Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ৪৯)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ৪৯)

পুপুর ডায়েরি

পিছনে তাকিয়ে দেখতে দেখতে কত কিছুই মনে পড়ে। ছবি, শব্দ, গন্ধ… কোন দিনের রোদের উত্তাপ, সন্ধ্যের ঠাণ্ডা হাওয়ার আরাম, ফিরে আসে। এইটে মনে পড়ছে, ঠাকুমা চলে গেলেন যখন ভরা গ্রীষ্ম কাল। কারণ, অনেক অনেক আম কাঁঠাল খাওয়া হয়েছিল বাড়িতে। বাবা, কাকারা, বড় জেঠু, ফুল মানে মেজ জেঠু, সবার গলা গমগম করছে পু-দাদাদের একতলার ছোটো বাসায়। বাবারা সব ধবধবে কাছা, মানে ধুতি আর চাদর গায়ে। গলায় সাদা দড়িতে লোহার চাবি। কোমরে কম্বলের আসন গোঁজা। মা, মেজ পিসিমা, রান্না ঘর, শোয়ার ঘরের পিছনের এক ফালি রকে বসে ঝপ ঝপ করে ফল কাটছে বঁটি পেতে। স্তুপ স্তুপ আম, কাঁঠাল। খই আর দুধ দিয়ে জল খাবার। সঙ্গে টুকটুকে হলুদ মর্তমান কলার ফলার। এ বাড়ির মানুষ আর জ্ঞাতিরা এক সাথে হলেই, হো হো করে হাসি আর উচ্চস্বরে গল্প চলে। বড় পিসিমার ছেলেরা এসেছে। আমাদের খাটে ছ ফুট লম্বা লোকেরা সারি সারি শুয়ে। চাপা রঙের লোক খুব কমই দেখেছি ছোটো বেলায়। সবই লাল টকটকে ছিটে দেয়া দুধে আলতা রঙ। এ কদিন, আমাদের, মানে পুপু ওরফে বুদু, সু ওরফে ভোম্বল, শোভা ওরফে তার বাবা মায়ের মেনে, প্রভা ওরফে হুরি র একেবারে ছাড়া গরু স্ট্যাটাস। তারা বড়োদের আশেপাশে ফাঁকে ফোকরে গলে যাচ্ছে এদিক ওদিক, আর আম লিচু কলা কাঁঠাল, অজস্র সন্দেশ মিষ্টি যার যেটা পছন্দ, বাটি হাতে মা পিসিমার পিছনে ঘুরে, পিনপিন করে চেয়ে নিয়ে সামনের রোয়াকে গিয়ে টপাটপ পেটস্থ করে ফেলছে। কখনো একটা ভেতর থেকে মহিলা গলার সম্মিলিত চীৎকার ভেসে আসছে, এই বাচ্চাগুলো, চান করবি কখন? দৌড়ে ভেতরে বাথরুমের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ছে চার জন। মাথায় মগ দিয়ে একটা দুটো ঝপাৎ হয়েই গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে তারা। মায়েদের কাছে ভিজে মাথায় এসে দাঁড়ালে, বাটি কাঁসি ভরে হবিষ্যির ভাত আর আলু কাঁচকলা সেদ্ধ আর ঘি পাওয়া যায়। পুপুর মা মেখে একখানা বড় স্টিলের চামচ দিয়ে দেন সোনারঙ কাঁসার বাটিতে। আসন পেতে বসে খাওয়া শেষ। মায়েরা জায়গা মুছে নিয়েই পালা পালা বলে ভাগিয়ে দেয়। এই রকম করেই অশৌচ কেটেছিল। কাজের দিন ঠাকুমার বাড়ির দোতলার ঘর বারান্দায় খানিক, আর গলির সামনের দিকে পুপুদের ঘরে খানিক ছুটে ছুটে যাওয়া আসা। সেই দিনের সবচেয়ে বড় যে ছবি পুপুর মনে চিরকালের জন্য গাঁথা, তা হল বিশাল একটা কালো লোহার কড়াই। ঠাকুমার ঘরের সামনে মাটির তোলা উনোন। তার ওপর কড়াই। তাতে টগবগ করে তেল ফুটছে। আর সেই অত্ত তেলে নাচছে হলদে লালচে মাছের ডিমের বড়া : শ’য়ে শ’য়ে। বড় জেঠা মশাই, লাল