- 4
- 0
দেখতে দেখতে ছুটির সেন্টার পরীক্ষা এসে গেল। রতনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে কেন্দ্র পরীক্ষা মানে প্রাথমিক ইশকুল শিক্ষান্ত পরীক্ষা। রূপমতী চা বাগান থেকে অন্তত আড়াই/তিন কিলোমিটারের পথ। রূপমতী চা বাগানের পর হাটখিরা চা বাগান, হাটখিরা চা বাগানের একেবারে শেষপ্রান্তে শুরু হয়েছে রতনপুর এলাকা। চা বাগান থেকে একখানা গাড়ি দেওয়া হয়েছে কেন্দ্র পরীক্ষার ছাত্র ছাত্রীদের জন্যে। পরীক্ষা পড়েছে পুজোর ছুটিতে। রতনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পুজোর ছুটি চলছে। হয়তো এজন্যই এই সময়টাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। লক্ষ্মীপুজো ও কালীপুজোর মাঝখানে যে সময় তার মধ্যে পরীক্ষা। আরও কীসব ছুটি থাকায় পরীক্ষা শেষ হচ্ছে একেবারে দীপাবলির দিন। তবে ওইদিন ড্রয়িং পরীক্ষা একঘন্টার।
পরীক্ষা হল। বাবার নির্দেশে বড়দাদা প্রায় রোজ ইশকুলে উপস্থিত থাকত। লক্ষ রাখত ছুটি লিখছে কিনা। হ্যাঁ, ছুটি তৈরি হয়েছে ভালো। তাকে যেতে হবে উইলসন ইশকুলে, ওখানে বাবা আছেন, কোনও ভয় নেই, চিন্তা নেই। পরীক্ষার শেষ দিনটাতে দীপাবলি। বাড়িতে হুলুস্থুল চলছে।
পরীক্ষা শেষ হল। কোয়ার্টারের সামনে এসে ছুটি গাড়ি থেকে নেমে দেখল সন্ধ্যায় আলো ও বাজি পোড়ানোর তোড়জোড় চলছে। হুকুম নামে একটি শ্রমিক, বেকার দফায় কাজ করে, সদর গেটের সামনে দুদিকে দুটি কলাগাছ লাগাচ্ছে। হুকুম ছুটিদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে কাজ করে। উঠোনের ঘাস সাফাই করে দেওয়া, সব্জিক্ষেতের কাজ, সব্জিক্ষেতের চারপাশে ফেন্সিঙের কাজ, বিশাল আকারের কাঁঠাল গাছটায় যখন কাঁঠাল পাকতে শুরু করে, তখন গাছে উঠে কাঁঠাল পেড়ে দেওয়া, ওসব মাঝেমধ্যে করে দেয়। এখন করছে সন্ধ্যায় সারি দিয়ে দীপাবলির মোমবাতি জ্বালানোর কাজ। দু'দিকে দুটো কলাগাছ, তারপর উপর থেকে অন্তত তিনটি সারিতে মুলিবাঁশ দু'ফালি করে দুটো ধারকে সরু ধারালো করে কলাগাছের দু'দিকে গেঁথে দেওয়া অন্তত তিনটি সারিতে। প্রতিটি সারিতে সারি সারি মোমবাতি বসিয়ে দেওয়া হবে। তারপর একসাথে জ্বালিয়ে দেওয়া। উফফ, তারপর সদর রাস্তায় নেমে দেখে নেওয়া কত চমৎকার লাগছে, কাদের কোয়ার্টারের আলো কতক্ষণ জ্বলে। তাছাড়া তারাবাতি বাজি পোড়ানো তো আছেই। হুকুম গান গাইতে