Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ২০)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ২০)

পুপুর ডায়েরি

সুর আর গানের ও, শুরু তো, সেই পু-দাদাদের বাড়ি থেকে। সেই যে পু-দার বাবার নাম চঞ্চলবাবু। তিনিই আমার জ্ঞানে দেখা প্রথম বাড়িওয়ালা। ছোটখাটো গড়নের, খুব ফর্সা কাঁচুমাঁচু মানুষ। আর তাঁর বৌ ভীষণ রোগা, কিনকিনে গলার আওয়াজ।তিনি চোখের মত টানা টানা ফ্রেমের চশমা পরতেন। তখন মাইকে কেবলি বাজত “তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি। মা—গো ভাবনা কেন---” সেই শুনে শুনে শিখে ফেললাম। আমার একমাত্র বন্ধু “বা” মানে আমার বাবা আর আমি মিলে খুব গাইতাম এ গানটা কিছু দিন। "বাবামশাই", এ শব্দটা একটা স্ট্যান্ডিং জোক ছিল আমাদের। ------ দেখো, রবীন্দ্রনাথএর আমল হলে, আমায় তোমার বাবামশাই বলে ডাকতে হত।আমি ছোট করে বলতাম, মা আর ' বা' । ক্লাস থ্রিতে পড়ি।এক দিন বিকেলে, বাবা বললেন ডায়রি আছে না? বললাম, হ্যাঁ তো। - নিয়ে এসো। যত্ন করে বানান ঠিক করে দিয়ে ডিক্টেশান দিয়ে লেখালেন : দিলওয়ালে দিল গির হুয়া ক্যা শোচ রহা হ্য তু সুখ অউর দুখ কো সমঝ বরাবর, তু ধীরজ ধর সাধু কিয়ুঁ শোচ রহা ক্যা শোচ রহা হ্য তু? খোটি দুনিয়া ভালে বুরে কি কর না সকে পহছান জ্ঞানবান পর কীচ উছালে মূরখ কো দে মান তু অপমান কো মান সমঝ কর পোঁছ ডাল আঁসু কিয়ুঁ শোচ রহা, ক্যা শোচ রহা হ্য তু? হাসিখুশি অউর রোনাধোনা জগ কে ঝুটে খেল তন মন নে যো বসা হ্য সব সে বড়া তো উসিসে মেল মন পর পা কাবু সাধু, মন পর পা কাবু........... ভুলে যাবার উপায় ছিল না।কখনো লোড শেডিং হলেই বাবা শুনতে চাইতেন গানটা। সুর কথা যেখানে ভুলে গেছি সঙ্গে গেয়ে দিতেন। এমন গুরু অনেক সৌভাগ্য করে পেয়েছি, যিনি কখনোই বকেননি। ৩৬ বছর বয়েস অব্ধি অভ্যেস করা গান কবিতাদের ভোলার উপায় নেই। ২০০৪ এ বাবা কে আর হাতের কাছে পাচ্ছি না,জীবনের নানা ওঠাপড়ায় তেতো লাগছে, ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে চোখ বুজে নেহাৎ অভ্যাসেই গুনগুন করছি গান। ভাবছি পাকাবু কি কোন উর্দু বা ফারসি কথা? সাধু কে পাকাপোক্ত হতে বলেছে? তখন লেখাটা ভেসে উঠল চোখে। আরে, পা কাবু.....মনের ওপর লাগাম কষতে বলেছে। চোখ খুলে উঠে বসলাম। বুঝলাম কেন বাবামশাই ক্লাস থ্রির ক্ষুদে পুপুর হাতে গুপ্তধনএর ম্যাপ দিয়ে গেছেন। তিনি জীবনকে চিনতেন। জানতেন পুপুর একদিন একা ঘরের কোনে এই সম্পদের দরকার হবে। সেই মদালসার গল্পের মতো। মহারানী, আদতে তপস্বিনী মদালসা ছেলেদের দোলায় দোল দিতে দিতে দর্শনের পাঠ দিতেন। তাদের জ্ঞান ফুটতেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য তপস্যা করতে চলে যেত। তিন নম্বর বারে রাজা প্রিয়সাথীকে আটকালেন। -- তোমায় বুকের করে তপস্যা থেকে তুলে নিয়ে এসেছি। তুমি আবার সন্তানদের সেই সাধনায় পাঠিয়ে দিচ্ছো। আমার এত বড় রাজ্যের উত্তরাধিকার কাকে দিয়ে যাবো। রানী বললেন, বেশ। এই ছেলে যুবরাজ হবে। একে রাজধর্মের পাঠ দিলাম। কিন্তু মা বাণপ্রস্থ নেবার আগে ছেলের হাতে বেঁধে দিয়ে গেলেন কবচ। বলে গেলেন, যেদিন মনে হবে জীবনে আর কোন আনন্দ বাকি