সাহেবের মত মুখ, অনেকখানি লম্বা, তখন ত মাথা নেড়া, সেই ভারি গলায় বলছেন, পিসিমা খেয়ে দেখো একটা। ছোটো বাটিতে একটা খেয়ে পুপু তর। —- কীই ভালো! মিটিমিটি হাসছেন অনেক ওপর থেকে লম্বা মানুষটি। কী গো, ভালো লাগলো মা? ঘাড় কাত করে পুপু। সেই গলার আওয়াজ আবার বলে, এই যে ঠাকুর, আমার এই ছোটো পিসিমা যখনই চাইবে ওকে এই ভাজা দেবে, কেমন? সে দিন ঘুরতে ফিরতে যে কত অজস্র মাছের ডিম ভাজা খেয়েছিল পুপু!!! সারা জীবন মনে থাকবে। বিকেলে সবার খাওয়া দাওয়ার পর, ঠাকুমার ঘরের সামনে ঠাকুররা মেজে ধুয়ে উপুড় করে রাখছে মস্ত মস্ত লোহার বাসন, মায় হাতা খুন্তি দৈত্যদের রান্না করার মত বিরাট ছাঞ্চা হাতা, এই দেখে পুপুরা ছুটে চলে এল গলির সামনে নিজেদের এক তলার ঘরের বাসায়। সাথে এলো মুন্না, পুপুর বড়ো মাসির মেয়ে। পুপু তার চেয়ে চাআর মাসের বড়ো। বড়োরা সবাই এসে চায়ের কাপ নিয়ে ফের হাহা হিহি হুল্লোড় ঘরের মধ্যে। এবারে পিসি কাকাদের সাথে সম বয়েসী মাসি মামারাও যোগ দান। পুপুর বাড়িতে মায়ের বাড়ির লোকেদের সাথে বাবার বাড়ির লোকজনের ভাব ছিলো জোরদার। দুই তরফে এত অনাবিল অনায়াস হাসিঠাট্টার সম্পর্ক অনেক বাড়িতেই বড়ো বেলায় দেখতে পায়নি পুপু। সেদিক থেকে ও পুপুর ছোটো বেলার মাধূর্য অনেকখানি। ত, সেই যে মুন্নারানি, তাকে নিজের ছোট ট্রাইসাইকেলটা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে উঠল পুপু। মায়ের কিনে দেয়া একটা অসম্ভব দামি জিনিস আছে তার। ভাই বোনদের আর কারো নেই। সুতরাং সামনের রোয়াকে, রিকশা কাকু যেমন পুপুকে ইশকুলে নিয়ে যায় সে রকমই মুন্নাকে সিটে বসিয়ে বাঁই বাঁই করে সাইকেল চালিয়ে দিলো সাইকেলের মালিক। রোয়াকের শেষে তিন ধাপ সিঁড়ি। সাইকেল ছিটকে নীচে। আরোহীর সিঁড়ির ধাপে ঠুকে গিয়ে মাথা ফাটা। পুপু উলটে পড়ে সাইকেলের তলায় চাপা। সব লোক হাউ মাউ করে ছুটে এল। পুপুর ছ ফুট লম্বা, ভবানী সিনেমা থেকে রাসবিহারী অ্যাভিনিউর মোড় পর্যন্ত হিরো বলে খ্যাত, অমিতাভ বচ্চন মার্কা ক্যারিশমাওয়ালা, গাইয়ে, রবিদা, মানে রাঙা কাকা, টপ করে, কাঁদিসনা মা গো সোনা মেয়ে, বলে, মুন্নাকে কোলে নিয়ে সাইকেলে চড়ে সোজা ডাক্তারখানা। পুপুর মা সাইকেলের সাথে পুপুকে তুলে এমন বকা আর মার!! নেহাৎ বড়ো মাসি বাবা আর বাকিরা তাকে টেনে নিয়ে গেল তাই। নইলে হয়েছিল আর কি! কিছুক্ষণ পরেই রাঙাকাকার কোলে চড়ে মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা মুন্না ফিরে এলো। চোখে জল, হাতে মনে হয় লজেঞ্চুস জাতীয় কিছু। পুদাদাদের রকের ওপরে, সে বিকেলের পড়ন্ত রোদের রঙটা আজও মনে আছে। এখন বুঝি, সেটা গরম কাল ছিলো। ছোট্ট বেলার গরম কাল।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register