Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ১০৩)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ১০৩)

রেকারিং ডেসিমাল

তিল ধারনের জায়গা নেই মন্দিরের গর্ভগৃহে। কি ঠেলাঠেলি! সবাই এগোতে চাইছে সামনে। রেলিং পেরিয়ে নীচে শিব ঠাকুর তো চৌকোনা কুণ্ডের মধ্যে জলে, ফুলে, দুধে, বেলপাতায় হাবুডুবু হয়ে আছেন। হায় কপাল! আমি যে খুদি খুদি সোনা আর রুপোর বেলপাতা নিয়ে এসেছি। হাতের মুঠোয় এখন তারা। ঠাকুরের মাথায় দেব কি করে? কোন রকমে ধাক্কাধাক্কি করে রেলিং অবধি পৌঁছেছি। সবাই চারপাশ থেকে গঙ্গাজল, ফুল বেলপাতা হই হই করে ছুঁড়ে দিচ্ছে ঠাকুরের দিকে টিপ করে। উফফ। এই রকম করে কি পুজো হয়? বাবা রে বাবা! একজন আমার কর্তার থেকে ও লম্বা, মানে ছ ফুটের থেকেও বেশ খানিকটা বেশি লম্বা, আর অনেক খানি চওড়া খাকি উর্দি পরা টুপি মাথায় পুলিশ ভিড় সামলাতে চেষ্টা করে চলেছে। হুংকার দিচ্ছে, হঠ যাইয়ে, সব জলদি দেখকে সামনে সে হঠ যাইয়ে। আমি ঠেলে ঠুলে একেবারে সামনে পৌঁছে শক্ত করে সামনের রেলিংটা চেপে ধরলাম। চারপাশে মানুষের স্রোত জোয়ারের জলের মত প্রবল উচ্ছ্বাসে গর্জে চলেছে, হর হর মহাদেব!! সব্বাই ছিটকে যাচ্ছে নিজের ইচ্ছে ছাড়াই ভিড়ের সঙ্গে।

আমি ত যাবো না। আমি দেখব বিশ্বেশ্বরকে। তারপর ঠাকুরের মাথায় বিল্বপত্র দিয়ে তবে ফেরত যাবো। তাই আমি দু হাতের আঙুল দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে রাখি লোহার রেলিং।

এবার হুংকার আসে পালোয়ান পুলিশজীর কাছ থেকে। হট যাইয়ে, জো জো কা দরশন হো চুকে নিকল যাইয়ে। পিছে ওয়ালে কো অন্দর আনে দিজিয়ে।

সবাই আবার বিপুল ধাক্কায় সরতে থাকে বেরিয়ে যাবার দরজার দিকে। আমি আরও জোরে আঁকড়ে রাখি রেলিং।

এইবার আচমকা একটা থাবার মত হাত খপ করে আমার ডান হাতের কনুইয়ের কাছে ধরেছে টের পাই। চমকে দেখি পুলিশ পুঙ্গব আমার হাত ধরে টান দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। আমি সরিনি ত তাই।

