Thu 18 December 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব - ১৬)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব - ১৬)

এবারের পুরী ভ্রমণ: সালবেগের কথা ফাইনাল 

আগের পর্বে অরুণ স্তম্ভ নিয়ে বলেছিলাম ,,,

আর বলেছিলাম সালবেগের কথা বলব এই পর্বে,,,,

কে এই 'সালবেগ'? যাঁর দুঃখে দুঃখী হয়ে শ্রী ভগবান রত্নবেদী সিংহাসন থেকে স্বয়ং নেমে আসেন!মাসির বাড়ি যাওয়ার সময় জনবহুল ভক্তদের ভীড়ে ঠাসা রাজপথে তাঁর রথ নন্দীঘোষ কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায়! 

সে কে? সে কতবড় ভক্ত যার কথা ভেবে মহাপ্রভুর চোখে জল আসে! কে এই ভক্ত? যার ভক্তি, ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে শ্রী মহাপ্রভু রথযাত্রার দিন তার সমাধির সামনে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকেন! 

এবার সেই ভক্তের গল্পই আজ বলব।

 কিন্তু তার আগে অরুণ স্তম্ভ নিয়ে কিছু কথা বলি যা গত পর্বে বলা হয় নি।

শ্রী জগন্নাথ দেবের শ্রীমন্দিরের পূর্ব দ্বার বা সিংহ দ্বারের ঠিক সামনে বিস্তৃত চত্বরের ঠিক সামনেই রয়েছে,, এই অরুণ স্তম্ভ। পূর্বে এই স্তম্ভটি কোনারকের সূর্য মন্দিরের সামনে অবস্থিত ছিল। ১২৫০ সালে এটি গঙ্গ রাজবংশের রাজা লাঙ্গুল নৃসিংহ দেব ত্রয়োদশ শতাব্দীর সময়কালে কোনারক মন্দির নির্মাণের সময় এই অরুণ স্তম্ভটি নির্মাণ করে ছিলেন। এটি সেই সময় কোনারকের সূর্য মন্দিরের সামনে অবস্থিত ছিল। ' বাবা ব্রহ্মচারী ' নামক মহারাষ্ট্রীয়দের এক গুরু রাজা দ্বিতীয় দিব্যসিংহদেবের (১৭৭৯-১৭৯৭) খৃষ্টাব্দ সময়ে এই স্তম্ভটি কোনারক থেকে এনে শ্রী জগন্নাথ দেবের শ্রীমন্দিরের সামনে স্থাপন করেন।

অরুণ স্তম্ভের উপরে সূর্যের সারথি অরুণ মূর্তি দেখা যায়। পৌরাণিক বিবরণ অনুযায়ী কশ্যপ ও বিনতার পুত্র অরুণ পূর্ণ অবয়ব হওয়ার আগেই জন্মগ্রহণ করেন। সূর্যের প্রখর রশ্মি পাছে কোণারকের রথ প্রতিম সূর্য মন্দিরের অশ্বদের দগ্ধ করে এই আশঙ্কায় অশ্ব ও সূর্যের মাঝে এই অরুণ মূর্তি স্থাপিত করা হয়।

সেইদিক থেকে দেখলে এই অরুণ স্তম্ভের মাহাত্ম্য কিছু কম নয়।

এবার আসি সালবেগের কথায়...

আমাদের মহাপ্রভু শ্রী পতিতপাবন। তিনি পতিতের ত্রাণকর্তা। তিনি শ্রীনীলমাধব- স্বরূপে বিশ্বাবসু নামে এক শবরের হাতে পুজো ও নৈবেদ্য গ্রহণ করেছিলেন। শবর জাতি বর্ণাশ্রম (ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র )বহির্ভূত প্রাচীন অন্ত্যজ একটি জাতি বিশেষ। " ঐতরেয়- ব্রাহ্মণের" বর্ণনা অনুসারে বিশ্বামিত্র থেকে যে সকল দস্যু জাতির উদ্ভব হয়েছিল,শবরেরা তাদের মধ্যে অন্যতম। মহাভারতে এই শবর জাতির উল্লেখ আছে।