গাইতে কাজ করছে - ও নীল গগন কি তলে / ধরতি ক্যা প্যার চলে.... আহারে আহা আহা আজ আকাশটাও সুনীল, হাওয়াতে উত্তুরে হাওয়ার ছোঁয়া, শীত এসে ঢুকছে ধীরে ধীরে। দীপাবলির পর ভাইফোঁটা, রকমারি খাবারের প্লেট ভাইদের সামনে সাজিয়ে দেওয়া। তার কিছুদিন পর কেন্দ্র পরীক্ষার ফল বেরোনো, তারপর উইলসন ইশকুল এ ভর্তি হওয়া। হুকুম মুলি বাঁশ দুফালি করছে আর গাইছে - য়্যায়সেহি জগ মে আতে হ্যায় সুবহি য়্যায়সেহি সাম ঢলে… কী সুন্দর গানটা। ওই বিশ্বকর্মা পুজোর দিন কারখানার মাইকে ওই গানটা শোনা যায়।
পরীক্ষা শেষ, কয়দিন শুধু উৎফুল্ল ছোটাছুটি। এতসব উৎফুল্ল আনন্দকে কোথায় ধরে রাখবে ছুটি, এইটুকুনি দেহে এত আনন্দ ধরে রাখা যায়? সুতরাং বাড়িতে ঢুকে দুটো মুখে গুঁজে দু'হাত দু'দিকে ছড়িয়ে আপনমনে ছুটে বেড়াচ্ছে সে। এরপর বাইরে এসে হুকুমের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। -কি খোঁকি, পরীক্ষা শেষ হ্যয়লো? -হ্যাঁ, শেষ। কেন্দ্র পরীক্ষা দিলাম। কেন্দ্র পরীক্ষা বোঝো? -না না, ওসব বুঝে হামার কি লাভ! ওসব তুমরাই বোঝো! লিকাপড়া কইর্যে হামদের কি হব্যেক? -লেখাপড়া করলে অনেক কিছু জানতে পারবে। -জাইন্যে কি হবেক? -সে কি? জানবে না? এই দুনিয়াটা কত বড়, কত কী আছে, সেগুলো জানবে না? -থাইকল্যে থাক, হামদের ওইসবের দরকার নাইখে। -কেন দরকার নাই? -আরে খোঁকি, আগে তো পেট ভইরবেক, তারপর তো লিখাপড়া। -তুমার পেট ভরে না কেন? হা হা করে হাসতে লাগল হুকুম। হামদের পেট তুমাদের লে অনেক বড় আছে গ্য। ইয়া বড়, একটা বড় কাঁঠাল ভেঙে খাইতে পাইরবেক লাই তুমরা, হামি পারি। -একটা পুরো কাঁঠাল। আমাদের গাছের? আমাদের গাছের কাঁঠাল তো খুব বড় হয়। -হঁ হঁ। তুমাদের গাছের কাঁঠালের কথাই বলছি। -তোমার নাম হুকুম কেন? হুকুম হাতের কাজ রেখে হঠাৎ ছুটির দিকে ঘুরে কপালে স্যালুট ঠুকে বলে - জ্বি হুকুম মেমসাব। ছুটি খিলখিল করে হেসে হাততালি দেয়। - আগে বলো তোমার নাম হুকুম কেন? -সে তো বইলতে পাইরব লাই খোঁকি। হামার বাপকে সাহাব হুকুম কইরল, তো ঘরে আইস্যে বাপ মাকে হুকুম কইরল-ছেল্যার নাম রাখ হুকুম। তো আমি হয়্যে গেলম হুকুম। ছুটি খিলখিল করে হাসে। হুকুম সত্যি খুব মজার লোক।
