Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ৫০)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ৫০)

পুপুর ডায়েরি

আম্মাই মানে পুপুর মায়ের মা, গরমকালে ষষ্ঠীপুজোর সময় খুব মিষ্টি করে একটা গল্প বলেন।

বেশির ভাগ বাড়িতে এ দিন জামাইষষ্ঠীর হইহই চলে।

পুপুর মামাবাড়িতেও তার বাবা আর বাকি মেশোমশাইদের নেমন্তন্ন থাকে। কিন্ত এবাড়িতে মায়েরা জামাইষষ্ঠী বলেন না। বলেন আজ সন্তানষষ্ঠী। কলাগাছের সাদা ধবধবে খোল কেটে কেটে দাদুভাই কি অপূর্ব নৌকো বানান বাড়ির মাঝখানের চৌকো উঠোনে বসে সকালবেলা। নারিকেল পাতার কাঠি, আর টুকরো টুকরো কলাগাছের খোল দিয়ে ম্যাজিকের মতো তৈরি হয়ে ওঠে সাত পাল তোলা ময়ূরপঙখী। পুপুরা সাত আটজন ভাইবোন উঠোনের চারপাশের ঘোরানো বারান্দার সিঁড়িতে বসে বসে মুগ্ধ হয়ে দ্যাখে। নৌকা তৈরি হলে উলু দিতে দিতে মাসিরা আম্মাইয়ের ঘরে ঠাকুরের সামনে পেতে রাখা মস্ত কাঠের পিঁড়িতে সেটা নিয়ে রাখে। আম্মাই করমচা, জাম, কাঁঠাল এইসব সাত রকম গাছের পাতা একসঙ্গে একটা গোছায় বেঁধে নিয়ে চওড়া লালপাড় ঘোমটায় মাথা ঢেকে বসেন। আলপনা দেওয়া পিঁড়িতে চাল বাটা দিয়ে সাদা আর কালো বেড়াল আর সাতটা ছোট্ট পুতুল বানানো হয় । ছোটরা, কাজল দিয়ে একটা বিল্লিকে কালো রঙ করা হচ্ছে দেখলেই আম্মাইয়ের গা ঘেঁষে বসে পড়ে।

তখন সোনার মত ঝকঝকে পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে আম্মাই বলতে শুরু করেন।

এক সওদাগরের বউ, বড্ড লোভা। ছুঁচি লুভি আগে-খাওনি পাগে-খাওনি ডুগডুগি। রান্না করতে করতেই সবার খাবার আগে নিজে রান্না খাবার খেয়ে নেয়। সওদাগর ময়ূরপঙখী সাজিয়ে বাড়ি ফিরে এসে যেই বলে, বউ খেতে দাও, অমনি বউ বলে ভাল মাছ, পায়েস সব কালি বিড়ালি আর ধলি বিড়ালি খেয়ে নিয়েছে। রোজ রোজ এইসব শুনে, বাড়ির লোকেরা সবাই মিলে মেরেধরে বিড়ালদের তাড়িয়ে দেয়। বিড়ালরা কিনা মা ষষ্ঠীর বাহন। তারা মায়ের কাছে নালিশ করে গিয়ে। মা ষষ্ঠী রুষ্ট হলেন খুব। বছর ঘোরে। বউয়ের একখানা সোনার চাঁদ ছেলে হল। আঁতুড়ঘরে বউ ঘুমিয়ে পড়তেই বিড়ালিরা খোকাকে নিয়ে চলে গেল। লুকিয়ে রাখল নিয়ে করমচা তলায়। বাচ্চারা মাথা ঝুঁকিয়ে তাকায় আম্মাইয়ের সামনের পিঁড়েতে। আম্মাই ছোট্ট সাদা খোকা পুতুলকে করমচা গাছের ডালের পাশে রেখে আসেন। এমনি করেই গল্প এগোতে থাকত। পর পর সাত বছর ছেলে হল। কিন্তু বউ কাউকে হাতে পেল না। আঁতুড়ঘর থেকেই বিড়ালিরা তাদের নিয়ে চলে যায়। সাতটা ছেলে লুকিয়ে থাকে সাত রকম গাছের তলায়। শেষে পাগলের মত কাঁদতে কাঁদতে বনে বনে ঘুরে বেড়ানো বউকে মা ষষ্ঠী এসে বকলেন খুব। বললেন , কেন নিজে ছুঁচি লুভি ডুগডুগি হয়ে বিড়ালিদের নামে দোষ দিলে? সব শেষে, নিজের দোষ স্বীকার করে , আর লোভী হবে না জানিয়ে, বিড়ালিদের ষাট দিয়ে আদর করে তবে সাত ছেলেকে ফিরে পেল মা। এই বলে ফি বছর গল্প শেষ হয়। ছোট পুতুল আর বিড়াল পুতুলরা সেজেগুজে বসে তখন পিঁড়ের ওপরে। আম্মাই তালপাতার হাতপাখায় জল নিয়ে সবাইকে ষাট ষাট দেন হাওয়া করে । তারপর সবার হাতে "বানা" মানে আম, মর্তমান কলা আর নতুন জামাকাপড় দেয়া হয়। ছোটরা বড়দের নমো করলেই মাথায় ধান আর দুর্বা।