অমরসিংহ, বরাহমিহির, বাণভট্টের মতো মহা পণ্ডিতেরা তাঁদের রচনায় শবর জাতির উল্লেখ করেছেন।

তো যাইহোক যে কথা বলছিলাম সেইসময় শবরজাতি সমাজের কাছে পতিত ছিল। কিন্তু ভগবান শ্রী জগন্নাথের কাছে সবাই সমান। সকলের প্রিয় তিনি। সবাই তাঁর আত্মার আত্মীয়।

তিনি উঁচু জাতিরও ভগবান আবার পতিতেরও ভগবান। তাঁর কাছে পতিত ব্যক্তিও সমান আদরের। এই পতিতপাবন সবাইকেই সমান ভাবেই

 কৃপা করেন। তিনি পতিতের ত্রাণকর্তা।

কিন্তু সেইসময় পতিত জাতির ভক্তদের শ্রী মন্দিরে প্রবেশের অধিকার ছিল না। কিন্তু তাই বলে কি তারা ভগবানের কৃপা থেকে বঞ্চিত হবেন? তা তো হতে পারে না। সেইজন্য বাইরে থেকে প্রভুর যাতে দর্শন পাওয়া যায় সেইজন্য শ্রীমন্দির থেকে বেরিয়ে সিংহদ্বার অতিক্রম করে উচ্চ বেদীর উপর পূর্বাভিমুখে আমাদের মহাপ্রভু, আমাদের শ্রী জগন্নাথদেব পতিত পাবন নামে জগন্নাথ রূপে বিরাজ করছেন। সিংহদ্বারে প্রবেশ না করেও দূরের রাস্তা থেকেও দিব্য দর্শন করা যায় তাঁকে। 

আমি শ্রীমন্দিরে ভগবানকে ভালো করে দর্শন করে আসার পর পূর্ব দিকের গেটের বাইরে রেলিং ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। ভগবান কে যতই দেখি আশ তো মেটে না। কতজন রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বা রেলিং এর উপর দিয়ে হাত দুটো বাড়িয়ে,

কেউ বা রেলিং এর ভেতর দিয়ে হাতদুটো ঢুকিয়ে হাতজোড় করে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলেন। 

কেউ বা মাথার উপর হাত দুটো সোজা করে এমন ভাবে জয় জগন্নাথ বলে ওঠেন যেন মনেহয় তিনি বলছেন, "ঠাকুর,আমি এই যে এখানে, জয় জগন্নাথ,, দেখ আমাকে দেখ, এই তো আমি,, আমাকে তোমার কৃপায় রেখো। বছর বছর যেন এখানে এসে তোমার খোঁজটা নিতে পারি আর আমার টাও দিতে পারি। তবে তুমি তো সবই জান আলাদা করে কি আর বলব। 

তাদের চোখে মুখে পুরীতে আসার আনন্দ,, আনন্দ জগন্নাথ দর্শনে,, আনন্দ সমুদ্র স্নানের,, আনন্দ পেটপুরে ভালো খাবার খাওয়ার,, একেবারে হৈ হৈ করতে আসেন এনারা,, নমস্কার করে চলে যান খাজার দোকানে। 

কারো বা চোখের জল শুকোতেই চায় না। রেলিং ধরে মাটিতে বসে লুকিয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যান কেঁদেই যান,গাল বেয়ে চোখের জল পড়তেই থাকে। কোনসময় মোছেন,, কোনসময় মোছেনই না। গাল বেয়ে নাক বেয়ে গড়াতেই থাকে জল। নাকের জলে চোখের জলে সব একাকার হয়ে যায়। কোনো সময় নাকটা একটু মুছে নেন শাড়ির আঁচল দিয়ে। বাচ্চা ডাকে মাম্মি অব চলো,,,কেউ ডাকে হলো তোমার? আর কতক্ষণ দেখবে,, দেখা শেষ হলো না এতক্ষণেও?

