সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব - ৩)
গোপনে গড়েছে কত স্বপ্নিল সাঁকো
আমরা গাছের মত নই, পাহাড়ের মত নই, নদীর মত কি? উঁহু আমরা নদীর মতও নই।
ছুটির সাথে নিজেকে আজকাল আর মেলাতে পারিনা। ছুটির চোখে দেখা দুনিয়াটার ভাঙচুরের সাথে সাথে দূর থেকে দেখছি ছুটিকে, স্বপ্নের খেয়ায় দোল খাওয়া এক দশ/এগার বছরের ইশকুল ছাত্রী দু'হাত পাশাপাশি মেলে ধরে পিচঢালাই রাস্তা ছেড়ে চাগাছের ভেতর দিয়ে পথ কেটে কেটে চলেছে। সাথে তার সহপাঠীরা। না, এদের হাতে কোনও ইশকুল ব্যাগ নেই, চাগাছের ঘর্ষণে বইখাতার চেহারা বদলে যাচ্ছে, খুব প্রিয় লালরঙা কলমটার ক্যাপ উড়ে গেল। ছুটি দেখতেই পেল না। তারা তখন চাগাছের গুটিবীজ খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছে। এই বীজের শক্ত খোলা ভাঙলে পর দেখা যাবে এর ভেতর রয়েছে স্বচ্ছ জল। এই জল কোনও রকমেই পান করার নয়, কিন্তু ছুটিরা চুষে জিভে স্বাদ নেবে, যদিও জলের মতই এর কোনও স্বাদ নেই। তারপর ঐ গুটির পাশ ঘেঁষে যখন স্নিগ্ধ সাদা বুকের মাঝখানে হালকা হলুদ পরাগ জড়ানো ফুল ফুটবে তখন তার মিষ্টি মধু-র স্বাদ নেবে তারা। নতুন পৃথিবীর সবকিছু জানা চাই, সব চেখে দেখা চাই।
৷ বাড়িতে ফিরে ছুটি কাঁদে, ঐ লালরঙা কলমের ক্যাপ হারিয়ে যাবার জন্যে। কাঁদে, তবে লুকিয়ে, কেউ জানতে পারে না। বুড়িমিনিকে কোলে নিয়ে চুপি চুপি বলে, আমার কলমটার ক্যাপ হারিয়ে গেছে রে। বাবা কিনে দিয়েছিলেন তুই জানিস? কী সুন্দর মোটা নিব, একটুও কালি লিক করে না, আঙুলে কালি লেগে যায় না। ওরকম কলম আর পাবো না। বুড়িমিনি আরামে চোখ বুজে বলে -ম্যাও! ছুটি বুড়িমিনির মাথায় হালকা চাপড় দিয়ে বলে, ম্যাও কি? তুই বুঝিস আমার কষ্ট? ঐ কলমটা আর পাবো না। বাবা টাউন থেকে এনেছিলেন। এইরকম কলম এই চাবাগানে পাওয়া যাবে ভেবেছিস? একদম নয়। সেই অচিনপুরে পাওয়া যাবে। বাবা কবে আবার অচিনপুরে যাবেন বলতো? বুড়িমিনি বলে - ম্যাও। ছুটি বলে- আগামীমাসের প্রথমে যেতে পারেন না-ও যেতে পারেন। গেলেও বা কি? ঐ কলমটা তো আর আসবে না! বুড়িমিনি বলে -ম্যাও। উঠোনের পেয়ারা গাছটায় কাঠবেড়ালি ছুটোছুটি করছে। ছুটির মনে হল কেন যে কাঠবেড়ালি হলাম না! কাঠবেড়ালির তো কলম হারিয়ে যায়না!
ছুটির পরের কলমটি কেমন হয়েছিল? হ্যাঁ একটা সবুজ কলম এনে দিয়েছিলেন বাবা। কলমের ক্যাপের ডগায় সোনালি ঘের। ঐরকমই মোটা নিব। তবুও সেই মোটা লাল কলমটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে ছুটি। নিবের ডগা একটু বেঁকে গেছে। তবু কলমটার সারাদেহে বড্ড মায়া। ওটা পড়ার টেবিলেই থাকে স্বমহিমায়।
আমি টের পাই আমার সারাদিনের যাপনের সাথে ছুটির এক দুর্লভ সাঁকো তৈরি হয়েছে। দৃশ্যত আমার কাছে কোনও ডাইরি নেই, দৃশ্যত সেই মোটা নিবের লাল কলমটি নেই, কিন্তু সেই কলমটিই কি ছোট ছোট দৃশ্যের রেখাচিত্র এঁকে চলে নিরন্তর? সময়ের পারম্পর্য তাই বজায় থাকে না, যখন যে আসে যারা আসে তাদের কথাই লিখতে থাকে সেই জাদুকলম। সারাদিনের এই একক ও সম্মিলিত যাপনের ফাঁকফোকর দিয়ে কখন এই ডাইরি ও কলম ছোট ছোট রেখাচিত্র এঁকে চলে কে জানে। নিরন্তর গুছিয়ে রাখি গুছিয়ে তুলি।
-ম্যাম আসব?
