Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সমীপেষু

maro news
সমীপেষু

স্মৃতি আর শ্রদ্ধা

একটা মানুষের কী অমোঘ ক্ষমতা ক্রমাগত নিজেকে পাল্টে ফেলেছেন, প্রথা ভেঙ্গেছেন, পাল্টে দিয়েছেন বারবার নিজেরাই চলচ্চিত্রের টেক্সটের ধরন, খোলস ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন নতুন এক ঋতুপর্ণ, অথচ আমরা বিমহিতের মত, মুগ্ধ হয়ে তাঁর সৃষ্টিকে উপভোগ করেছি, অনুভব করেছি৷ এই প্রথা ভাঙ্গার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ উঠে আসেনি৷ কোথাও কোন বেমানন লাগেনি৷

উনিশে এপ্রিলের কথা মনে পড়ে যায় আমার৷ বিধবা নারীকে মঙ্গলসূত্র পরতে দেখলাম৷ অবাক কান্ড! মানুষ রে রে করে উঠলো না৷ চোখের বালির বিনোদিনীর গা ভর্তি গয়না, সুপ্ত আকাঙ্খা, কম বয়সে বিধবা নারীর রান্নাঘরে ঋতুমতী হওয়ার দৃশ্য, তাঁর এডিটিং এবং মেকিং স্টাইলের দক্ষতায় আমাদের হতবাক করে রাখলো৷ দেখলাম ফিসফিস করে না জীবনকে খোলা খাতার মত উচ্চারণ করতে জানেন তিনি৷

ঋতুপর্ণ নিজের ছবির একটা ধারা বানিয়েছিলেন৷ একটা ৷ প্রথম দিকের কিছু ছবি, উনিশে এপ্রিল, দহন, শুভ মহরৎ ঋতুপর্ণ নিজেকে যেন নারীবাদী পরিচালক হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন । কিন্তু এই চলচ্চিত্রগুলোতে নারীর চরিত্রগুলি অন্যান্য ছবির নারী চরিত্রের থেকে একেবারে আলাদা বয়ানে কথা বলেছে৷। সম্পূর্ণ নারীবাদী টেক্সট হিসেবে একেবারেই ভাবা যায় না।

আমাদের এই ভ্রান্ত ধারণা ভেঙ্গে গেল, যখন কৌস্তব বকশীর কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন, ‘আমি “ফেমিনিস্ট” নই বরং “উইমেনিস্ট” ফিল্মমেকার।’ শেষের দিকে এসে ঋতুপর্ণের একটা পরিচয় দাঁড়িয়ে গেল ক্যুয়ের পরিচালক (বিষমকামিতা বা প্রথাবদ্ধ যৌন সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করে এমন যেকোনো চলচ্চিত্রনির্মাতা) হিসেবে।

এই পরই দেখা গেলো, তাঁর শেষের দিকের ছবিগুলোতে এসেছে দৃশ্যতঃ কিছু বদল, ছবির টেক্সট বদলে যাচ্ছিল, নিজের তৈরি করা ধারা থেকে বেরিয়ে এসে, আবারও প্রথা ভাঙছিলেন৷ খেয়াল করলে দেখা যাবে কোথাও যেন তিনি তাঁর নিজের জেন্ডার ও যৌনতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত একাত্ম হচ্ছিলেন৷ আর তাই, নিজের ছবির সঙ্গে জীবনকে মিশিয়ে দিতে চেয়েছেন আর বলাই বাহুল্য সেটা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পেরেছেন বলেই, তিনি ঋতুপর্ণ ৷’

আরেকটি প্রেমের গল্পতে চলচ্চিত্রকার অভিরূপ এবং অভিনেতা চপল ভাদুড়ীর মধ্যে কথোপকথনের দৃশ্যে অভিরূপ বলে, ‘মেয়েরা আলাদা, ছেলেরা আলাদা আর আমরা আলাদা।’ আবার চিত্রাঙ্গদা চলচ্চিত্রে নারী হয়ে উঠবার জন্য মূল চরিত্র রুদ্র যেসব সার্জারির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, চলচ্চিত্রের শেষে সে কিন্তু আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে চায়। কারণ, ‘নকল’ নারী নয়, বরং নিজ জেন্ডার পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকাটাই সম্মানের বলে মনে করেছিল রুদ্র।

আর ঠিক সেই বার্তাই যেন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে দ্য টেলিগ্রাফকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার জেন্ডার তারল্যের জন্য নিজেকে সুবিধাপ্রাপ্ত মনে করি। সত্যি বলতে আমি হলাম দুটোর মধ্যবর্তী। আমি নিজেকে নারী মনে করি না এবং আমি নারী হতেও চাই না।’ তাই তাঁর পোষাকেও ছিলো একেবারে তাঁর বলা কথা, তাঁর অনুভব, তাঁর জীবন দর্শনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে৷ এ জন্যই চলচ্চিত্রে চরিত্রের প্রয়োজনে এক-দুবার শাড়ি পরলেও ব্যক্তিগত জীবনে, মিডিয়ায় বা নিজের পরিচালিত ছবিতে তিনি হাজির হতেন ঐকেবারে ভিন্ন ধরনের সব পোশাকে, যেগুলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পরতে পারে। মজার বিষয় হলো, বাংলা ভাষাকে তিনি জেন্ডার নিরপেক্ষ বলতেন। বলতেন, এই ভাষায় উভলিঙ্গীয় রহস্য আর মিথ লুকিয়ে আছে। তাই এই ভাষায় নিজের কথা বলতে স্বচ্ছন্দবোধ করতেন আর পোশাকের রাজনীতিতে নিজেকে হাজির করেছিলেন নতুন আইকন হিসেবে।

আজ বেঁচে থাকলে আপনার ৬২ হতো৷ আবারও কোন জটিল মনস্তত্ত্বিক গল্প আপনার মেকিং স্টাইলের দক্ষতার আমাদের বিমুগ্ধ করত৷ আমরা ভাষা হারিয়ে নীরবে বশ্যতা স্বীকার করতাম আপনার ছবির সামনে৷ কিংবা আমার তো মনে হয় * এবং ঋতুপর্ণ *-এর সেটে আপনার জন্মদিনের দিনও আগত অতিথির দিকে ধেয়ে আসতো তীক্ষ্ণ প্রশ্ন বাণ৷ এই সেটেই বলা, আপনার কথাটা খুব মনে পড়ে আজও৷ আপনি বলেছিলেন, " এ শহর (কলকাতা) আমাকে গ্রহণ করতে পারে না, আবার ফেলে দিতেও পারে না।’ কিন্তু ঋতুপর্ণ আপনি ভুল জানতেন৷ আজও আমরা সমান ভাবে আপনার অভাব অনুভব করি৷ আপনি একটা যুগের নাম৷ আপনি বাঙালীর আবেগের নাম৷

সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন লিখতে থাকুন পড়তে থাকুন ৷ রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register