- 5
- 0
৪৮ যদি বলি, ছোটো পুপুর প্রাণের বন্ধু ছিলো, এক ভীষণ গরীব, একটা চোখে দেখতে পায় না, এমন কিশোর, সবাই রোমাঞ্চকর রোমান্স খুঁজবেন কী? পিছনে তাকিয়ে দেখি যখন, মন বলে, আহা তার মত ভালো পুপু কম বন্ধুকেই বেসেছে, বিশেষত কিশোর পুরুষজাতীয় প্রাণীদের মধ্যে। তার একটা চোখ ঘোলাটে সাদা ছিলো। পিঠে কুঁজ। তখনও “হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদাম” পড়া হয়নি। কাজেই মাথায় মনে কোনো তুলনা আসেনি। বেচারা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না। বেঁকেচুরে চলতে হত। তাও তার সঙ্গেই ভীষণ ভীষণ ভাব পুপুর। অন্তর্যামী জানতেন, ডাক্তার বাবুর কাছে যাবার কথা উঠলেই চটি ফটর ফটর করা পুপুর যে উৎসাহ, তার মধ্যে সত্তর ভাগই আসলে, সেই ছেলেটির সঙ্গে দেখা আর কথাবার্তা হবার লোভে। হদ্দ গরীব, ফুটপাতে বসে থাকা ওই ছেলেটিই পুপুর পরমসখা।
তখন ত তোলাবাজির যুগ ছিলো না। গমগমে গলার, সকলের পরম শ্রদ্ধেয় ডাক্তারবাবু অনায়াসেই তাঁর ডাক্তারখানার বাঁ দিকের ভাঁজ করা দরজার পাশে একটা দু:স্থ পঙ্গু কিশোরকে পসরা সাজিয়ে বসার জায়গা দিতে পেরেছিলেন নেহাৎ দয়াপরবশ হয়ে। একেবারে শুরুতে মাটিতে একটু কাগজ পেতে বসত সে। ক্রমে পুপু বড় হতে হতে, তার বন্ধুর ও প্রোমোশন হল। কাঠের টুল। তারপর, তালা দেওয়া বাক্স। শেষে পুপু কলেজে উঠতে উঠতে, সেও হাফ প্যান্ট থেকে ভব্যিযুক্ত পাজামা আর ফুল শার্ট পরা রীতিমতো পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ী হয়েছিলো। এই ভেঙে দেওয়া চারু মার্কেটে কোথায় গেছে সে কে জানে?
কিন্তু সে হিসেব থাক। আগে বলি, তার সঙ্গ কেন এত ভাব ছিলো পুপুর, আর কী কথা চুপিচুপি রোজ থাকত সেই ছেলেটির সাথে? আহা.... সে যে খবরের কাগজ নিয়ে বসতো! মা যখন ডাক্তার বাবুর সঙ্গে শক্ত শক্ত ডাক্তারি শব্দে কী কী অসুখ হতে পারে বাচ্চাদের আর তা ঠেকাতে পুপুর কী কী পরীক্ষা ইত্যাদি করানোর দরকার, এইসব আলোচনা করতে ব্যস্ত, নেহাৎ বেজার মুখে চেয়ারে পা দোলানো পুপু করে কী? সে বাইরের কাগজওয়ালা দাদার কাছ থেকে একখানা কাগজ চেয়ে নিয়ে এসে চুপ করে কমিক্স পড়ে। কাগজওয়ালার ব্যবসাবুদ্ধি চমৎকার ছিলো। পুপু একটু উঁচু ক্লাসে উঠতে উঠতেই সে কাঠের চেয়ার আর টুল পেতে ফেলেছে। তার সামনে কাত করে করে মেলে রাখা, ইন্দ্রজাল কমিক্স, অমর চিত্র কথা, চাঁদমামা: যে গুলো মায়ের ভাষায়, ট্র্যাশ, পুপুর পড়া বারণ। কিন্তু, এই ডাক্তার খানার বাইরে হাতে নিয়ে গোগ্রাসে গিলে ফেলা যায়। এই অসম্ভব ভালো কাগজওয়ালা একটা পয়সাও চায় না। খালি তার কথা মেনে সাবধানে বই পড়ে ফেরত দিয়ে আসে পুপু। কত কত বই পড়িয়েছে সে বন্ধু তার সীমা সংখ্যা নেই। বাবা মা কিনতেন ও তার কাছ থেকেই। পত্রিকা। শারদীয়া। ইস্কুল শেষ হবার সময়, লেখাপড়ার পত্রিকা, “ নবম দশম” ও তার কাছেই কেনা হত। কিন্তু যত যত, বিশেষ করে গল্পের পত্রিকা পড়ে রঙিন হয়েছিল ছোটো বেলা, তার সবখানিই প্রায় বিনা মূল্যে পড়েছিলাম এই বন্ধু মানুষটির উদারতায়। আহা যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক সে।
এমন নি:স্বার্থ বন্ধু আর্থসামাজিক গণ্ডীর এপারে ওপারে পুপুর ছোটো বেলাকে রামধনুর মতো রঙ মাখিয়ে রেখেছে বলেই, অদ্যাবধি গলির মোড়ের ফুচকাওয়ালা থেকে বাস স্ট্যান্ডের অটো ড্রাইভার ছেলেরা সবাই পুপুর আত্মীয় হয়ে রইল আজ অবধি। কোন দিন মনে হল না নিজের মানুষ আশেপাশে নেই বুঝি।
0 Comments.