আসলে শুধু কি তাঁকে দর্শন করা? কত কথা থাকে যে কথা কাউকে বলা যায়না সে কথা আমার মহাপ্রভু কেই বলতে লাগে,,যার কোন সমাধান নেই সেই সমাধানের রাস্তা তো মহাপ্রভুই বাতলে দেন,,,অমন হুটোপুটি করে দর্শনের পর দুদণ্ড বসতে হলে তো এর থেকে ভালো জায়গা আর কি হতে পারে,, মহাপ্রভু কে দেখ আর মন হালকা কর। 

জগু দাদার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় যেন উনি আমার ভেতরটাও দেখতে পাচ্ছেন,,আর তখনই কান্না পায় খুব,,,বাপের বাড়িতে গেলে বাবা মায়ের সামনে দাঁড়ালে যেমন বলে দিতে হয় না কাউকে সে কেমন আছে,,,ঠিক তেমনি ঠিক সেইরকম,,,আমি সামনে দাঁড়ালেই চোখ ভর্তি জল নিয়ে একটা ঢোঁক গিলি,,, কিচ্ছু বলি না,,বলতে পারি না,, মনে হয় সবই তো জানেন,,সবই তো দেখতে পাচ্ছেন তাহলে বলে শুধু শুধু তাঁকে বিরক্ত করা কেন,,,,

যাক্ গে যা বলছিলাম পতিত পাবন সবার নাথ,সবার ত্রাণ কর্তা। করূণাময় ঈশ্বর,, আমাদের সবার প্রাণের ঠাকুর,,,তিনি তো জাতি ধর্ম দেখেন না,, দেখেন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি ভালোবাসা ভরসা বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাস ভক্তির জোড়েই এক যবনের জন্য শ্রী মহাপ্রভুর প্রাণ কেঁদে ওঠে। যেখানেই শ্রী জগন্নাথ পতিত পাবন রূপে,, সেখানেই তাঁর পাশে এক ভক্তের নাম জ্বলজ্বল করে ওঠে। আজ আমার মহাপ্রভুর সেই পরম ভক্তের কথাই বলব। সেই যবন কুলোদ্ভুত ভক্ত 'সালবেগ' আজও যেন মহাপ্রভুর আদর ভালোবাসায় বেঁচে রয়েছেন ভগবানের এই শ্রী ক্ষেত্রে। 

কেউ কেউ বলেন "সালবেগ"নামে এক যবনকুলোদ্ভুত ভক্তকে দর্শন দেওয়ার জন্য পতিতপাবন রূপে শ্রী জগন্নাথ দেব সিংহদ্বারে প্রকট হন,, কারো মতে রাজা রামচন্দ্র দেবের রাজত্বকালে (১৭৩৮খ্রীঃ) পতিত পাবন মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার কেউ কেউ বলেন শ্রীচৈতন্য দেবের নামে পতিতপাবন মূর্তির প্রকট হয়।

যাইহোক সালবেগের কথায় আসি। কথিত আছে জনৈক মুসলমান পাঠান সেনাপতি উৎকল দেশ (উড়িষ্যা) আক্রমণ কালে জনৈকা উৎকলিয়া হিন্দু রমণীকে হরণ করে নিয়ে যান। তাঁরই গর্ভে সালবেগ জন্মগ্রহণ করেন। ঐ হিন্দু উৎকলিয়া রমণী প্রভু জগন্নাথ দেবের ভক্ত ছিলেন। মায়ের কাছে মহাপ্রভুর কথা শুনে সালবেগ জগন্নাথ দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মন্দিরে তাঁকে প্রবেশ করতে না দেওয়ায় সে মন্দিরের বাইরে থেকেই কেঁদে কেঁদে ডাক দেন করূণাময় ঈশ্বরকে। মহাপ্রভু থাকতে না পেরে বড়দেউল থেকে স্বয়ং সিংহদ্বারে উপস্থিত হন।

