Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ২৬)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ২৬)

পুপুর ডায়েরি

দার্জিলিং আর বুড়ো আংলা নিউ জল পাই গুড়ি , স্টেশন, তার সংগে চা কফি খাবার, সবাই মিলে গাড়িতে ওঠা হৈ হৈ, তার মধ্যে মাথার পিছনে একটা গলা গুন গুন করে গল্প বলে চলে, “ওই দেখো পুরোনো রেল গাড়ির ইঞ্জিন, প্ল্যাটফর্মের ছাদটা দেখেছ ? ঢেউখেলানো টিনের , যাতে জল বরফ সব গড়িয়ে পড়ে যেতে পারে, তার জন্য।’ সিগনেট প্রেসের বইটা।মলাটে ছাই রঙ ,লাল আর সাদা দিয়ে নকশা।বুড়ো আংলা।কোন ঠাকুর? অবন ঠাকুর, ছবি লেখে। পক্স হয়েছিল মামাবাড়ি গিয়ে।বাড়ীতে বাবার ও হয়েছিল একই সঙ্গে ।মা এসে এসে দেখে যেতেন আমায় তাই।রোজ আসতে পারতেন না।আমি নার্সারি টু।বয়েস চার। গম্ভীর মানুষ। একদিন সন্ধ্যে বেলা মা এনে দিলেন বইটা।তখন একটু সেরে উঠে বসতে পারছি বিছানায়।ভিতরের পাতায় মায়ের হাতের লেখা ডট পেনে। ‘পুপু সোনামা বুড়ি যখ করে কেবল বকরবক দেখতে মিঠে মুমানে টক ইতি মা বাবু।” যথাযোগ্য গাম্ভীর্যের সঙ্গে নিজের নাম লেখা কবিতাটা পড়ে বইটা শুরু করেছিলাম। একটু বেজার হয়েছিল মনটা, ম্যাড়ম্যাড়ে সাদা পাতায় খুদি খুদি কালো লেখা।কোন রঙ নেই, ছবির পাতা নেই। পরে ,অনেক পরে, পড়ে পড়ে প্রায় মুখস্ত যখন, তখন থেকে আজও অবদি সেই বইয়ের রঙ আর ছবি মগজের খাঁজে খাঁজে আঁকা হয়ে রইল। এই পঞ্চাশের কাছাকাছি আসা বয়েসে ও অবাক হয়ে টের পেলাম সেই আশ্চর্য শিল্পীর আঁকা ছবিদের , সময়কে অনায়াসে হার মানিয়ে দেওয়া ম্যাজিক। কার্শিওং, কালিম্পং, লাভা টপকে ঝান্ডীর কাঠের কেবিনের পাশে পাইনের জংগলে, সেই যে তিব্বতের রাস্তায় কাঁপতে কাঁপতে হাঁসেদের দলের সংগে একা একা বাড়ীর জন্যে মন কেমন করা ছেলেটা, আমার সংগে চলল।ভয়ানক ঠান্ডায় গাছের মাথায় তাকে রেখে দিয়ে গেছে কোন রকমে যে হাঁসেরা, তাদের পাখার ঝাপটা, ঠান্ডা অন্ধকার জঙ্গলের ছুরির মত হাওয়া, তার শীতের কাঁপুনি, মন খারাপ, আর তবুও জিতেই যাবার অদম্য জিদ, আমার হাত ধরে রইল প্রত্যেক পাহাড়ী রাস্তার বাঁকে। আমার বাড়ির ছোটরা যে সঙ্গে নেই, তার জন্য মন খারাপ করতে দিল না। আমিও জীবনে প্রথম একা জঙ্গলে খাদের ধারে দাঁড়িয়ে পুরোনো পাহাড়ি অভিজ্ঞতার মোজা, স্নিকার্স, টুপী, গ্লাভসের গরমে আর সাহসে নিজেকে মুড়ে ক্যামেরা হাতে চুপ করে বনের আওয়াজ শুনতে থাকলাম। দেখলাম ঠিক বলেছে রিদয় নামের ছেলেটা। একলা জঙ্গলের কত চুপি চুপি শব্দ। অন্ধকারের গাঢ় চাদর হাল্কা হয়ে এল, চারপাশে কমলা লেবুর কোয়ার মত হাল্কা রেশ, আর সামনের কাঞ্চনজঙ্ঘার কপালে জবাকুসুমসংকাশং এসে একটা আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে একটী লাল টিপ পরিয়ে দিলেন। সে যে কি আশ্চর্য একটা মুহূর্ত। ধীরে ধীরে লজ্জায় রাঙা নতুন কনে বৌটির মত গোলাপী আউটলাইনে আঁকা হল পাহাড়ের গায়ে ঢাকা হিমালয়ের বরফ। গোলাপী আরও গাঢ় হতে হতে , শেষে চোখ ধাঁধানো সাদায় অপরূপ রাজকীয় মহিমায় ঝলমল করে উঠল পাহাড়।আর গাছপালা, পাতা, কুঁড়ি,ছোট্ট শুঁয়োপোকা, পাখিপক্ষী সব্বাই জেগে উঠে রোদকে বলল, এস এস তোমার জন্য বসে আছি, বাঁচলাম। সারা পৃথিবী জুড়ে এই জন্যেই না পুরোনো মানুষেরা সূর্যকে এত খাতির করেছে দেবতা বলে।প্রাণ যে সূর্য ছাড়া বাঁচেই না। সেই রিদয়, সে রইল সংগে। টয় ট্রেনের পুরোনো কয়লার ইঞ্জিন, তাতে খালাসি বেলচা দিয়ে কয়লা দেয়। ধোঁয়া ওঠে সামনে চাকা্র আওয়াজের সাথে সাথে। টুং সোনাদা ঘুম…সেই রিদয়ের রাস্তাটা খুঁজি । দেখতে পাই উলের ছেঁড়া মোজাকে সোয়েটার বানিয়ে ট্রেনের ছাদে ঠাণ্ডায় কেঁপে দুলতে দুলতে চলেছে ছোট্ট ছেলেটা।সঙ্গে চলেছে বাবা মা গরম বাড়ীর জন্য মন কেমন, আবার অ্যাডভেঞ্চারের জোশ। হিমালয়ের কুয়াশা, ঠান্ডা ,পাহাড়ি পাকদন্ডী,পাইনের জঙ্গলের গন্ধ, ভাললাগা…লাল গালের ভুটিয়ারা, মিষ্টি ইস্কুল যাওয়া বাচ্ছারা, কেক লজেন্সের দোকান…বাতাসিয়া , বাতাস জোর …বলে ওঠে সাথি হাঁসেরা… মনের মধ্যে উড়ন্ত হাঁসের সারির মতই কে যেন একা পাড়ি দিতে গা ভাসায়। কোথায় পড়ে থাকে চেনা কলকাতা, গেরস্থালি, শহুরে চালচলন, লৌকিকতা । অচেনা হয়ে যাওয়া মন, ডানা মেলে মানসযাত্রী হংস হয়ে, বলে: চলে চলো, অন্য কোথা ,অন্য কোনোখানে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register