Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

গল্পেসল্পে সুবল দত্ত - ১

maro news
গল্পেসল্পে সুবল দত্ত - ১

এক উত্তরাধিকারের সংরক্ষণ কাহিনী

‘বহির্বাস খুলে ফেল্ল মায়া কোথা হইতে আমি কুরু হইতে কর্ণ হইতে আমি কুন্তি হইতে আমি তথা পূব হইতে আমি পশ্চিম হইতে আমি অগ্নি হইতে আমি গরল হইতে আমি আমি আমি আমি ‘(রবীন্দ্র গুহ)

মোষের লম্বা লম্বা ফোঁস গরুর সরসর পেচ্ছাপের আওয়াজ ঘরফিরতি ছাগল পালের সমবেত ব্যা প্রায় এক জনমের পর এসব শুনতে শুনতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভুলেই গেছিল সে এক সাইকেল সওয়ারি। কাঁচা পি ডব্লিউ ডির রাস্তা, তায় আবার মালভূমি। হঠাত্‍ বেদম ঢালু পেয়ে বিষম গতিতে সাইকেল তরতর করে ঢলে গেল নিচে। অনেকটাই ডাউন পথ একদম সব চুপচাপ। মাটিতে সাইকেলের চাকার স্পর্শ ছাড়া বাকি পৃথিবী মৌন। চারপাশে ঘিরে রয়েছে ফ্যাকাশে আঁধার। দিগন্তও জল কাটা রক্তরসের মত রঙ। দিগন্ত ছোঁয়া একটা মধ্যযুগীয় বিধ্বংস দুর্গের মতো কালো পোড়োবাড়ি। পিছনে পারা মুছে যাওয়া ভাঙ্গা একটুকরো আয়নার মতো চাঁদ। মস্ত কানাওলা টুপি পরা সরু বেদম ঢ্যাঙ্গা ডন কিহোতের মতো এক বেমানান সাইকেল চালক। একদম ভৌতিক পরিবেশ। চারপাশ খাঁ খাঁ করছে। ওকে দেখার জন্যে কেউ কোত্থাও নেই। সাইকেল সামলাতে না সামলাতেই হঠাত্‍ আরোও গভীর ঢালান। তরতর করে নেমে গেল সাইকেল। সামনেই একটা নালার মত প্রায় মজা নদী। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ ব্রেকের। কিন্তু ব্রেক বাধা মানেনা। নদীর একেবারে কিনারাতে সে দুপা মাটিতে চেপে হাত ছেড়ে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ল। সাইকেল তার দুপায়ের ফাঁক দিয়ে গলে গিয়ে পড়ল নদীর জলে। নদীর কিনারায় দাঁড়িয়ে ঝুঁকে দেখল নিচে। একটি উদাসী নদী। কোনো উত্সাহ কোনো ব্যাকুলতা নেই তার স্রোতে। দিব্যি নির্বিকার গিলে নিলো তার সাইকেল। কোনো চিহ্নই নেই সাইকেলের। সে শুধু নিজেরই ভাঙ্গা ভাঙ্গা প্রতিবিম্ব দেখতে পেল। পোশাক পরিচ্ছদে বিদেশী কিঞ্চিত ঝুঁকে থাকার দরুন তার টাই অভিকর্ষজ নিয়ম মেনে খাড়া ঝুলে রয়েছে। দামী ফ্লুরোসেন্ট সাদা চওড়া বড় টাই গলায় এঁটে বসে আছে। নদীর জল থেকেও আলো হয়ে তা প্র্তিবিম্বিত হচ্ছে। গলা সরু ও লম্বা বেতের মতো। আধো অন্ধকারে পুরো মানুষটাই ঝকমকে আলো। সে যেন এই মৌন নির্বিকার পরিবেশেও নিজেকে জাহির করতে চায়। পিঠে একটা পেল্লায় বড় ও ভারী সাদা রুকস্যাক। তার ভারে সে ঝুঁকে রয়েছে। সাদা জ্যাকেটের কলার উঁচু করে তুলে এপাশ ওপাশ দেখে নিলো নদী পার করা যায় কি ভাবে। সাইকেল জলে ডুবে আছে। এই ভর সন্ধ্যেবেলায় সেটাকে খোঁজা বোকামি। নদীর পাড় ধরে বাঁদিক বরাবর হাঁটতে লাগল সে। যেমন যেমন তার অসাড় মস্তিষ্কে হালকা হালকা নির্দেশ আসছে,সম্ভবতঃ এপাশেই কোন ডাউন ব্রীজ বা সাঁকো থাকা উচিত ওপারে যাওয়ার জন্য।