সেই থেকে পতিতগণকে কৃপা বিতরণের জন্য শ্রী জগন্নাথদেব সিংহদ্বারে পতিত পাবন অর্চামূর্তি রূপে অধিষ্ঠিত আছেন।

ওড়িয়া ভাষায় সালবেগ রচিত অনেক মর্মস্পর্শী কীর্তনের পদ পাওয়া যায়। সালবেগ পতিত পাবন শ্রী জগন্নাথদেবের উদ্দেশ্যে " পতিতপাবনাষ্টকম্" নামক একটি অষ্টক রচনা করেছিলেন। বলেও শোনা যায়।

শ্রী ক্ষেত্রে বলগণ্ডিতে (পুরীর সরকারি হাসপাতালের সামনে) প্রতিবছর রথের দিন সালবেগের সমাধির কাছে শ্রী জগন্নাথদেবের রথ আপনাআপনিই থেমে যায়। প্রতিবছর তাঁর রথ নন্দীঘোষ সেখানে কিছুক্ষণের জন্য আপনাআপনিই দাঁড়িয়ে পড়ে। না থেমে সেখান থেকে কিছুতেই এগোয় না রথ। কারোর পক্ষে সম্ভব নয় রথ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। 

সালবেগের সমাধির কাছে ভগবান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। যে সালবেগ দর্শন না পাওয়ার যন্ত্রণায় কেঁদে কেঁদে হয়রান হতেন তাঁর সম্মানার্থে প্রভুকে তো থামতেই হবে। তিনি ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু তো চান না,, দুহাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করেন ভক্তদের জন্য,, ভক্তদের দর্শন করে তাঁরও তো তৃপ্তি হয়, তাঁরও তো এক প্রকার ভালোলাগা। ভক্ত ছাড়া তিনি থাকতে পারেন না কিছুতেই। তাই তো ভক্তদের দর্শন করতে আর দর্শন দিতে নাওয়া খাওয়া সব ভুলে যান,,,সময় মতো ভোগ দেওয়া যায় না। অথচ তিনি খেতে ভালোবাসেন।

ভক্তবৎসলতার পরিচয় দেন বছর বছর। আমার মহাপ্রভু দয়াময়। মনপ্রাণ দিয়ে তাঁকে ডাকলে তিনি সাড়া দেন। এ আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছি। 

তাঁকে কলিযুগের জ্যান্ত ভগবান বলা হয়। সত্যিই তো,, তাঁর হৃদয় আছে। দাপর যুগে লীলা শেষে শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্ধান হয়ে যান। তাঁর হৃদয় সমুদ্রে ভেসে যায়। কলি যুগে তিনি জগন্নাথ রূপে লীলা করবেন বলে। ভগবানের শরীর তো পঞ্চভূতে বিলীন হয় না। হয় মানুষের । তাঁর হৃদয় আজও জীবন্ত। প্রতি আঠেরো বছর অন্তর 'মহাকলেবর' অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর হৃদয় নতুন শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। সেইদিন গোটা পুরী শহর থাকে নিকষ কালো অন্ধকারে। সরকার থেকেই লোডশেডিং করে রাখা হয়। সে গল্প আর একদিন বলব।

রথে মাসির বাড়ি যাওয়ার পর আমার ভগবানের তখন সময় কোথায়? ঠিক যেমন বাপের বাড়ি গেলে পাড়াপড়শি আত্মীয় স্বজন দেখা করতে আসেন,,ঠিক সেই রকম। ভগবানের তখন জামা কাপড়ের ঠিক থাকে না। ময়লা ধুতি পরে খালি গায়ে দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দর্শন দিচ্ছেন তো দিচ্ছেন। 