''আসুন" বলার আগেই আমার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নীল ও সবুজ মেশানো গাঢ় রঙের শাড়ি পরা এক অভিভাবক। চোখে মুখে উৎকন্ঠা।
-গতকাল আপনাকে ফোন করেছিলাম ম্যাম। আমি প্রবালের মা।
আমি সচকিত। সেই অসম্ভব অনুরোধের মুখোমুখি হবার জন্যে মানসিক প্রস্ত্ততি নিই।
-হ্যাঁ। কিন্তু আপনার অনুরোধ রাখতে পারছি না, দুঃখিত।
-ম্যাম প্রবাল বেশ ভালো ছাত্র। আমি জানি ম্যাম আপনি সব পারেন, আপনিই তো দিনক্ষণ স্থির করেছেন, আপনিই ইচ্ছে করলে একমাস এগিয়ে দিতে নাহয় পিছিয়ে দিতে পারবেন। হিসেব করে দেখলাম একমাস এগিয়ে দিলেও চালিয়ে নিতে পারব। আপনি আমার অসুবিধে বুঝতে পারবেন ম্যাম, কারণ আপনিও আমার মতই মেয়ে।
মনে মনে বলছি, যতই 'ই' ("আপনিই") এর ওপর জোর দিন মহাশয়া, আমার তো এক্ষেত্রে হাত পা বাঁধা।।
বুঝিয়ে বললাম - এরকম অনুরোধ করবেন না, কোনও কাজই আমি ইচ্ছেমত করতে পারি না।
মহিলাটি এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলছে - ম্যাম কী কষ্টে যে চলছি তা আপনাকে কী করে বুঝাই?
মহিলাটি এবার হাতজোড় করে।
আমি চোখ বন্ধ করে বলি - আপনি এখন আসুন।
-ছেলেটাকে নিয়ে কত স্বপ্ন ম্যাম। ওর পরীক্ষা দেওয়া কি সম্ভব হবে? ঐ সময়ে যদি ওর বাবা বাইরে আটকে যায়! বড় আশা করে এসেছিলাম আপনার কাছে।
মহিলাটিকে এবার ভালো করে দেখলাম। শীর্ণ চেহারা। হাত শিরাবহুল, চোখের কোলে আঁধার। আমি কথা না বাড়িয়ে মাথা নেড়ে বলি - সম্ভব নয়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে চলে যায়। এটা সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। আমি অধ্যক্ষের পদে রয়েছি। ক্লাস এইটের ছাত্র প্রবাল বেশ ভালো ছাত্র কিন্তু কি আর করা। দুখিরামদের স্থান কাল পাত্রবদল হয়, স্বপ্নেরা যতই সাঁকো তৈরি করুক সবটাই হয় গোপনে, স্থূল বাস্তবের বক্রগতি শুধু দৃশ্যের জন্ম দেয়, যার অসহায় দ্রষ্টা হয়েই থাকতে হয়।
-ম্যাডাম আসব?
মাঝবয়েসি এক অভিভাবক।
-ক্লাস নাইনে এডমিশন হবে?
-এখন? মিড সেশনে তো সম্ভব নয়।
-একটু সাহায্য করেন ম্যাডাম।
-সেশনের শুরুতে আসেননি যে!
-ও একটা ইশকুলে পড়তো। বের করে দিয়েছে।
-কেন?
-অতশত জানি না।
-সে কি? কেন বের করল জানবেন না?
লোকটা সশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রুক্ষভাবে বলে- আমার দোকান খোলা রেখে এসেছি। এতক্ষণে কিছু বিক্রি হত। ছেলের মা আরও পড়াবে, আমার মাথাটা খেয়ে নিচ্ছে একেবারে। কাল থেকে ছেলেটাকে কান ধরে টেনে এনে দোকানে বসাব। গরীবের ঘোড়া রোগ!
আর একটুও না দাঁড়িয়ে লোকটা চলে গেল। অবিনাশ স্যার কোনও কাজে কখন ঢুকেছে লক্ষ করিনি।
বলল - লোকটার কাছাকাছিই দোকান রয়েছে। ছোট দোকান। ছেলেটা ফেল করছে তিনবছর ধরে। খুব রাগ আবার। আপনাকে সত্যিটা বলেনি।
বললাম -ক্রুর সত্যি তো! পাশ কাটানোতেই স্বস্তি।
অবিনাশবাবু কী বুঝল কে জানে! নিজের কাজ সেরে বেরিয়ে গেল।
ক্রমশ
0 Comments.