Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব - ৩)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব - ৩)

কেদার

"কলেবরং পরশুভিশ্চিত্ত্বা তত্তে ব্রজৌকসঃ। দূরে ক্ষিপ্তাবয়বশো ন্যদহন্ কাষ্ঠবেষ্ঠিতম্ ।।"শ্রীমদ্ভাগবতম/স্কন্ধ ১০/অধ্যায় ৬/ ৩৩// (ব্রজবাসীরা পুতনার বিশাল দেহ খণ্ড খণ্ড করে কেটে আলাদা কাঠে রেখে জ্বালিয়ে দূরে নিক্ষেপ করছিল।)

বড় হলঘরটার এক কোণে টুলের ওপর আলো ফেলা হয়েছে। স্কেচশিট ইজেলবোর্ডে রেখে চারকোল দিয়ে আঁকছিল কৃষ্ণেন্দু। টুলের উপর বসা মহিলাটি সামান্য ঝুঁকে রয়েছেন সামনে। এই ঝুঁকে যাবার ফলে তার স্তন সামান্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠছিল। সেই প্রবণতা তিনি সুদক্ষভাবে তাঁর বাম হাতের কনুই দিয়ে সংযত করেছেন। তার হাঁটু মুড়ে বসেছেন টুলের উপর। তাঁর নিটোল নগ্ন উরুসন্ধিতে আলো আঁধারি একস্দ্ভুত রহস্যময় লাইট অ্যাণ্ড শেড তৈরি করেছে। মহিলাটিকে কৃষ্ণেন্দু এই গেল কয়েক সপ্তাহের ওয়ার্কশপে চিনেছে। ওনার নাম অতসীদি। পদবী জানে না কেউ।সকলে অতসীদিই বলে। দীর্ঘ ছয় বছর এই আর্ট কলেজে অতসীদি ন্যুড স্টাডির মডেল হচ্ছেন। প্রথম যেদিন এই ক্লাসে কৃষ্ণেন্দু ছবি আঁকতে বসেছিল, তার হাতে আঙুল উত্তেজনায় কাঁপছিল। এমন উন্মুক্ত নগ্নতা সে আগে কখনও দেখেনি। গোকুলঘরিয়ার পুকুরঘাটে আলুথালু বেশে স্নানরতা নারীশরীরের ভিতর সে কখনও নগ্নতা খোঁজেনি। কারণ সেই নারীপুরুষের ভীড়ের ভিতর তার মা অলোকানন্দাও ছিল। বরং কৃষ্ণেন্দুর জীবনে নগ্নতা অনেক বেশি করে আরক্ত করেছিল গোকুলঘরিয়ার 'শ্রীরামকৃষ্ণ পাঠাগার'। সেইখানে বিকেলে স্কুলফেরত সে পড়তে শুরু করে সমরেশ বসুর 'দেখি নাই ফিরে'। বালক রামকিঙ্করের চোখে দেখা সেই অভূতপূর্ব বর্ণনা।বইয়ের পাতায় পাতায় সেই পূর্বগামিনী গন্ধেশ্বরীর উত্তরের বালুচরে কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে পরিচয় হয় নগ্নতার। আদুরে গা ভিজে টপটপ করে জল চুঁইয়ে পড়ছে নীচে। আকাশের রক্তাভ ছটায় ওদের মেদহীন নাভিস্থল, উদ্ধত নম্র বুক, ক্ষীণ কটি, গুরু নিতম্ব কৃষ্ণেন্দুকে রঙ চেনাত। ভারি সুন্দর লিখেছিলেন কথক।'কঠিন শ্রম দিয়ে গড়া ওদের শরীর। শ্রমই দিয়েছে লালিত্য। দিয়েছে ঔদ্ধত্যের শ্রী।'পড়তে পড়তে কৃষ্ণেন্দুর মনে হতো ঠিকই বলেছিলেন রামকিঙ্কর। প্রকৃতির প্রতিটি অনুভূতি, আরক্তভাবের ভিতর কোথাও না কোথাও কোনও না কোনও রঙ নিবিষ্ট হয়ে আছে। সেই রঙ গন্ধেশ্বরীর উপতটে মানসচক্ষুতে দেখা বোনো শালুকের পাতায় দেখতে পেয়েছিল কৃষ্ণেন্দু। সেই রঙ গোকুলঘরিয়ার ঘাটজুড়ে নেই কোথাও। তারপর বহু বছর পর একদিন পড়ানোর সময় বেনভেন্টো সেলিনির কথা বললেন সুদাম স্যার। সেলিনির কথা অনুযায়ী মানুষের দেহই হল পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত 'ফর্ম'। সেলিনির কথা বলতে বলতে সুদামস্যার সেদিন ক্লাসে পড়াতে পড়াতে হঠাৎই চলে গিয়েছিলেন বৈষ্ণব দেহতত্ত্বে। -নগ্ন মডেলের সঙ্গে শিল্পীর মিলন আবশ্যিক। মিলন নাহলে নগ্নতা নগ্নতা থেকে যায়। তার ভিতর পূজার্চনার বিভা ফুটে ওঠে না। কিন্তু সে মিলন কেমন? কৃষ্ণেন্দু জার্নালে পড়েছিল পাবলো পিকাসোর কথা। শিশুর মতো ছবি আঁকতে আঁকতে পিকাসো নাকি তার আটজন ন্যুড মডেলের সঙ্গেই সম্ভোগ করেছিলেন। তেমন সম্ভোগ কি আবশ্যিক?সেদিন সুদামস্যার বলছিলেন। -সে সম্ভোগ ক্ষণিকের। শিল্পীর মিলন হবে রাধারাণীর বিপ্রলব্ধ শৃঙ্গারের মতো ।সেখানে পূর্বরাগ সাদা ক্যানভাসে আউটলাইনিং বা লে আউট। মান প্রাথমিক গ্রাফাইট বা চারকোলের স্কেচ। প্রেমবৈচিত্র্য রঙ বা আলোছায়া। আর মাথুর হলো ফিনিশিং।