বিকেলে কী কারণে কে জানে কলে জল এলনা। আজ সারাদিন ধরে হুকুম কাজ করছে, দুপুরে ভাত খেল। এঁটো বাসনকোসন জমে আছে বেশ, হুকুম বলল- চিন্তা নাই করো ঠাকরান, হামি তুমাদের নীচের কুয়ায় ধুয়ে লিব। টিলার উপরে কোয়ার্টার, কোয়ার্টারের পেছনের দিকটায় বিশাল আকারের বহু পুরনো কাঁঠালগাছ, বিস্তারিত শাখাপ্রশাখা ডালপালা, এর পাশ দিয়ে নেমে গেছে ঢালু পথ, শুকনো কাঁঠাল পাতায় মোড়া। পথ চলতে মড়মড় শব্দ ওঠে। দু'পাশে বুনো ফুলের গাছে অজস্র ফুল। বুনো গন্ধে ভরপুর চারপাশ। ছুটির এদিকটায় এলেই রোমাঞ্চ হয়। পাতকুয়োর জল খুব স্বচ্ছ ও ঠান্ডা। হুকুম এঁটো বাসনকোসন নামিয়ে রেখে বালতি নামিয়েছে জলে। ছুটি কুয়োর সামনে গিয়ে মাথা নীচু করে দেখে জল খুব নীচে নয়, কতগুলো ছায়া দুলছে। হুকুম, হুকুম দেয়- এ্যাই খোঁকি, পইড়্যে যাবিস। সইর্যে আয়। হুকুম বাসনপত্র মাজছে আর হাসতে হাসতে বলছে - খোঁকির আজ খুব ফুর্তি হ্যাঁ। পরীক্ষা শেষ হয়্যল। নীচে আইল সাথে। একটা কথা বইলব্য, বলো ডরাইবেক নাই। -না না ডরাব না। বলো না তুমি। -ডরাবে লাই কিন্তুক। ওই যে কাঁঠালগাছটা ওইটাতে ভুত আছে। ছুটি উপরের দিকে তাকায়। দেখে কাঁঠালগাছটা বিপুল দেহে তার ডালপালা ছড়িয়ে বিস্তারিত হয়ে আছে। তার ভেতর ভেতর অমোঘ অন্ধকার। ভূত ওইসব নিপাট আঁধারের ভেতর থেকেও থাকতে পারে। -একটা মানুষ, এই হামদেরই মানুষ, বহোত পেটে ভুখ, তখন তুমরা ইশকুল পাড়ায় ছিল্যে, গাছে কাঁঠাল পাইকেছ্যে, ইখানে তখন অন্য বাবু ছিল, রাইতের সময় গাছে উইঠল্য। ওই যে দেইকছ মোটা ডালটা ওইখানে বইস্যে কাঁঠাল খাইল্য। খাতে খাতে মইর্যে গেল। যেমন বইস্যে ছিল, ওইরকমই বইস্যে ছিল। মরে একদম শক্ত..... ছুটি বলে - না না হুকুম, আর বলবে না। ভালো লাগছে না। অন্যকথা বলো। হুকুম বাসনপত্র গুছিয়ে বলে - ব্যস, ঠিক আছে। আর বইলব নাই। তবে তোমাদের সামনের সিঁড়িটায় রাইতে মা কালী চুল খুইল্যে বইস্যে থাকে। ছুটি অবাক হয়ে বলে - কেন? -সে আমি কি জানি? -কত রাতে? -সে অনেক রাইতে। -তুমি দেখেছ? -হঁ হঁ। হামদের অনেক লোক দেইখেছে। - কিন্ত মা যে বলেন, অনেক সাধনা করেও ভগবান দেখা যায় না। তুমি এমনি এমনি দেখে নিলে? -কি বললি লাই বুঝলাম। -সাধনা মানে তপস্যা। এটাও বোঝোনি? তাহলে দ্যাখো এইরকম হাতজোড় করে একটা নিরিবিলি জায়গায় ভগবানকে ডাকতে হবে দিনরাত রাতদিন- "হে মা কালীঠাকুর, দেখা দাও দেখা দাও।" -আর খানাপিনা নাই? - ধুর তুমি ভারি পেটুক। হুকুম হা হা করে হাসে।
ক্রমশ…
0 Comments.