Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

গল্পেসল্পে সুবল দত্ত - ৪

maro news
গল্পেসল্পে সুবল দত্ত - ৪

এক উত্তরাধিকারের সংরক্ষণ কাহিনি 

অস্পষ্ট ঠুক ঠুক আওয়াজে আবার সে সম্পুর্ন জেগে উঠল। কান খাড়া করে শুনতে লাগল শব্দ। শব্দটা ছাদের উপর থেকে আসছে। ছাদের উপরে কেউ আছে কি? সে উঠে দাঁড়াল। সর্বাঙ্গ থেকে শুভ্র জ্যোতি বেরচ্ছে। এই বোধ হতেই সে জামা প্যান্ট টাই জুতো সব খুলে ফেলে যেখানে রাখল সেখানে ছড়ানো রয়েছে অজস্র গ্রেনেড। সেখান থেকে দুটো গ্রেনেড ব্যাগটাতে ভরে নিলো আর ছাদে যাবার সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। সিঁড়ির দু তিনটে ধাপ উঠেই আবার নেমে এল। অনেক সংকটময় পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে আগে। সেই অভিজ্ঞতা বলছে ওদিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। দোতলা থেকে সটান নেমে এল নিচে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে। মহলের পিছনে ঘন জঙ্গল। খালি পা। কাঁকর কাঁটা কাঠের টুকরো পায়ে গেঁথে যাচ্ছে। ওইভাবেই সে মহলের পিছনে লোহার সিঁড়ির কাছে পৌছে গেল। একটু পিছিয়ে সিঁড়িটা ভাল করে দেখতে যেতেই ডান পা হাঁটু অব্দি হুশ করে ডুবে গেল নরম মাটিতে। ভাল করে ঘাস ভূমিতে হাত বুলিয়ে দেখল সেখানে বেশ কিছুটা জুড়ে ঘাস ভূমি। সে বুঝে গেল এই জায়গাটিই সেই চৌবাচ্চা। মাটিতে ঢেকে রয়েছে।

উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। সিঁড়িটা মরচে পড়া কালো, মাঝখানটা মনে হয় ভাঙ্গা। ওটা দিয়ে উপরে চড়লে বিপদ হবে। কিন্তু ওর জিদ চাপল ওটা দিয়ে উঠে ছাদটা দেখতেই হবে। কিছু ঘাস ছিঁড়ে একটা স্বচ্ছ পলিথিন ব্যাগে ভরে সেটা মাথায় পরে নিল। কমসেকম দূর থেকে দেখলে মানুষের মাথা বলে যেন না মনে হয়। লম্বা ঠ্যাং ঝুলিয়ে তর তর করে চেপে গেল সে। ছাদের কার্ণিশে মাথা বাড়িয়ে দেখল খোলা আকাশের নিচে ছায়া ছায়া অনেকগুলো মানুষ। বোঝা গেল দুটো মস্ত বড় মেশিন ফিট করছে। হাতুড়ি চলছে আর নানা ধরনের যন্ত্রপাতি কয়েকটি ছায়া মানুষের হাতে ধরা। কেউ বুঝলো না তার আগমন। নিঃশব্দে সে লোহার গোপন সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে নেমে লম্বা পা বাড়িয়ে দোতালায় উঠে এল। মহলের পিছনে ঘন অন্ধকারে মিশে গেছে তার শরীর। ভারি ব্যাগটা চৌবাচ্চার কাছে ছেড়ে এসেছে। দোতলায় ঘরে ঢুকে দুটো পাইপ গানের পাইপ নিতে গিয়ে কোদালের মতো একটা জিনিস পেয়ে খুব খুশি হল সে। জামাকাপড়গুলো নিয়ে ঘরের ভিতর সদর দরজা দিয়েই বেরিয়ে এল। ত্রিসীমানায় আর কেউ কোথ্থাও নেই। নির্ভাবনায় নিশ্চিন্তে ওরা সবাই ছাদের উপরে ধ্বংসলীলার প্রস্তুতিতে মগ্ন। দুশো বছর আগের পর্যন্ত বিশ্বের সাহিত্য সৃষ্টিকার ও তার সৃষ্টির সংরক্ষনের দায়িত্ব এমন একজন স্মৃতিবিকল মানুষ কাঁধে নিয়েছে যে সে একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধের শেষ বংশধর আর তারই সেই অমূল্য সম্পদের উপরে বসে অবাধ নষ্টকারিতার খেলা চলছে কিছু উগ্র বুদ্ধিহীন হিংস্র মানুষের।

লোকটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ির কাছে এসে ব্যাগটা দেওয়াল ঘেঁষে আড়ালে রাখল। মাথার উপরে বেশ লম্বা চৌড়া একটা বন্ধ জানলার উপরে পুরোনো শেড আছে। এখানে থাকলে উপর থেকে ওরা দেখতে পাবেনা। একটা লোহার পাইপ দিয়ে চৌবাচ্চার নরম মাটি খুঁড়তে শুরু করলো। নরম মাখনের মতন মাটিতে নিঃশব্দে ঢুকে গেল পাইপ। খুবই কম সময়ের মধ্যে অনেকটা জুড়ে আলগা হয়ে গেল মাটি। সময় খুব কম। কখন কি হয় বলা যায় না। কাজটা করে ফেলতেই হবে। পাইপ রেখে কোদাল দিয়ে মাটি তুলে ফেলতে লাগল। কালো পাঁক তাই বুঝি দেখা যাচ্ছে না কি তোলা হচ্ছে কতোটা ফেলা হচ্ছে। ঘামে হাত পিছল হয়ে যাচ্ছে। ডায়াবেটিস রুগী। হাত পা শিথিল হয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু মনের ভিতর চেতন অবচেতন মনে সুপ্ত একটিই কামনা ছিল তা এখন মিটতে চলেছে, তাই একটা উত্সাহ আর আনন্দও বুক ঠেলে উঠছে। বেশি সময় লাগলোনা। একটা বেশ বড়সড় চৌকো মতন গর্ত হয়ে গেল। চৌবাচ্চাতে মনে হয় বালি ভরা ছিল তাই এত সহজেই কাজ হয়ে গেল।

এবার লোকটা ব্যাগ খুলে জিনিষগুলো ঘাসের উপরে রাখলো। অনেকগুলো ছোটো ছোটো পুতুলের মতো আবক্ষ মূর্তি। মূর্তিগুলো বাক মিনষ্টার ফুলেরেন্স নামের এক বিশেষ ধরনের কার্বন পদার্থ দিয়ে তৈরি। এটি পৃথিবীর কঠিনতম পদার্থ। আর একটি চৌকো মতন ফোল্ডিং বড় কার্ড বের করে তার ভাঁজগুলো এমন ভাবে সেট করলো যে সেটা একটা বেশ বড়সড় ট্রাঙ্ক হয়ে গেল। এই বাক্সটাও ওই পদার্থ দিয়ে তৈরি। তরলীকৃত বাক মিনষ্টার ফুলেরেন্স একটি শিশিতে ভরে নিয়ে এসেছিল সে। যেখানে যেখানে জয়েন্ট আছে সেখানে ওই তরলটি ভাল করে লাগিয়ে দিল। এই বাক্স ও মূর্তিগুলো চেষ্টা করলেও ভাঙতে পারবে না কোনো কালের কেউই। লোকটা দেওয়াল ঘেঁষে শেডএর নিচে বসল। তার জামাকাপড় থেকে টাইটা টেনে বার করল। অন্ধকারে সেটা থেকে টর্চের মত আলো বেরচ্ছে। এক একটি মূর্তি তুলে সেই আলোতে মূর্তির গায়ে এনগ্রেভ করা নাম ও জন্মতারিখ পড়ে পড়ে এক একটা ট্রেতে সাজাতে লাগলো। যে মূর্তিগুলির জীবনী ও তাদের বিখ্যাত কীর্তির ব্যপারে বিশদ বিবরণ বেশ কয়েকটি ডায়েরিতে লেখা এবং বিশেষ কয়েকজনের বাঁধানো বইগুলি ও এখানে ব্যাগে ভরে এনেছে, তাঁদের সবারই নামের উচ্চারণ আ দিয়ে।