কি মজা!!!

পুপুর তাই সারা বছর অপেক্ষা। কবে ষষ্ঠী আসবে। সকালের এই পুজোর পর বড় ঘরে সারি দিয়ে আসন পাতা হয়। তখন বড়দের হইচই। বাবা, মামারা, মেশোমশাইরা, দাদুভাই খেতে বসেন মস্ত সোনার মত থালায়। বাটির বাহার পাশে। সোনার রঙ ভারি গ্লাসে জল। পুপু জানে সবাই আচমন করে ঠাকুরকে আগে দিয়ে তবে খেতে শুরু করেন। তাই খাবার রান্নার সময় মুখে দিতে নেই। বাবা বলেছেন অগ্রভাগ দিয়ে দিলে এঁটো হয়ে যাবে, আর ঠাকুরকে দেয়া যাবে না।

পুপুর মজা লাগে যখন আম্মাই সুর করে ছড়া কাটেন, ছুঁচি লুভী ডুগডুগি, আগে-খাওনি, পাগে-খাওনি। একটু ভয় ভয় ও করে। ভাল খাবার রাখা আছে দেখলেও তাই চট করে হাত বাড়ায়না।

এ বছরে কিন্তু কিরকম খারাপ লাগায় ভার হয়ে যায় ভিতরটা। একটু বড় হয়েছে পুপু। ক্লাস সেভেন। অনেক গল্পের বই পড়ে ফেলেছে ইতিমধ্যেই ।

বারান্দায় বসে ভিতরের ঘরের দিকে তাকায় সে।

মা মামিমা মাসিরা ব্যস্ত হয়ে পরিবেশন করে চলেছেন। কত রকম পদ।

মায়ের ফর্সা মুখখানা লালচে হয়ে ঘেমে আছে গর্জনতেল মাখা মা দুর্গার মত। একটু ক্লান্তির ছাপ কি চোখের তলায় ? রোগা-সোগা মানুষ। কাল ত আবার সকালেই অফিস। তার আগে বাবাকে অফিসে, পুপুকে ইস্কুলে রওনা করা। কত বেলা হয়ে গেছে। কিন্তু ছেলেদের খাওয়া হয়ে ঘর টর পরিষ্কার করে তবে ত মেয়েরা খেতে বসেন।

পুপু ভাবে, মেয়েদের কি খিদে পেতে নেই ? ভালোমন্দ রান্না করতে করতে একটু খেতে ইচ্ছে হলেই এত পাপ হয় ?

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register