নদীর এই বাঁ পাশটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে অনেক নিচে। দূরে নিচু এলোমেলো কবরের মত বস্তির ঘরগুলো। একসময় নানা রকমের কল্প দারিদ্র ও হিংসা বেস্ট সেলার হয়ে তার কলম দিয়ে নামতো। বস্তির টুকরো টুকরো ধোঁয়া আর আগুন দেখে সেগুলোর ছবি এখন দলা পাকিয়ে মাথার ভিতরে ঘুরছে। সে জানে, নদীর ওপারে যাওয়ার জন্যে জাতীয় সড়কের উপর প্রধান সেতুটি জঙ্গিরা উড়িয়ে দিয়েছে। তাই ওপারে যেতে হলে এছাড়া আর কোনো পথ নেই। সারা দেশ দাউ দাউ করে জ্বলছে। কে যে কোথায় আছে তার ঠিকানা নেই। এখন মনে পড়ছে বাংলাদেশ মরক্কো ইথিয়োপিয়া তাঞ্জেনিয়ার দুর্দশাগ্রস্ত চরিত্রগুলো। সব এলোমেলো হয়ে ঘুরছে মাথার ভিতরে। ইতিহাস সাহিত্য সংস্কৃতি দর্শন সব পৃথিবী থেকে লোপাট হয়ে যাবে। কিসের জেহাদ কেন জেহাদ কেউ ঠিক মতো বলতে পারেনা। অসহ্য যন্ত্রনায় মাথা ফেটে পড়তে চাইছে। কিন্তু তবু ঠোঁটের কোণে যন্ত্রনাক্লিষ্ট হাসি ফুটে উঠল। যাক তাহলে, স্মৃতি তার এক যুগ পরে সরব হয়েছে। নদীর পাড় দিয়ে অসম্ভব দুর্গন্ধময় আবর্জনা আর কাদার মাঝে টলমল করে চলতে লাগল সে। তার মনে হল দারিদ্রতা মানে পূতিগন্ধময় নরক। পৃথিবীর চিকন স্বাস্থ্যের উপর দগদগে পুরোনো ঘায়ের মতো দরিদ্র দেশগুলি সব। সেখান থেকেই এস ও এস হয়ে উঠে এসেছে অনুযোগ ও বিদ্রোহ পৃথিবীর তাবত মানুষের করুণা কাড়তে।

চায়ে চোবানো পাউরুটির মতো নরম থকথকে মাটিতে তার শুভ্র গল্ফ শ্যু ডুবে গেল। সেদিকে তার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে ভারী ব্যাগ কাঁধে এগোতে লাগল। যেমন করেই হোক সেখানে ওকে পৌঁছতেই হবে। পাঁকে ভর্তি পায়ের ছপছপ আওয়াজ ছাপিয়ে আরো কিছু ঝপঝপ শব্দ। অনেকগুলো সাপ একসাথে জলে ঝাঁপ দিল। বাঁ দিকের পাড়ে ঢাল। তার ডান দিকে বেশ কিছু সারিবদ্ধ বাবলা গাছের পেরেকের মত শুকনো কাঁটা কাপড় ভেদ করে তার ডান বাহুর মাংস চিরে দিল। সে কিন্তু রোবটের মত নির্বিকার। একটিই নির্দেশ তার মাথায়। একটিই সংকল্প মনে। সে কাজটা যে কোনো মূল্যে করতেই হবে। প্রায় পুরো পৃথিবী পরিক্রমা করে তার আদি জন্মমাটিতে এসেছে, সেই জন্মভূমি তাকে এই কাজে সাহায্য করবে না!