প্রথমেই যে মূর্তিটি ট্রেতে সাজিয়ে রাখা হল তিনি আলজেরিয়ার ফরাসী সাহিত্যিক আলবেয়ার কামু। তাঁর বিখ্যাত বই দ্য প্লেগ বইটি ট্রাঙ্কএ রাখার জন্য সাজানো হল। তারপর আন্তন চেকভ, আইজ্যাক আসিমভ। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দাড়িওলা মূর্তি আর তাঁর বিখ্যাত বই ফর হুম দি বেল টোলস রাখা হল। আন্দ্রে ব্রেতো, আন্দ্রে এসিম্যান, আন্দ্রেই আমলরিক। প্যারিসের আরাগান লুইস যিনি ডাডাইজম এর জন্য বিখ্যাত, মরক্কোর কবি আহমেদ আল তায়েব আলজ, তুর্কীর লেখক দার্শনিক আলেভ আলাটলি ও তাঁর বিখ্যাত ভবিষ্যতের মানুষদের জন্য বইটি কাবুস (দুঃস্বপ্ন) রাখা হল। আফ্রিকান মহিলা কবি আমা আটা আইডোর কালো মূর্তি যত্ন করে সাজিয়ে রাখা হল। এইভাবে অনেক আফ্রিকান আলবেনিয়ান আফগান আর্জেনটিনাইন আরবিক আমেরিকান ভাষা সমৃদ্ধশালী করেছেন এমন সব লেখক কবি দার্শনিকের মূর্তি ট্রেতে রাখা হল। তারপর লোকটা বাংলা দেশের লেখক কবির মূর্তি ও বইগুলো বার করল। দেখা গেল আ অক্ষর দিয়ে আঠেরোশো থেকে যত সাহিত্যিক পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন তাদের মধ্যে বাংলাদেশী অনেক বেশি। আরসুল হক আনওয়ার পাসা আব্দুল ফজল আব্দুস শাকুর আল মামুদ আখতারুজ্জামান লিয়াস আব্দুল কাদির আবুল ফজল আব্দুল গফ্ফর চৌধুরী এবং অনেক বিখ্যাত লেখক কবি। তারপর আশুতোষ মুখার্জী আশাপূর্ণা দেবী ও আবুল বাশারের মূর্তি ও বিখ্যাত একটি করে বই ওই ট্রাঙ্কএ রাখা হল। এরপর ওড়িয়া কবি আনন্দ শংকর রায় হিন্দী সাহিত্যিক আচার্য রামলোচন শরণ উর্দু কবি আব্দুল কওয়াভি দেশনাভি বিখ্যাত বরেণ্য বৈজ্ঞানিক আবুল কালাম আজাদ কেরলের আনন্দ নীলকণ্ঠন হায়দরাবাদের আনিস জংগ কাশ্মিরী কবি আগা সাহিদ আলী এবং আরো অনেক প্রথম অক্ষর আ নামের সৃজনশীল সাহিত্যকারদের পৃথিবীতে হাজার হাজার বছর ধরে অমর থাকার জন্যে এক অভূতপূর্ব অভাবনীয় পদ্ধতিতে সংরক্ষনের ব্যাবস্থা হল।

