হাসি, তাদের সাথেই ভাগ করে নিয়ে হেঁটে চলেছি রাস্তা, পূর্ণ চাঁদের মায়ায়।

এ বছরের চাঁদের ছবি মধ্য রাতের আবদারে প্রাপ্তি হতে, ঘুমের ঘোরেই মনে পড়ে গেলো, সেই আরেক রাস পূর্ণিমার কথা।

তখন তো আমরা ছোটো মানুষ।

কোথায় বা ফোন, কাকেই বা বলতো মোবাইল। ক্যামেরা খুব দামি জিনিস ছিল।

আমাদের ও সব ছিলো না।

হাতের টান ছিলো।

সাদা কাগজে কলমের টানে নিপুণ ফুটেছিল পূর্ণিমার চাঁদ। কৃষ্ণনগর যাওয়ার পথে, ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা। কোনো ব্রিজ পেরোবার সময়।

সে এসেছিলো চিঠির খামে।

কত আকুলিবিকুলি ধরা থাকত কাগজের পাতায়।

আজকের দিনের চাঁদ মিটিমিটি হাসে নির্ঘাত মানুষের এই ছেলেমানুষি দেখে।

তাকে সঙ্গে নিয়ে ভালবাসা কেমন করে হাঁটতে হাঁটতে চলেছে সময়ের ছায়াপথ ধরে।

মায়ার চাদর জড়িয়ে আছে মনের গায়ে।

রাস পূর্ণিমা মাধূর্য ছড়াবে আজ কাল পরশু।

উনিশ শতকের কবি লিখবে,

…দূর রাস পূর্ণিমায় কোন এক দিন

সুগোল রুপোর থালা উঠেছিল ফুটে

অরূপের নীল মাখা আকাশ গঙ্গায়।

কোন এক রোমাঞ্চিত ,প্লুত কবি গেয়েছিল

“মধুরম”...

বিগলিত আবেশে আবেগে

“মধুরম”...

আকাশ,বাতাস,ধূলি,গোপ বধূ, গাভী‌,

জ্যোৎস্নার আলোক- ঢেউ –

সবই মধুময়।

শুধুই লাবন্যে পূর্ণ

এ যুগের মন হয়ত অন্যরকম করে বলবে।

তবু চাঁদের হাসির মায়া তো কম হবে না।

একেক যুগের মন একেক রকম ভাবে বলেই চলবে, মধুর তোমার শেষ যে না পাই…

হে মধুরাধিপতি, তোমার এই অখিলে আমার জন্য এক চামচ মধু, সামলে সুমলে রেখে দিও। আমি সর্বদাই হাত পেতে আছি

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register