সামনেই নদী মোড় নিয়েছে বাঁয়ে। দূরের কিছুই দেখা যায় না। বাঁক ঘুরতেই একটা উন্মুক্ত ত্রিভুজাকার মোলায়েম ঘাসজমি। পা রাখতেই পা ডুবে গেল ঘাসে। পা তুলে তুলে সে এগিয়ে চলল। হটাত্‍ যেন তার চলন কুণ্ঠাগ্রস্ত ও সাবধানী হয়ে গেল। বেশ কিছুটা দূরে ঘাসের উপরে শুয়ে থাকা এক নগ্নিকা ! ঘাসে আধডোবা তালে তালে উপরে উঠছে বসছে নড়ছে শুয়ে পড়ছে। ধ্বক করে তার ষাঠ বছর অব্দি তলপেটের নিচে পুঁতে রাখা তীক্ষ্ণ ইচ্ছেটা ফোঁস করে উঠল। শরীর বুদ্ধি পরিবেশ ক্ষণিকে কিছুই বুঝতে চাইলো না সে। পাগুলো তার অতীতের সাইবেরিয়ার গারদে ঝলমলে শেকল ভাঙার গান গেয়ে উঠল। অজান্তেই তার শ্লথ গতি চনমনে তেজী বস্তুতঃ লম্বা লম্বা পায়ে উড়ন্ত এমুর মতই নিমেষে পৌঁছে গেল সেখানে। জান্তব আগ্রাসী যৌনক্ষুধা গলা দিয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ করে বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু ভালো করে তাকাতেই ভুল বুঝতে পারলো নিজের। মেয়েটা শুধু একা নয় ঘাস জমিতে আধশোয়া পাঁচটি পুরুষ রয়েছে আর একজন মেয়েটির পিঠের পিছনে সেঁটে রয়েছে যাকে ও দেখতে পাচ্ছিল না। মেয়েটার চোখে যন্ত্রনা ও স্পষ্ট মৃত্যুভয় দেখে তার শরীরে ও মনে পরত পরত রঙ বদল হতে লাগল। ভয়ানক ক্রোধ তারপর ভয় আতঙ্ক ঘৃণা করুণা এবং শেষে আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি। মোশনে আসতেই যাবে, সেসময় ওর প্রায় ছ ফুটিয়া বাঁশের খাঁচার মতো আকার, সেটা থেকে এক বিজাতীয় জান্তব আওয়াজ, আধো আঁধারে উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত সাদা পোশাক, মস্ত বড় মুখঢাকা কানাতওলা টুপি, পিঠে কুঁজের ন্যায় ব্যাগ দেখে লোকগুলো মেয়েটাকে ছেড়ে মার দৌড়। মেয়েটা উপুড় হয়ে নিস্তেজ পড়ে রইলো।

লোকটা অনুশোচনায় অবসন্ন হয়ে উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে পড়ল। অতিরিক্ত উত্তেজনার অবসানে মুখে শক্ত থুতু চিটিয়ে বসে গেছে। শরীরে এতটুকুও শক্তি নেই। হাঁ মুখ করে প্রায় খাবি খেতে খেতে প্যান্টের পকেট থাবড়ে একটা ক্যাডবেরী বার চকলেট আর একটা ছোটো বিয়ার এর ক্যান বার করলো। বাঁ পকেট থেকে একটা ছোটো ওষুধের এমপুল ও একটা ডিসপসেবল সিরিন্জ বার করে সিরিন্জে ওষুধ ভরলো। এক কড়া ডোজের ইনসুলিন নিজের বাঁ হাতে নিয়ে পেটে পুশ করে, চোখ বন্ধ করে নিশ্চিন্তে চকোলেট ও বিয়ার খেতে লাগলো। তারপর হটাত্‍ তার ভয়ানক আ আ আ আ আর্তনাদ। ভুলেই গেল যে এখানে একটা অঘটন ঘটে গেছে।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register