গর্তটির ভিতরে বড় বাক্সটি রেখে তাতে মূর্তি সহ ট্রেগুলি বই আর ডায়েরিগুলি যত্ন করে দ্রত সাজিয়ে নিলো সে। চাঁদ উঠেছে। ঘন গাছপালার ফাঁক দিয়ে তার নক্সাকাটা আলো পড়ছে গায়ে। সব রাখা হয়ে গেলে ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটা শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের কলি ওতে যত্ন করে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে স্যালুট করলো। বাক্স বন্ধ করে ঢাকনার চারপাশে আবার লিকুইডটা লাগিয়ে দিল যাতে পোকামাকড় বা জল ঢুকে বইগুলো নষ্ট না করে দেয়। এবার ঝপাঝপ মাটি ফেলে দিয়ে কাজ শেষ করলো। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কিছুক্ষন দম নিল। কান পেতে শুনবার চেষ্টা করলো উপরে ছাদে কি করছে ওরা। খুব সামান্যই খুট খুট আওয়াজ মাঝে মাঝে বিরতি। তার মানে এখনো ওরা উপরেই আছে।

উঠে দাঁড়িয়ে খালি ব্যাগটা তুলতেই মনে পড়ল ওটার ভিতরে দুটো গ্রেনেড রয়েছে। দুহাতে দুটো হ্যাণ্ড গ্রেনেড। খালি গা শুধু জাঙ্গিয়া পরা। লম্বা একটা রোমান চরিত্রের মতো প্রস্তরবত্‍ মূর্তি। কিছুক্ষন ওইভাবেই সে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর গভীর চিন্তায় মগ্ন ধীরে ধীরে তার সমস্ত পোশাক পরে নিলো। উজ্জ্বল চকচকে টাইএর নট বাঁধলো। গ্রেনেডদুটো প্যান্টএর পকেটে ভরে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠল। প্রথমবার উঠতে যেমন দুবার পা পিছলে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল এবার তা হল না। দোতালার কার্ণিশে ভর দিয়ে একটা গ্রেনেডের পিন খুলে ভেণ্টিলেটর দিয়ে গলিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ফটাস করে শব্দ। মাথার কানাওলা টুপিটার যেন পাখা গজাল ! নিজের মনেই সেটা তাকে ছেড়ে উড়ে গেল উপরে ! চোখের উপর কেউ যেন এক বালতি কালো রঙ ঢেলে দিয়েছে। অশ্রু কি? শুভ্র পোশাকে ছড়িয়ে গেল কালো ! এম্নিতেই তো সব হারানোর বেদনা বুক ঠেলে বেরিয়ে আসছে। এই পৃথিবীতে তার বংশ পরম্পরা সমেত ইঁটপাথরের পরিচয়ে পূর্ণচ্ছেদ পড়ল তাহলে। আবার শুরু হল মাথার ভিতর খালি হয়ে যাওয়া প্রচণ্ড যন্ত্রনা। মাথা থেকে সব কথা নিঃশেষ হয়ে গেলে শেষ কাজটা কে করবে? এই অদম্য ইচ্ছায় সে আকাশের দিকে মুখ তুলে আ আ আ আ রবে চিত্কার করে উঠল। তখন সে দেখল ছাদের উপরে প্রচুর আরশোলা উড়ছে। প্রত্যেকের ছয় ছয়টা পায়েই বাঁধা রয়েছে হেভি মর্টার আর মেশিনগান। ওরা পৃথিবীর এমন আদিম পতঙ্গ পৃথিবীর সমস্ত জীব বিধ্বংসী মারণ তেজস্ক্রিয়তায় শেষ হয়ে গেলেও ওরা বেঁচে থাকবে আর পৃথিবীকে পচনের দিকে ঠেলে দিবে। আবার চিত্কার উঠল আ আ আ আ । আবার এঁকেবেঁকে আলোর ফুলঝুরি এসে তার উজ্জ্বল শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবার আর একটা গ্রেনেডের পিন খুলতেই সমস্ত পরিবেশ জুড়ে এক তরুণ সূর্যের লেলিহান শ্বেত শুভ্র শিখা তাকে বরণ করে নিল।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register