কৃষ্ণেন্দু এই শব্দগুলো ভাসাভাসা শুনেছিল মায়ের কাছে। গ্রামের অদ্বৈত গোঁসাই আর শচীমাতা নাকি এসব বলে। কে জানে আর্ট কলেজের রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সুদাম গোস্বামীও আসলে মনে মনে বিষ্ণুউপাসক কিনা! কিন্তু সেইদিনকার ক্লাসের পর অতসীদির নগ্নতা আঁকতে গিয়ে কৃষ্ণেন্দুর হাত আর কাঁপেনি। -কী রে? কতো দূর। দুই হাত দূরে ইজেলের আড়াল থেকে কৃষ্ণেন্দুর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সহেলী। তার আঁকা প্রায় শেষ। আঁকায় বেশি রেখা ব্যবহার করে না সে। অন্যদিকে কৃষ্ণেন্দুর পছন্দ ডিটেলিং। অতসীদির পিঠ বেয়ে উরু বেয়ে যে ঘামের রেখা ফুটে উঠছে, সেটা সে তার স্মাজ পেনসিল দিয়ে ধরতে চাইছিল। -এই তো। আর একটু। -জলদি কর।এখন না বের হলে ছটা আঠাশ পাবো না কিন্তু। কৃষ্ণেন্দুদের ক্লাসে মোট বারুজন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে শ্রাবন্তী সবচেয়ে ভালো আঁকে। দ্রুতও। এইটুকু সময়ে সে তার ছবিতে ফিগারের স্তনের নিচের পাঁজরের রেখা, চুলের আড়ালে ঢেকে যাওয়া চোখে লুকিয়ে থাকা সামান্য উৎকণ্ঠা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে। সেইসব দেখে সুদামস্যার বলল,"সবাই দেখ। এটাই হচ্ছে পেইন্টিং। ছবি কথা বলবে তোমার সঙ্গে। " ক্লাস শেষ হলে অতসীদি পাশে ভাঁজ করে রাখা একটা সাদা চাদর জরিয়ে উঠে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে তার গালে গোলাপী আভা ফুটে ওঠে। কৃষ্ণেন্দু প্রতিদিন এইসময়টুকু বিভোর হয়ে দেখে তাঁকে। সে দৃশ্য অবশ্য সহেলীর নজর এড়ায় না।শিয়ালদা স্টেশনের নয়ের এ প্ল্যাটফর্মের দিকে যেতে যেতে সহেলী জোরে কৃষ্ণেন্দুর বাম হাতে চিমটি কেটে দিল। -খুব মজা?না তোদের পুরুষমানুষদের? -কেন? আবার কী হলো? -শরীর মানেই তো শুধু নারী।তাই তো?রোজ তোরা অতোগুলো ধেড়ে ধেড়ে ছেলে অতসীদির শরীরটাকে গিলে গিলে খাস। বেশ মজা পাস। তাই না? -কেন? তোরা আঁকিস না বুঝি?এতে মজার কী আছে? এটা তো স্টাডি। সিলেবাসে আছে। -শুধু মেয়েমানুষের শরীর নিয়েই সিলেবাস? তিন নম্বর কামরাটায় পিঁপড়ে গলার জায়গা নেই। কৃষ্ণেন্দু আর সহেলী চার নম্বর বগিতে কোনওরকমে উঠে পড়ল।