ষড়রিপুর মধ্যে আমায় যিনি বানিয়েছিলেন, প্রথম রিপু হিসেবে বোধহয় ক্রোধকেই এগিয়ে দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ত্বকের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে। আমার সম্মতি ছাড়া কেউ কখনও আমায় একটা আঙুল দিয়ে ছুঁলেও আমার মস্তকে দপ করে কি একটা জ্বলে ওঠে। আর এই দৈত্যাকার পুরুষ জাতীয় জীব আমার হাত ধরে টানছে দেখেই আমার পা থেকে কিছু আগুনের শিখা একেবারে ব্রহ্মরন্ধ্র অবধি লকলক করে উঠে গেল। আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গলা খুলে আ আ আ আ করে আর্তনাদ করতে থাকলাম রেলিং আরও শক্ত করে ধরে রেখে। শ্বাশুড়ি মা আঁতকে উঠলেন। ওই অত্ত ভিড়, তার সমস্ত মানুষ নিঃশব্দ হয়ে গেল। তারপর মুহূর্তে গুঞ্জন উঠলো, কেয়া হুয়া কেয়া হুয়া, কিসিকো ভারি তকলিফ হ্যয়, দিখো কেয়া হুয়া… দৌড়ে এলেন কালো উর্দিতে অনেক ফিতে ব্যাজ লাগানো গুরুত্বপূর্ণ এক মহিলা পুলিশ অফিসার। কেয়া হুয়া?? হাঁ জি.. কোন মেক আপ, সাজের উপায় ত ছিলো না। ইস্টিশনে সব ছিনতাই হয়ে গেছে। সুতরাং, আজ আমি সনাতন ভারতীয় বৌ। লাল পাড় সাদা ইক্কত শাড়ি মাথায় ঘোমটা টেনে পরা। কপালে লাল টিপ আর সিঁদুর। সাইজে নেহাৎ খাটো। তাই ঘরোয়া শান্ত মহিলা ভেবেই এগিয়ে আসছিলেন মহিলা। তুবড়ির মত ইংরেজি বকুনি বেরিয়ে আসা শুনে এবারে থমকে গেলেন বিস্ফারিত চোখে। কলোনিয়াল হ্যাংওভারে আমরা সবাই ভুগিতো।

আমি তখন ইংরেজিতে চেঁচাচ্ছি, যে এত আস্পর্ধা কি করে হয় এই অলম্বুষ পুরুষের, সে আমার গায়ে হাত দিল কোন অধিকারে? মহিলাদের কাউকে যদি সরিয়ে দেবার জন্য গায়ে হাত দিতেই হবে আপনারা মনে করেন, তবে তার জন্য মহিলা পুলিশ নেই কি জন্য? আমি আপনাদের সবার এগেইন্সটে আইনি অভিযোগ করব। যতক্ষণ এই অসভ্যতার হেস্তনেস্ত না হয় রেলিং ছাড়ব না। অনশন করব… মহিলা আমার সামনে করজোড়ে সরি ম্যম সরি, আপ কো কেয়া চাহিয়ে, বলে থামিয়ে দিলেন। আমি তোড়ে চেঁচানোর মধ্যে ব্রেক পেয়ে বড় করে মুখ দিয়ে শ্বাস নিয়ে, ডান হাতের মুঠো খুলে বেলপাতা দেখালাম। ইয়ে শিবজীকে শর কো ন দিয়ে বিনা নহি যাউঙ্গি। কলকত্তা সে বহুত তকলিফ উঠা কে ইসি লিয়ে আয়া। ভদ্রমহিলা ভীষণ তৎপর। সঙ্গে সঙ্গে আমায় বললেন, তুরন্ত মেরে সাথ আইয়ে। ইনি যে কি নিপুন ভাবে ভীড় কাটিয়ে আমায় ভিতরে যেখানে পুরোহিতরা কুণ্ডের পাশে বসে, সেখানে নিয়ে পৌঁছে গেলেন, আমি সম্মোহিতের মত চলে গেলাম ওনার সাথে হতভম্ব হয়ে। সামনে বসে থাকা পুরোহিতকে ভদ্রমহিলা কানে কানে হিন্দিতে কি সব বলে দিতেই, তিনি আমায় ঝড়ের গতিতে, নমস্তে বলে হাত বাড়িয়ে, খাতির করে, পুজো দিইয়ে, জলে ডুবে থাকা শিব ঠাকুরের মাথা ছুঁইয়ে, এক গাল হেসে বললেন, দক্সিনা। আমি গায়ের মধ্যে গুঁজে রাখা পার্স থেকে একশ এক টাকা দিতেই আমার পুলিশ এসকর্ট আমায় এক টানে বাইরে নিয়ে এসে বললেন, সরি ম্যডাম হোপ ইউ আর হ্যাপি নাও। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আমি, না না ইটস ওকে, বলে হাত জোড় করতে করতেই তিনি ধাঁ। আমার কর্তা পরিত্রাহী আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে সেখানে এসে পৌঁছে বললেন, যাক! হারিয়ে যাওনি তবে!

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register