Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব - ২)

maro news
দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব - ২)

এইবার লিখব

দুই

পোস্ট কার্ডের দাম মাত্র পনেরো পয়সা। যে সব সম্পাদক জবাবি খাম পাঠাতে বলেন না, তাঁরা লেখা পেলে সাধারণত পোস্ট কার্ডেই জানান মনোনীত হয়েছে কি না। কিন্তু বৃন্দাবন ঠিক করেছিল, না, যখন করছি, তখন ভাল ভাবেই করব। চিপ কিছু করব না। অন্যান্যদের মতো তাই পোস্ট কার্ডের এক দিকে লাল বা নীল রঙে, যাকে পাঠাব, তার নাম লেখার জায়গাটুকু ছেড়ে, কবিতার নাম লেখার জায়গাটায় একটা বড় ড্যাস চিহ্ন দিয়ে মনোনীত / অমনোনীত লিখে ছাপাব না। সবাই এটা করে। ওই ড্যাসের জায়গায় কবিতার নামটা বসিয়ে দেয়। আর  মনোনীতর পরে 'টিক' চিহ্ন দিয়ে দেয়। 'অমনোনীত' লেখা থাকলেও, কোনও সম্পাদকই ওই শব্দটার উপরে 'টিক' দেওয়ার সাহস দেখায় না। যদি কেউ চ্যালেঞ্জ করে, 'কেন ওটা অমনোনীত হল জানান', তখন তাঁরা আমতা আমতা করবেন বা কায়দা করে এড়িয়ে যাবেন। কোনও কথা গুছিয়ে বলতে পারবেন না তাই নিয়মাবলিতে যতই লেখা থাক বাঁ দিকে মার্জিন রেখে লিখবেন, এটা এমন করে লেখেন, যেন লেখাটার যেখানে যেখানে ভুল আছে, তাঁরা সেটা কেটেকুটে সংশোধন করে ওখানে লিখবেন। যতই বলা থাক, সম্পাদকের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে সংযোজন, সংশোধন ও পরিমার্জনের। কিন্তু কোনও সম্পাদকই তা করেন না। যতই বলুন, সম্পাদকমন্ডলীর বিচারই চূড়ান্ত। আসলে সম্পাদকমন্ডলী বলে আদৌ কিছু নেই। সব ওই একজনই। বৃন্দাবন তাই ছাঁট কাগজ কিনে এনে তার রূপসীতে লেখার নিয়মাবলি ছাপিয়েছিল। ইচ্ছে ছিল, নীল কালিতে ছাপবে। কিন্তু সেই সময় একজনের বিয়ের কার্ড লাল কালিতে ছাপা হচ্ছিল, ওটা নামিয়ে মুছেটুছে নীল কালি দিয়ে ছাপতে রাজি হননি প্রেসের মালিক। তাতে নাকি অনেক কালী নষ্ট হয়। তাই যখন যে কালীতে ছাপা হয়, তখন সেই রঙে ছাপার অর্ডারগুলোই পর পর ছাপা হয়। বৃন্দাবনের তাড়া ছিল বলে অগত্যা ওই লাল কালিতেই নিয়মাবলি ছেপে নিয়েছিল সে। ঠিক করেছিল, যাঁরা কবিতা, গল্প পাঠাবেন, তাঁরা লেখার সঙ্গে উত্তর পাওয়ার জন্য নিজের নাম-ঠিকানা নেখা একটা জবাবি খাম পাঠাবেন। তাতেই ও এই চিঠিটা ভরে তাঁদের পোস্ট করে দেবে। না, পঞ্চাশ বা একশো কপি নয়, যেহেতু এগারোশো কপি পর্যন্ত ছাপতে প্রেস একই টাকা নেয়, বেশি ছাপতে গেলে শুধু কাগজটাই একটু বেশি কিনতে হয়, এই যা... বৃন্দাবন তাই ছোট ট্রেডেল মেশিনে একেবারে এগারোশো কপি ছাপিয়ে নিয়েছিল। ভেবেছিল, পঞ্চাশ বা একশো যাই ছাপি না কেন, ফুরিয়ে গেলেই তো আবার ছাপতে হবে। কেউ তো তার জন্য গ্যালি ধরে রাখবে না। আবার কম্পোজ করতে হবে। আবার প্রুফ দেখা। আবার খরচ। পরে ছাপতে গেলেও তো কাগজ কিনতে হবে। তা, সেই কাগজটা একটু আগে একবারে কিনে নিলে ক্ষতি কী? এ তো আর কাচা আনাজ নয় যে, দু'দিন রাখলেই পচে যাবে! তার চেয়ে বরং কাগজের পিছনে একটু বেশি টাকা ইনভেস্ট করে একেবারে ছেপে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। একবার যখন রূপসী বের করা শুরু করেছি, এ তো আর বন্ধ করব না। তিন মাস পর পর বেরোবেই। তার