নতুন গ্রাম আসতে এখনও ঘন্টা দেড়েক। দরজার পাশে ধাতব ঝাঝরির উপর পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সহেলী। তাকে আগলে দাঁড়িয়ে ছিল কৃষ্ণেন্দু। ট্রেন চলতে শুরু করলেও ভিতরে বাতাস আসছে না তেমন। কৃষ্ণেন্দুর এই ঘর্মাক্ত ঘন্ধটা যেন মায়াধরানো। সহেলী দেখছিল একমনে। পুরুষ্টু পেকটোরালিস মিলিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণেন্দুর আলুথালু টিশার্টের বোতামের নীচে। দুই হাতের বাইসেপস আধফোটা রজনীগন্ধার তোড়ার মতো আগলে রেখেছে তাকে। ভাবতে ভাবতে আরক্ত হয়ে লজ্জায় চোখ বন্ধ করল সে। -কী? -কী কী? -পারবি আঁকতে? -কী আঁকতে? -আনতোনেলা দে মেসিনার মতো সেন্ট সেবাস্তিয়ান আঁকতে? -সেন্ট সেবাস্তিয়ান কে হবে শুনি? -আমি হলে? -অতসীদির মতো? -জো হুজুর। সবাই দেখবে কিন্তু। -না। -কী না? -সবাই দেখবে না। শুধু আমি দেখব। -পিকাসোর মতো করবিনে তো? -টিপিকাল গাই অ্যাটিটিউট। করলেও তো আর কি। -না। সত্যিই বলছি।আঁকবি আমায়। নতুনগ্রামে নেমে পড়ল কৃষ্ণেন্দু। আজ গোকুলঘরিয়া ফিরতে কেন জানি মন করছে না। কিন্তু উপায় নেই। একসঙ্গে দেখলে সহেলীর বাবা সনাতনকাকার কাছে খবর চলে যাবে। আধা ঘণ্টা পরে পরের ট্রেন। মার কথা একবার ভেবেই অভিমানে সেই দৃশ্য সরিয়ে দিল কৃষ্ণেন্দু। -আমি তোকে আঁকতে চাই কৃষ্ণেন্দু। নগ্ন। -বেশ। আঁকিস। -তুইও আঁকবি আমাকে। বল। -আঁকব। স্টেশনে ফুটকরাইয়ের দোকানে দশ টাকার ছোলাভাজা খেতে খেতে হঠাৎ কৃষ্ণেন্দু বলল। -আমার শরীরের সঙ্গে আমার গলায় বাম পায়ে বিদ্ধ হয়ে থাকা তিরগুলোকেও ভালো করে আঁকিস সহেলী। -কেন এমন বলছিস কৃষ্ণেন্দু? -সেন্ট সেবাস্তিয়ান দেখেছিস সহেলী? -না। দেখিনি তো। -আজ ঘরে গিয়ে দেখিস। আমার জন্য আরও কয়েকটা বিষতির রেখে দিস আলাদা করে। যন্ত্রণা কমবে। সহেলী বলে না কিছু। বাবা নেই কৃষ্ণেন্দুর। সে জানে সে কথা। ওর জীবন তার নিজের জীবনের মতো সরলরেখায় আঁকা নয়। হঠাৎ খুব জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছিল তার,"তুমি কিচ্ছু ভেবো না কে কৃষ্ণেন্দু। আমি আছি তো। তোমার সব বিষতির বুক পেতে সয়ে নেব আমি।"কিন্তু বাস্তবে তা সে বলতে পারল না। শুধু বলল। -চল। কাল দেখা হবে। ঘোষণা হয়ে গেছে। ট্রেন ঢুকছে তোর। সহেলী চলে যেতেই বিপ্রলব্ধ রাধার মতো কৃষ্ণেন্দু প্ল্যাটফর্মের প্রান্তে জ্বলে থাকা লাল সিগনালটার দিকে তাকিয়ে রইল।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register