যতবার রথের সময় মাসির বাড়ি গুণ্ডিচা মন্দিরে যাই সে কি অবস্থা বাপ রে বাপ! রাতে মাত্র দুঘন্টার জন্য শয়ন হয়। সারাদিন দর্শন আর দর্শন,,কখন যে ভোগ হয় বুঝতে পারি না। 

পরীক্ষার পর মামাবাড়ি গেলে যেমন হতো আমাদের! স্নান খাওয়া চুলোয় যেত,, কখনো গঙ্গা পেরিয়ে চলে যেতাম আখের ক্ষেতে। সবাই মিলে বসে আখ খেয়েই পেট ভরে যেত। গঙ্গায় ঝাপাঝাপি,, কাদামাটি মাখা। মা চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে বাড়ি আনত দুপুর দুটোর সময়। একটা কেমন বেপরোয়া জীবন। কোন নিয়মকানুন নেই সময়ের মা বাপ নেই,,,একটা যেন বাঁধন ছাড়া ব্যাপার। 

আবার বেশি মার খাওয়ার ভয়ও নেই,,মাকে শাসন করার জন্য আমার দাদু দিদা মামা মাসি আছে না? মামার বাড়িতে তো শুধু আদর আর আদর।

মহাপ্রভু কে দেখলে আমার ঠিক অমনই মনে হয়। একে তো লক্ষ্মী মা ঠাকরূণের সঙ্গে ঝগড়া ঝাঁটি করে হুলস্থূল করে বেরিয়ে আসা। তারপর মাসির বাড়িতে মাসির সঙ্গে ভাই বোন নিয়ে সুখ দুঃখের গল্প গাছা করতে করতে সময়ের ধ্যান জ্ঞান থাকে না আমার জগু দাদার। কখন শোয়া কখন খাওয়া,,সব মিলিয়ে আমার জগু দাদা তখন একটু ঘেঁটেই থাকেন। আর মা মাসিকে কাছে পেলে ছেলেদের তখন সুখের চেয়ে দুঃখের গল্পই মনে আসে। সে বিয়ে করে কত কষ্টে আছে,,বৌ কত কষ্টে রেখেছে, এইটি বোঝাতে পারলে কেল্লা ফতে। মা মাসির কাছে বারতি আদর যত্ন পাওয়া যায়।ছেলেরা এইসময় যেন লটারি পাওয়ার সুখের মতো ভাসতে থাকে। 

মহাপ্রভুর অবস্থাও তো তাই। যত দুঃখের কথা বলা,তত আদর যত্ন বেশি।

মাসির বাড়ি আসতে না আসতেই মা লক্ষ্মী দলবল নিয়ে এসে চরম ঝগড়াঝাঁটি করে চলে যান। রথের চাকা ভাঙেন,বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ার হুমকি দিয়ে দপদপিয় চলে যান শ্রী মন্দিরে। এবং মন্দিরের দরজা ঠকাস করে বন্ধও করে দেন।জগু দাদা ছলছল চোখে মাসির কোলে মাথা রাখেন। 

বছরের দশ মাস প্রভুর ছয় বার ভোগ হলেও পৌষ মাস এবং কার্তিক মাসে কিন্তু প্রভু খান সাতবার। পৌষ মাসে মা লক্ষ্মী বাপের বাড়ি যান। তখন ভোগের দায়িত্ব পড়ে মহাপ্রভুর মায়েদের উপর। বউ যে কি ছাইপাঁশ রেঁধে দেয় তার নেই ঠিক। এই ভাবনা থেকেই সব মায়েরা মিলে ( সব যুগের মাকেই ধরা হয়) তখন মহাপ্রভুর ভোগের ব্যবস্থা করেন মোট সাতবার। যে কেউ খেতে দিক নিজের সন্তানকে নিজের হাতে নিজের মতো করে যত্নে খাওয়াতে না পারলে যেমন মায়ের শান্তি আসে না সেইরকম ব্যাপার আরকি। মায়ের মতো কী কেউ হয়?