পর যদি দেখি দারুণ ভাবে চলছে, তা হলে দ্বিমাসিক করব। মাসিক করব। তার পর দরকার হলে পাক্ষিক এবং তারও পরে সাপ্তাহিক। তার পরেও যদি দেখি লোকে চাইছে, তখন না-হয় দৈনিকের কথা ভাবব। আপাতত চিঠিগুলো তো একটু বেশি করে ছাপিয়ে রাখি, নাকি... কিন্তু না, বিজ্ঞাপন দেখে যত লোক কবিতা পাঠাবে বলে বৃন্দাবন ভেবেছিল, তার টেন পার্সেন্ট লোকও কবিতা পাঠায়নি। তার পর যাদের সে মনোনয়নের চিঠি পাঠিয়েছিল, তাদের দশ ভাগের এক ভাগও গ্রাহক চাঁদা পাঠায়নি। ফলে 'নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে তো আর পরের কবিতা ছাপ়ব না', এটা ঠিক করে যারা গ্রাহক চাঁদা পাঠায়নি, একটা সময়য়ের পর তাদের কবিতা 'ছাপার জন্য' ফাইল থেকে বের করে 'আপাতত বাতিল' ফাইলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলে সে। কিন্তু যখনই আবার কোনও মানি অর্ডার তার কাছে এসে পৌঁছত, সে সেই 'আপাতত বাতিল' ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে বার করত গ্রাহক চাঁদা পাঠানো সেই কবির কবিতা। কিন্তু এত কম কবি চাঁদা পাঠিয়েছিল যে, তাদের কবিতাগুলো একসঙ্গে জড়ো করে ছাপলেও তিন পাতার বেশি কিছুতেই হবে না! সে তাই অপেক্ষা করছিল, আর কার গ্রাহক চাঁদা আসে! আর কার গ্রাহক চাঁদা আসে! হঠাৎ ওর মনে হল, আচ্ছা, গ্রাহক চাঁদা ছাড়া রূপসীর খরচ আর কী ভাবে জোগাড় করা যায়! এটা নিয়ে দু'-চার জনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও করেছিল সে। একজনের বুদ্ধি মতো, কাগজটার মান আরও বাড়ানোর জন্য, পাশের পাড়ার নবীন সাঁধুখাকে পত্রিকার সভাপতি করেছিল সে। তাঁকে সভাপতি করার একমাত্র কারণ, তিনি স্কুল শিক্ষক। বৃন্দাবন ঠিক করেছিল, ওঁর নামের পাশে শুধু শিক্ষকই নয়, উনি যে সত্যি সত্যিই একজন স্কুল শিক্ষক এবং এ রকম একজন শিক্ষিত মানুষ যে তাদের প্রত্রিকার মাথার ওপরে আছেন, সেটা দেখানোর জন্যই উনি কোন স্কুলের শিক্ষক, সেই নামটাও দিয়ে দেবে। আরও একটা বড় কারণ, উনি যে পাড়ায় থাকেন, সেই পাড়ার দুর্গাপুজোর প্রেসিডেন্ট তিনি। আর প্রেসিডেন্ট বলেই, প্রতি বছর একটা লামসাম টাকা সেই পুজোয় তিনি দেন। তাঁকে সভাপতি করলে তিনি রূপসীকে সামান্য হলেও, নিশ্চয়ই কিছু না কিছু টাকা দেবেন। এই ধারণা তার বদ্ধমূল ছিল। তখনই সে ঠিক করেছিল, এই ভাবে যদি আরও দু'-চার জনকে সভাপতি বা উপদেষ্টা কিংবা সম্পাদক মণ্ডলীর প্রধান করা যায়, তা হলে তাঁদের কাছ থেকে যে আর্থিক সাহায্য পাওয়া যাবে, তাতেই রূপসীটাকে খুব ভাল ভাবেই বের করা যাবে। লেখার তো কোনও অভাব নেই। প্রচুর লেখা আছে। শুধু মনোনীত নয়, আপাতত বাতিল, বাতিল এবং অমনোনীত লেখাগুলো তো ছাপা যেতেই পারে। তার ভাল লাগেনি মানেই যে ওই লেখাগুলো একদম পাতে দেওয়ার মতো নয়, তা তো নয়। ওই লেখাগুলো অন্য কারও ভাল লাগতেই পারে। তাই বৃন্দাবন উঠেপড়ে লেগেছিল, এক একটা উপদেষ্টা, সভাপতি, শুভাকাঙ্খী, সম্পাদকমণ্ডলীর উপদেষ্টা জোগাড় করার জন্য। এবং একদমই যে কাউকে পাচ্ছিল না, তাও নয়। পাচ্ছিল, তবে তার জন্য বৃন্দাবনকে একটু ছোটাছুটি করতে হচ্ছিল।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register