Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ৩১)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ৩১)

পুপুর ডায়েরি

এখন চারু মার্কেট আর থাকছে না। কিন্তু আমার জ্ঞান ফোটা থেকে বড় হওয়ার অনেক অংশ জুড়ে ঐ জায়গা আর তার মানুষেরা। ছোটো বেলায় অনেক ভজন শিখেছি বাবা মশাইয়ের কাছে। মীরার গান, " তু হামারি প্রাণ, প্রভুজী, তুঁহু হামারি প্রাণ… ", খুব প্রিয় গান ছিল 'বা'-র। এই গানটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। আর এ গান যখনই মনে আসে, তার সাথে ছবি আর অনুভূতিগুলি অনুষঙ্গ হিসেবে এসে যায়। একটা ছোট্ট মেয়ে, ক্লাস সিক্স সেভেন, হাতে ছোটো প্লাস্টিকের বোনা বাজারের ডোরাকাটা ব্যাগ। ওটা মাছের থলি। রবিবার সকাল। চারু মার্কেটের যে অংশে মাছওয়ালা কাকুরা থাকেন সে দিকে চলেছে সে বাবার পিছু পিছু। নালা দিয়ে ওদিকটা ঘেরা। কারণ মাছ মানেই জল। আর আঁশ আর কিছু নোংরা ও। তাই নালানর্দমা টপকে সেদিকে যাওয়া। আঁশটে বিশ্রী গন্ধ, তাই মেয়েটা ওদিকে যেতে পছন্দ করে না। কিন্তু বাবা গেলে সব জায়গায়,বাবার পিছনে ত তাকে যেতেই হবে। তাই সে পিছনে পিছনে চলেছে খারাপ লাগাদের টপকে। সামনে চলা মানুষটির হাতে সবজি ইত্যাদি ভর্তি বড় ব্যাগ। হাফ শার্ট, আর সাদা ধুতি ভাঁজ করে লুংগির মত করে পড়া। তিনি এগোতে এগোতে লোকজন কাটিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছেন পুপু আসছে কিনা। আর গাইছেন, তু হামারি প্রাণ... এক লাইন গাওয়া হলেই বলছেন, এবার তুমি গাও। কাঁচা গলা ভুল করলে গুরু বলছেন না কিছু, খালি আবারও গাইছেন লাইনটা। ফের বলছেন, এবার তুমি। কাছাকাছি সুর মিললেই বলছেন, বাহ। বলে পরের লাইনে যাচ্ছেন। যে বাবা সকাল সাতটায় অফিসে বেরিয়ে যান আর হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে রাত দশটায় ফেরেন রোজ, কতখানি ভালবাসা থাকলে তবে মাছ, তরকারি, পাঁউরুটির সঙ্গে একটা অবোধকে হাজার হাজার বার গেয়ে রোদ মাথায় হাসি মুখে সাথে নিয়ে খুসি হয়ে ঘুরে বেড়ান। তারপরও কি বলতে পারি ঈশ্বরকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে পাইনি কখনও? পুপুর ত ঐখানেই স্বর্গলাভ হয়েছে। স্নেহের ধারায়, সুরের জলে অনর্গল স্নাত হয়ে। আলুর দোকানের কাকুর বাৎসল্য মাখা আদরের হাসি, বাবার সাথে শ্রদ্ধা মাখা বন্ধুত্বের গল্প ব্যাগে বাজার ভরার ফাঁকে ফাঁকে। সবজিকাকুর সিমেন্টের উঁচু বেদির দোকানে, মট করে ডগা ভেঙে ঢ্যাঁড়স কিনতে শিখে। ওল কাকে বলে, আর মোচা কিনলে সাথে নারকেল "মাস্ট" জানতে জানতে। বেগুনকে একটু বুড়ো আঙুলে চেপে দেখতে হয় নরম নাকি, সেও গম্ভীর হয়ে প্র‍্যাকটিস করে। তরকারি শাকের গন্ধের সাথে পরিচয় করে। চারু মার্কেট বাজারের ডান দিকের পাশের দরজার কাছে কপালে লাল টিপ পরা পেটানো চেহারার খোকাদার কাছ থেকে চালের প্যাকেট কাঁধের লম্বা ঝোলানো সাইড ব্যাগে নিতে পারার গর্বে। খুব মস্তানের মত হাবভাব ছিল শক্তপোক্ত চালের দোকানের মানুষটির। কাউকে রেয়াত করত না। কিন্তু বাবা সামনে গিয়ে ভারি গলায়, খোকা, চাল লাগবে যে, বললেই একান্ত সমীহের যে হাসি হাসত, সেটা দেখে বাবার দিকে তাকিয়ে আবার মুগ্ধ হত পুপু। সে সমস্ত ছোট্ট অস্তিত্ব দিয়ে টের পেত ছোটো বড়ো সবার কাছ থেকে বাবা একটি কথাও না বলে সমীহ আদায় করে নেন অনায়াসে। সেই সম্মানের ক্লোক যোদ্ধাদের ঢালের মত ঘিরে থাকতো পুপুকে। সবাই জানতো যে ; সে, সেজদার মেয়ে, বলাইদা আর বৌদির পুপু। এর চারপাশে লক্ষ্মণের গণ্ডীর মত অদৃশ্য আগুনের বৃত্ত আঁকা আছে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register