প্রতি বছর রথের তিন চার দিন পর দর্শন করতে আমি তাঁর মাসির বাড়ি যাই। আর প্রতি বছরই পাণ্ডা মশাই বলেন কাল মহাপ্রভুর ঘুম হয় নি। মা লক্ষ্মী অনেক রাতে গেছেন। 

আষাঢ় মাসের পুষ্যা নক্ষত্র যুক্ত শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। আর রথ যাত্রার চতুর্থ দিনে পঞ্চমী তিথিতে 

মা লক্ষ্মী শ্রী যমেশ্বর শিব ও দেবদাসীদের সঙ্গে নিয়ে নরেন্দ্র সরোবরের তীরে তীরে খোঁজ খবর নিতে নিতে গুণ্ডিচা মন্দিরের প্রধান দরজায় উপস্থিত হন। মা লক্ষ্মী কে দেখেই জগন্নাথ দেবের সেবক দয়িতাগণ প্রভুর ভোগ মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেয়। এতে মা লক্ষ্মী প্রচণ্ড রেগে যান। এবং মন্দিরের বাইরে এসে প্রভুর রথের চাকার একটি কাঠ ভেঙে দেন।

মা লক্ষ্মী এই যে মহাপ্রভু কে খুঁজতে খুঁজতে গুণ্ডিচা মন্দিরে প্রভুর দর্শন পান এইজন্য উড়িষ্যার লোকেরা এই দিনটিকে "হেরা পঞ্চমী" নাম দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন "হারা পঞ্চমী" আবার কেউ কেউ বলেন "হোরা পঞ্চমী"। "হোরা" অর্থাৎ "গমন করা" ,যাওয়া। উক্ত পঞ্চমীতে শ্রী মন্দির থেকে মা লক্ষ্মী বাইরে গমন করেন। সেইজন্য একে "হোরা পঞ্চমী"ও বলা হয়। আবার কেউ কেউ "হোরাপঞ্চমী" কে "হোরা মহোৎসব"ও বলে থাকেন।

যাইহোক মহাপ্রভুকে দর্শন করা মাত্র মা লক্ষ্মী সমস্ত মান অভিমান একেবারে উগড়ে দেন,,, সত্যিই তো তাঁকে ছাড়া মহাপ্রভু আসবেনই বা কেন মাসির বাড়ি। মা লক্ষ্মী যে তাঁকে ছাড়া একটুকুও থাকতে পারেন না সেকি মহাপ্রভু জানেন না?

এত অবহেলা মা লক্ষ্মী তো সইবেন না,,,তাই মান অভিমানের সঙ্গে কিছুটা দুঃখ ছিটেফোঁটা অবহেলা সব মিলেমিশে প্রচণ্ড মাথা গরম হওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা,, আমাদের ও হয় তাই তাঁদেরও যে হবে না সে কথা কোথাও লেখা নেই।

তারপর উস্কানি দেওয়ার লোকের তো অভাব থাকে না। এই যেমন সেইসময় সবাই বলে মা লক্ষ্মী কে নিয়ে যান না মহাপ্রভু,ভাই বোনের সঙ্গে যান মাসির বাড়ি।

উল্টো রথে পুরী গেলে শ্রী মন্দিরে একবার যাইই আমি লক্ষ্মী দর্শনে। কেমন আছেন উনি মহাপ্রভু ছাড়া খোঁজ নিই,,দেখা তো করতেই হবে,,ওনার খবরও তো নিতে হবে। সেখানে তখন সবার মুখেই এক কথা ভক্ত, সেবাইত পাণ্ডারা সবাই বলেন মা লক্ষ্মীকে একা রেখে গেছেন "সংসার দেখো বলে",,,, আমি অনেকবার শুনেছি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে। আমারই শুনে খুব খারাপ লেগেছে, কষ্ট হয়েছে মা লক্ষ্মীর জন্য,,তাহলে মা লক্ষ্মীর কতটা কষ্ট হচ্ছে দিন রাত বার বার একই কথা শুনে,,আমি অনুভব করেছি,,নিজেকে ঐ জায়গায় বসিয়ে অনুভব করেছি আমার বর যদি এমন করতো! আমারও মাথা গরম হতো আমিও চেঁচামেচি করতাম ,, বলতাম আমিও,"থাক তুমি মাসির বাড়ি",,,,, 