নেই, এই কবচ খুলে দেখো। বহু বছর সুশাসক হয়ে রাজত্ব করে, শেষে রাজা দেখলেন কাছের মানুষ স্বজন শক্তির লোভে বিত্তের লোভে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। যুদ্ধের মাঝে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে গভীর জঙ্গলে বসে মন পড়লো মায়ের কণ্ঠস্বর। কবচখানি খুলে দেখলেন, লেখা আছে চারপাশের বস্তুবাদী জীবন কত অসার। এ ধাক্কায় সমস্ত জীবনের ভার খুলে রেখে, নিজেকে খুঁজতে, অনন্তকে খুঁজতে তপস্যায় চলে গেলেন সম্রাট। সেই রকমই মহাসম্পদ পাবার সৌভাগ্য হয়েছিল শিশুকালে। বাবামশাই, আমার সকল পাঠের মহাগুরু, তুমি আমায় আচার্যের পায়েও পৌঁছে দিয়েছ, আবার মহাশ্মশানে পাশে দাঁড় করিয়ে দেখিয়ে দিয়েছ পঞ্চভূত কেমন সহজ সুন্দর ভাবে মিলিয়ে যায় নিজের নিজের জায়গায়। আর ২৬ মে ২০০৪ এর সন্ধ্যায় আলতো একটি শান্ত দীর্ঘশ্বাসে নিজের বিছানায় শুয়ে শিখিয়ে গেছো,... ---- কেন রে এই দুয়ার টুকু পার হতে সংশয় জয় অজানার জয়.... আমি যে তোমার ঘাড়ে চড়ে থাকা, কোলে বসে থাকা, একসাথে ট্যাং ট্যাং করে ঘুরে বেড়ানো মানুপুপু হবার সৌভাগ্য পেয়েছি, তার জন্যেই জীবনের পায়ে লুটিয়ে প্রণাম করি। যত রাগ, তাল, ছন্দ, ভারতীয় শাস্ত্র ব্যাকরণ অনুযায়ী শিখেছি , বাবা একটাও চ্যাপটার , কখনো মুখে বলে শেখাতেন না। সবই গান হয়ে কান থেকে প্রানে চলে আসতো। আর তার সঙ্গে জলের ধারার মত অনায়াসে বয়ে আসত জীবন দর্শন। ... প্রেমে যে জল হয়ে গলে যেতে হবে,আর প্রেমধন মায়ের মতন, দুঃখী সুতেই অধিক যতন,সেও শুনি।আবার এইযে পাতায় আলো নাচে,তাকেই বলে প্রেম,সেও শুনি। সেই যে প্রেমের পাগলপনা,তারি কিছু টুকরো, অবাক হয়ে দেখি, এই পঞ্চাশ ছোঁয়া বয়েসে, বাচিক শিল্পীদের প্রিয় হয়ে উঠেছে। "আড্ডা এবং" এর আড্ডায় আমার প্রিয় শিল্পী শর্মিষ্ঠা পালের মুখে কি মিষ্টি হয়ে বাজছে।সে ত শুরুই করল অনুষ্ঠান আমার লেখা শব্দ দিয়ে।বুঝলাম প্রেম তরুণ তুর্কীদের পছন্দ হয়েছে। ইদানীং, সপ্তর্ষি প্রকাশন পঞ্চাশে প্রেম বইয়ের জনপ্রিয়তার কথা বলতে মনে হল, তবে প্রেমই জিন্দাবাদ। সব মিলিয়ে প্রেমে থই থই চারদিক। তাই তর্পণ করতে আঁজলা ভরা অক্ষর আর প্রেম নিয়ে বসলাম। দুই প্রেমিক শিল্পী মানুষ, বাবা আর মাকে বললাম, এইই দিলাম। আর ত কিছু পকেটে নাই।   খুদিগর্জি থেকে বে-খুদি তে পৌঁছে দেয় যে ভালবাসা,তাকেই বুঝি খুদা নামে ডাকে, এই বোধটুকু খালি কুড়িয়ে পেয়েছি। খুদ মানেই সেই তো? আমার প্রানের গভীর গোপন মহা আপন...... তাই সব সময় ঘুরে আসে সুর, তুঝ মে রব দিখতা হ্য,ইয়ারা ম্য ক্যা করুঁ? প্রেমের ঢেউয়ে পাগল দুটি মানুষ, শ্রীরামকৃষ্ণ আর সারদা দেবীর পায়ের কাছে পৌঁছেছিলাম সাড়ে সতেরো বছরের প্রেমে। অগ্নি এবং তাঁর রামকৃষ্ণগতপ্রাণা দাহিকা শক্তিকে আবারো থ্যাংকইউ বললাম। তাঁরা না থাকলে আমার ভালবাসার লন্ঠনকে জ্বালিয়ে রাখতো কে? সেই যে ছোট্ট বেলায় হো হো করে গান গাইতে শিখেছি, "আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায় বিলায় ও কে? সে সুধা ছড়িয়ে গেলো লোকে লোকে....."
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register