Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব - ৩০)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব - ৩০)

গোপনে গড়েছে কত স্বপ্নিল সাঁকো

জ্ঞানীরা বলছেন বর্তমানে বাঁচো। সময় বলছে বর্তমানে বাঁচো। কিন্তু আমি দেখছি বর্তমানটা এক বৃহদাকার যন্ত্র। যদি বলি বিশ্বকর্মাই এখন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেবতা? হ্যাঁ, হয়তো তাই। সমস্ত পৃথিবীটা একটা প্রতিযোগিতার বাজার। এক বিশাল পণ্যবাহী জাহাজ চলেছে। এই পণ্যবাহী জাহাজে যে যেখানে পারছে নিজেকে গুঁজে দিচ্ছে। যে পারল সে জিতে গেল। যে পারল না সে গেল হেরে। এই হারজিতের খেলায় অংশ নিতে আমি অহরহ ছুটছি, ছুটছি ছুটছি। কেন ছুটছি আমি? কীসের কেন? ছুটতে যে হবে! জাহাজে নিজেকে গুঁজে দিতে হবে যে!৷ তারপর? তারপর আর কি? না না কোন কেন নয়। শুধু ছুটো। ব্যস। প্রশ্ন করো না।

ইশকুল প্রধানদের মিটিং বসেছে। উপরওলা বলছেন সরকারি ইশকুলের রেজাল্ট ভালো হচ্ছে না কেন? কেন বেসরকারি ইশকুলের রেজাল্ট সরকারি ইশকুলকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে? এই পরিস্থিতি দিন দিন চললে আখেরে কী হবে সেটা কেউ কল্পনাও করতে পারছে না। সময়, সময়। সময় কথা বলবে।

এদিকে রাজুর বাবার খুব অসুখ। রাজুর ইশকুলে ষান্মাসিক পরীক্ষা। রাজুর মা আরতি সকাল থেকে রাজুর বাবাকে বকছে। প্রতিবার নাকি পরীক্ষার আগে রাজুর বাবা অসুখ বাধায়। এটা যেন একধরনের ষড়যন্ত্র। ছেলেকে না পড়িয়ে ঘরামির কাজে লাগিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র। নিজের এসিট্যান্ট বানাতে চায়। মা বকবক করে, পড়তে মন আসে না রাজুর। রাজুর বাবা কোঁকাতে কোঁকাতে বলে - অসুখ কি হতে পারে না? রাজু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে - বাবার কী হয়েছে মা? জ্বর তো নেই। গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম। রাজুর বাবা অসুখ লুকিয়ে রাখে। লুকিয়ে হোমিওপ্যাথি ওষুধ খায়। ওষুধের বড্ড দাম। মেডিক্যাল এ গেল দু'বার। অনেক পরীক্ষা দিয়েছে করাতে। করানো হয়নি। আরতি সব জানে, তবু বকুনি দিতেই থাকে। রাজুর পড়া হল না বিলকুল। মা-র চেঁচামেচি, বাবার কোঁকানো এভাবে কি পড়া হয়? আজ সোস্যাল সায়েন্স পরীক্ষা।

পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। রাজুর মা এসে আমার সাথে দেখা করল। -বুঝলেন ম্যাম, প্রতিবছর আপনি পরীক্ষা ফেলেন যখন রাজুর বাবার অসুখ। আমি এদের কথাবার্তায় মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এদের ব্যক্তিগত কষ্ট আমার ওপর উগড়ে দেয়। আরেকবার এক গর্ভবতী মহিলার পরীক্ষা পিছিয়ে দেবার কাতর অনুরোধ মনে পড়ে গেল। কিছু না বলে আমি রাজুর মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। -কাল রাত থেকে কিচ্ছু পড়া হয়নি। লোকটা থেকে থেকে কোঁকাচ্ছে। এভাবে হয়? সোস্যাল সায়েন্স সোজা বিষয় নয়। আমিও ক্লাস নাইন অব্দি পড়েছি ম্যাম। স্যার ম্যামদের বলে আপনি পাশ করিয়ে দেবেন। এমন ভঙ্গিমা যে আমি হাঁ হয়ে গেলাম। -যাই ম্যাম। একবার পরীক্ষা হলে রাজুকে খুঁজতে হলো। ক্লাশ এইট। সেকসন বি। একেবারে পেছনের বেঞ্চে বসে সামনের ছেলেটির পিঠে কলমের খোঁচা দিয়ে কি যেন জিজ্ঞেস করছিল। -এখানে রাজু মানে রাজেশ কে? রাজু দাঁড়িয়ে বলল - আমি। পরীক্ষার পর আমার সঙ্গে দেখা করো। রাজুর মুখ শুকিয়ে গেল। বলল - না ম্যাম, আমি কিছু করিনি। -তুমি দেখা করে যাবে।

আমার কোনও বাজে খাতা নেই। আজকাল আর কি মনের কথা লিখি? সময় কোথায়? মাঝে মাঝে কোত্থেকে কে জানে বাউল বাতাস এসে বুকের ভেতর আছড়ে পড়ে। তখন কবিতা আসে। ছুটির হিজিবিজির খাতা আর খেয়ালি জগতটা কখন কবে যে ছুটি নিল নিজেই বুঝতে পারলাম না।

রাজু এলো। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে। কাছে ডাকলাম। বললাম -ভয় নেই। এসো। সে একপা একপা করে এগিয়ে এলো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করলাম - কেমন হয়েছে পরীক্ষা? ছেলেটি কাঁদো কাঁদো। বলল - কিচ্ছু লিখতে পারিনি ম্যাম। ঘরে পড়াশুনা করার মত অবস্থাই নেই। বাবার অনেকদিন থেকেই অসুখ। মা-র খুব ইচ্ছে আমি মাধ্যমিক পাশ করি। তারপর উচ্চ মাধ্যমিক। কিন্তু সেটা হবে না ম্যাম। - অত চিন্তা করো না। তোমার মা কিছু করে? - রান্নার কাজ করে।

ইশকুল থেকে ফিরছি। পথেঘাটে বিকেল নেমেছে। দেখলাম রাজুর মা হন্যে হয়ে ছুটছে, সাথে রাজু। কিছুসময় দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখলাম ওরা দুজনে অটো থামাল। উঠল।

পরদিন ক্লাস এইটের অঙ্ক পরীক্ষা। খোঁজ নিয়ে জানলাম রাজু আসেনি। জিজ্ঞেস করে জানলাম গতকাল রাতে রাজুর বাবা মারা গেছে। মনে পড়ল দুটি ভীরু চোখ, কী অসহায়, কী অবোধ। শুধু দেখে যাওয়া, শুধু শুনে যাওয়া, আর শুধু বয়ে যাওয়া। রবীন্দ্রনাথ এই আমাদের জন্যেই কি বলে গেলেন " শুধু যাওয়া আসা / শুধু স্রোতে ভাসা.." নিজে তো স্রোতে ভাসলেন না মোটেই। ঝপ করে আমার সামনে এসে গাড়ি ব্রেক কষল। -কি হলো? দেখে পথ চলুন। এমনভাবে রাস্তা পেরোচ্ছেন যেন রাস্তায় আপনিই একা। এক্ষুনি হয়ে যাচ্ছিল।

বাপরে না না ভাবনা নয়, ভাবনা নয়, শুধু মুহূর্ত শুধু মুহূর্ত... না হলে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে।

(ক্রমশ)

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register