- 4
- 0
আকাশটা আজ ধোঁয়াটে। মনে হয় বৃষ্টি আসবে। এখানে বৃষ্টি হলে আর থামতে চায় না। এই যে দিনরাত অবিরাম অন্তরালের গহীনকোণে ঘাপটি মেরে বসে সংযোগ তৈরি করে যাচ্ছে সেই স্বপ্নিল সাঁকো, সেই তো টেনে নিয়ে যায় দূরে দূরান্তরে, সেখানে রাত পাহারায় বসেছে মানুষ, কখন না নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। বরবক্র নদী ফুঁসছে।
৷ আমি জানি কখন ফিরে যাব সেই রূপমতীতে, কিম্বা হাটখিরায়, কিম্বা উইলসন ইশকুলে কিম্বা রূপমতী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, কিম্বা অচিনপুরে। যেদিকে স্বপ্নসারথি টেনে নিয়ে যায়, যেদিকে নিরন্তর চলতেই থাকে তার সাঁকো তৈরির রূপময় সংযোগ।
৷ বরবক্র নদী, পাহাড় থেকে নেমে চলে গেছে সমতলের দিকে। পাহাড়ে যখন প্রবল বর্ষণ, তখন বর্ষাজলের ধারা নেমে আসে উপত্যকায়, বরবক্রের জল বাড়তেই থাকে। ছুটি বাবার সাথে এসেছে অচিনপুরে, চা বাগানের জিপ আসছে অচিনপুর। সুধাময়ের ডি, আই অফিসে কিছু কাজ, আর কিছু কেনাকাটা। নদীর উত্তাল রূপ এভাবে কখনও দেখেনি ছুটি। জল ফুঁসছে, আছড়ে পড়ছে। যেন আশপাশকে ভাসিয়ে না নিতে পারলে তার কিছুতেই শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। জিপের ড্রাইভার মনোহর বলে- আজ কি ডি, আই অফিস খোলা পাবেন স্যার? সম্ভবত বন্যা হবে। কাল ম্যানেজার বলাবলি করছিল। আজ তাই ক্লাবের অফিসঘর থেকে কিছু দরকারি ফাইল নিয়ে যেতে এসেছি। আপনি তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নিন, আমি ডি, আই অফিসের সামনেই থাকব। ঠিক বারোটায়। আজ বাস পাবেন কিনা, সঙ্গে ছোট খুকি রয়েছে।
ডি, আই অফিসের সামনে এসে দেখা গেল, অফিস বন্ধ। এত জল বেড়েছে, চা বাগানে বসে তা আন্দাজ করা যায়নি। বাবা কেনাকাটা করলেন, সোনামুগের ডাল, সরষের তেল, কিছু মশলাপাতি। সুধাময় খেতে ও খাওয়াতে ভালবাসেন আর সেটা যাতে ভালো মানের হয় সেদিকে তাঁর নজর থাকে সবসময়। কাজ যা ছিল সারা হয়ে গেছে। সুধাময় ছুটিকে বললেন, নদী দেখবি? এখনও বারোটা বাজেনি। ছুটি বলে- বাবা, সরকারি বালিকা বিদ্যালয় কোনটা ? নদী দেখতে যাওয়ার পথে দেখা যাবে? বাবা বললেন, বেশ। একটা রিকশা নিলেন বাবা। রিকশায় বসে জিজ্ঞেস করলেন - সরকারি বালিকা বিদ্যালয় দেখার ইচ্ছে হল কেন ছুটি? ছুটির তো আসলে রাইএর কাছে গল্প শুনে শুনে দেখার আগ্রহ জেগেছে। কিন্তু বাবাকে ওকথা বলতে কেন কে জানে সঙ্কোচ হল। বলল - মা তো অই ইশকুলে পড়েছেন, তাই না বাবা? অই যে মা গল্প করেন, প্রার্থনার সময় মেমটিচার গাইত - "যীশু যদি বলে যাইতে সেখানে, সেইখানে যাব রব সেখানে। " সেই যে গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে....সুধাময় হো হো করে হেসে উঠলেন। ভাবলেন - গিরিজার সত্যি গল্প বলার ঢং ভারি সুন্দর। বৃটিশ আমলের ইশকুল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়। ইংরেজ শিক্ষিকা ছিল। গিরিজা ও গিরিজার দিদি কিছুদিন পড়েছিল অই ইশকুলে। সুধাময় হাসতে হাসতে বলেন - কীভাবে গানটা গায় রে তোর মা? ছুটি সঙ্গে সঙ্গেই গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে গাইল "যীশু যদি বলে যাইতে সেখানে সেইখানে যাব রব সেখানে "। সুধাময় হাসতে হাসতে বললেন - তোর মায়ের কণ্ঠের এই কম্পনতরঙ্গ যদি অক্ষরে ধরে রাখা যেত, তাহলে ধরে রাখতাম। -বাবা মা বলেছেন ইংরেজরা নাকি অইরকম গলা খুব কাঁপিয়ে গান গায়। বাবা, তরঙ্গ মানে কি? -ঢেউ। এই এখন আমরা ঢেউ দেখব। ছুটি তখন অন্য ভাবনায় তলিয়ে গেছে। কন্ঠতরঙ্গ ও ঢেউএর মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজছে। তারপর জিজ্ঞেস করল - বাবা, যীশু যদি বলে যাইতে সেখানে... সেখানে মানে কোথায় বাবা? - ওসব তোর মা-কে জিজ্ঞেস করিস। এই দ্যাখ সরকারি বালিকা বিদ্যালয়। বাস রে কত বড়। তবে উইলসন ইশকুলের মত মাঠ আছে কি? ছুটি ভয়ে ভয়ে বলে - বাবা, ভেতরে যাওয়া যাবে? - আজ হবে না রে মা। আজ আমরা নদী দেখে যাই।
-এখন আমরা নদীর পাশে এসে গেছি। - সুধাময় বললেন। ছুটিরা রিকশা থেকে নামল। বাবা ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। লোকটা টাকাটা হাতে নিয়ে কপালে ছোঁয়াল। বলল- বউনি হল বাবু। -এত দেরিতে? - বাবু চারদিকে জল। এত বৃষ্টি দিচ্ছে। আজ একটু থম ধরেছে।আমার ঘরে জল বাবু। -কোন জায়গায় তোমার ঘর? - মন্দিরের চরে বাবু। মন্দিরের চর শহরের সবচাইতে নীচু এলাকা। একটু বেশি বৃষ্টি হলেই ভাসিয়ে দেয়। বেশির ভাগ দিন আনে দিন খায় মানুষের বাস।
একটা গলিপথের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তারা, একপাশে একটা মন্দির, বাবা ঢুকলেন। বাবা বললেন -দেবী অন্নপূর্ণা। অনেক পুরনো মন্দির। কয়েকটি মহিলা দাঁড়িয়ে। শাড়ির আঁচল সামনের দিকে টেনে আনা। জগমোহন স্যারের দিদিও অমন করে শাড়ি পরে। ওরাও তাহলে বিহারের মানুষ। ছুটি গুটিগুটি পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেল - এটা তোমাদের মন্দির? - হাঁ খোঁকি। -কতদিনের পুরনো? -সে অনেকদিন। -আগে তোমরা কোথায় ছিলে? -ইখানেই তো আছি খোঁকি বহোতদিন...
সুধাময় ডাকছেন - ছুটি বেরিয়ে আয়। বারোটা বাজতে চলল। নদী দেখবি আয়। সত্যি নদী ভয়াল হয়ে উঠেছে। সুধাময় বলে উঠলেন - করালবদনা ভীমপ্রবাহিনী সর্বগ্রাসিনী... ছুটি বলে - বাপরে। সুধাময় হেসে বলেন - বঙ্কিমচন্দ্র হলে এমনি করেই লিখতেন। আজ তাঁর জন্মদিন রে মা। -মানে ২৬ শে জুন? -হ্যাঁ ২৬ শে জুন, ১৮৩৮।
(ক্রমশ)
0 Comments.