- 3
- 0
রাতের শহর ক্রমশ নিঝুম হচ্ছে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে রুবিনা। রাত বারোটা বেজে গেছে। আজকাল বেশি রাতে ফিরতে ভয় লাগে। গাড়ি ঘোড়া ও কমে যায়। বাড়িতে ড্রপ এর গাড়ি পেতে গেলে এখনো হয়তো আধঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। আগের লটের গাড়ি গুলো বেরিয়ে গেছে, ফিরলে তবেই। নিজের মনেই বসের মুণ্ডপাত করে রুবিনা ---"কাজ না করলেও জ্বালা, করলেও জ্বালাতন! যাবতীয় আমার ঘাড়েই চাপিয়ে দেবে। কিছু বলতে তো জানে ই পারবোনা, আমারই দায় যখন। তাই সুযোগ নিতে কেউ ছাড়ে না।" ----"এই যে ম্যাডাম, নিশ্চয়ই আমার ওপর রেগে আছেন। কোনদিকে বাড়ি আপনার? চলুন আপনাকে ড্রপ করে দেই। আমিই যখন দেরি করিয়েছি, তখন আপনাকে পৌঁছনোর দায়িত্বটা আমারই নেওয়া উচিত।"রুবিনা চমকে দেখে পিছনেই হাসিমুখে নতুন বস রাজীব সাক্সেনা দাঁড়িয়ে। ---"না না স্যার, আপনি কেন কষ্ট করবেন? আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব"--কোন অচেনা মানুষের গাড়িতে একা যেতে যে ভরসা পায় না, সে আর কি করে বলবে! --"অত চিন্তার কিছু নেই, আমি শহরে নতুন হলেও, দেশের হালচাল আমারও জানা আছে। তাই আপনাকে ম্যানেজ করে নিতে হবে না, চুপচাপ এসে বসন্ত গাড়িতে"--বসের ধমকে এবার রুবিনা চুপচাপ গাড়িতে উঠে পড়ে। টুকটাক কথা চলতে থাকে। রুবিনা বসের সাথে কাজের বাইরে কোন কথা আগে কোনদিন বলেনি। মাস ছয়েক এসেছেন ভদ্রলোক, খুবই ভালো মানুষ বলে মনে হল। নিজের মনে ভাবল, মিছিমিছিই ওনাকে দোষারোপ করছিলাম। বাড়ির সামনে নেমে বস কে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ির দরজায় বেল বাজাতে যাবে রুবিনা, হঠাৎই কানে এলো বসের গলা ---"আপনি তো অদ্ভুত মানুষ দেখছি! শুধু ধন্যবাদ দিয়েই রওনা দিলেন। এমন শীতের রাতে এক কাপ কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ তো জানাতেই পারতেন।" রুবিনা অপ্রস্তুত গলায় বলে ---"আরে সরি সরি স্যার, আসুন আসুন! আমার বাড়ির অবস্থা যা--তাই আর কাউকে ডাকতে পারিনা" রুবিনা ঘরে ঢুকেই ফিসফিস করে --"রুনু দি, মা ঘুমিয়ে পড়েছে? স্যার এসেছেন, একটু কফি করে দাওনা" বসার ঘরে কফির কাপে প্রথম চুমুক দিতে দিতেই এক মহিলার গলার আওয়াজ কানে এলো --"খোকা, খোকা এলি? আয় না একটু আমার কাছে"একটু চমকে এদিক ওদিক তাকান রাজীব সাক্সেনা। সন্ত্রস্ত হয়ে রুবিনা ছুটে যায় সেই আওয়াজ লক্ষ্য করে ---"মা, তুমি আবার উঠলে কেন? কেউ আসেনি তোমার খোকা এলে আমি ঠিক তোমাকে উঠিয়ে দেবো। এখন ঘুমাও তো লক্ষ্মী মেয়ের মত" প্রায় বিধ্বস্ত রুবিনাকে একটু ধাতস্থ হতে দিয়ে রাজীব বলেন --"যদি ভরসা করেন, আমাকে একটু এই ব্যাপারে কিছু বলবেন? হয়তো বেশি উৎসাহ দেখিয়ে ফেলছি। টেক ইওর টাইম" ---"স্যার এটাই আমার জীবনের বাস্তব! বাইরের জগতের আমি টার চেয়ে এই আমি র জীবন পুরো অন্যরকম। নি আমার শাশুড়ি মা। জানেন, জীবনের একটা সময় পর্যন্ত খুব আনন্দে কাটিয়েছি। ফিরোজ স্যার আমি দীর্ঘ সময় প্রেমের পর বিয়ে করি। আমার কেউ ছিলনা। তাই ফিরোজের মাকে পেয়ে আমি স্নেহের ছোঁওয়া পেয়েছিলাম। কিন্তু বিধি বাম হলে যা হয়। আচমকা একদিন অ্যাক্সিডেন্টে ফিরোজ আমাদের ছেড়ে চলে যায়। সেদিনও ছিল এমন শীতের রাত----অপেক্ষায় থেকে থেকে শেষে পেয়েছিলাম সেই মর্মান্তিক সংবাদ! সেই থেকে উনি অমন হয়ে গেছেন---এখনো মেনে নিতে পারেননি যে, একমাত্র ছেলেকে হারিয়েছেন!"চোখের জল লুকাতে দুইহাতে মুখ ঢাকে রুবিনা। দরজা পর্যন্ত রাজীবকে এগিয়ে দেয় রুবিনা। ---"আমাদের জীবনটাই এমন--কখন যে কি হয় কেউ বলতে পারে না! আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেকগুণ বেড়ে গেল। এত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে আপনি সামলাচ্ছেন। সান্ত্বনা আমি দেবনা, জানি লড়াইটা আপনার একান্ত নিজের। শুধু এটুকু বলতে পারি, প্রয়োজনে আপনার পাশে থাকতে পারলে ভালো লাগবে। আসি আজকে, একদিন এসে ওনার সাথে আলাপ করে যাব।" ফাঁকা রাস্তা --কুয়াশায় ঝাপসা ল্যাম্পপোস্টের আলো---হালকা শিরশিরে ঠান্ডা--চারিদিকে কেমন একটা গা ছমছমে ভাব ---সবকিছু যেন আজ আবার পুরনো দিনকে বড্ড মনে করাচ্ছে--ঘরের ভেতর থেকে আবার আওয়াজ ভেসে এলো---"খোকা, খোকা এলি?"!!
0 Comments.