তো যাইহোক নতুন ভাবে প্রচণ্ড ঝগড়া ঝাঁটি কান্নাকাটি করে মা লক্ষ্মী "এখানেই থাক" বলে রথের চাকা ভেঙে সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে দপদপিয়ে ফিরে আসেন শ্রী মন্দিরে।

আমি যতবারই সেরা পঞ্চমীর পরদিন গুণ্ডিচা মন্দিরে যাই,, কি যে বিশৃঙ্খলা অবস্থা দেখি তখন সেখানে,, এবার যেদিন গেলাম দেখি মহাপ্রভু খালি গায়ে একটা ময়লা ধুতি পরে দু হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। থমথমে মুখ,, ভোগ হয় নি,,স্নান হয় নি,,

হাতে কাপড় জড়ানো হচ্ছে। সোনার হাত লাগানো হবে। কোন সাজগোজ নেই। কপালে ফুলের বড়ো টিকলি, নাকে ফুলের ব্যাসর,,গলায় মালা কিচ্ছু নেই। মাথায় ফুলের বড়ো মুকুট নেই , খাওয়া দাওয়া নেই,,কেমন যেন সন্যাসী রূপ,,,

দেখে চোখে জল এসে গিয়েছিল।মনে হল রাজাধিরাজ রাজরাজেশ্বর আমার মহাপ্রভু যেন সব ত্যাগ করেছেন। প্রাণাধিক প্রিয় লক্ষ্মী ঠাকরূণ রাগ করেছেন। সকলের সামনে এমন হুলস্থূল ঝগড়া ঝাঁটির পর কার মন ভালো থাকে? প্রভু আমার দয়াময় সদ্য বিবাহিত লক্ষ্মীর যুক্তিও ফেলতে পারছেন না। কিন্তু বড়ো দাদাকে সেকথা বলেন কোন সাহসে! যেখানে ভাসুর যাচ্ছেন সেখানে ভাদ্দরবৌ যান কি করে? অসহায় অবস্থা মহাপ্রভুর। ফেরার পর যে কী আছে কপালে সেটা ভেবেই উৎকণ্ঠায় আমার মহাপ্রভু। 

মা বিমলা (মা দুর্গার আর এক রূপ) অনেক বুঝিয়েছেন কিন্তু কোনো কথাই তো গিন্নি কানে নেয় না।

 কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছেন আমার মহাপ্রভু আমার জগুদাদা। তাঁর এমন রূপ দেখে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। কান্না পেয়ে গিয়েছিল। আহা কত কষ্ট আমার জগু দাদার,, প্রণাম করে চোখ মুছতে মুছতে মুছতে বলে এসেছিলাম এমন ভাবে থাকবে না, তোমার এমন রূপ দেখতে চাই না। আগে থেকে টিকিট কেটে হোটেল বুক করে কত খরচাপাতি করে আসা। নিজে তো রোজগার করি না। কত তাকঝাক করে আসতে হয়। কত প্ল্যান কত প্রোগ্রাম কত ম্যানেজ করতে হয় তোমার কাছে আসার জন্য।

খুব কষ্ট হয়। দুঃখ পাই। কত আশা নিয়ে,কত কষ্ট করে তোমাকে দেখতে আসি,, তুমি এমন ভাবে থাকলে ভালো লাগে বলো?

আবার পরের পর্বে...

ক্রমশঃ

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register