Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ১৮)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ১৮)

রেকারিং ডেসিমাল

নতুন নাতবৌ টের পায়,এবাড়ির দিদা নামক পুরোনো বউটি অনেক জটিল ডিজাইনের একখানা আলপনা। তাঁর ভিতরে নানারকম দুষ্টু বুদ্ধি, বউদের নানাভাবে ঝামেলায় ফেলে দেবার চেষ্টা, এসব আছে। আবার সুস্থ নয়টি সন্তানের মা হয়ে, তাদের বড় করে, বিয়েথা দিয়ে নাতি নাতনি দেখতে পাওয়ার গর্ব ও আছে। কর্তা যে বুড়ো বয়েসেও তাঁকে টিকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেন, সে নিয়েও যথেষ্ট অহংকার আছে। অন্যদিকে প্রচুর প্রাণশক্তি এখনো টিকে আছে নানা রকম মারাত্মক অসুস্থতা সত্ত্বেও। অজস্র প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সাহস আর ধারালো বুদ্ধির জোরে এক লম্বা জীবন এতগুলো মানুষকে সামলে কাটিয়েছেন। সেই তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কটি সজাগ আর সচল রয়েছে পুরো মাত্রায়। রসবোধ অসাধারণ। কথাবার্তায় মানুষকে মুগ্ধ করে রাখতে পারেন। রান্না, আলপনা, সাধারণ ঘর সাজানো, সবেতেই অতি পটু ছিলেন যে , তা বউয়েরা গজগজ করতে করতে ও স্বীকার করে। নিজের সাজগোজে ও রুচিসম্মত, এত বয়েসেও। নাতবউ অবাক হয়ে দেখে সাদা ব্লাউজ আর চওড়া পাড় সাদা শাড়িরই কত কায়দা। কেনা ব্লাউজের হাতায় নানান রকম এমব্রয়ডারি। নাকি দিদার হাতের কাজ। ছাতাপড়া কেনা ব্লাউজ তাঁর চলেনা।
ঘরে সেলাই মেশিন। বউয়েরা কেউ সে চালাতে পারেনা বলে বকুনি খায়। সেজকাকু দিব্যি চালিয়ে এটাওটা সেলাই করে। নাতবউ পর্দা সেলাই করতে মেশিনে হাত দিতেই দাদু হাউমাউ করে উঠে এলেন খাট থেকে। আরে আরে, ভাঙবে নাকি মেশিন।
কেন দাদু ? আমাদের বাড়িতে আছে ত। মা আমার কত জামাটামা চিরকাল বানিয়ে দেন। আমিও পারি।
সেকি! তোমার মা এ সব ও পারে ? কত গুণী মেয়েটা বল দেখি? লেখাপড়া জানে। চাকরি করেছে। তোমায় মানুষ করে ডাক্তার বানিয়েছে। আবার এইসব ও? বাহ বাহ।
মাকে ভালো বললে কার না ভালো লাগে। নতুন বউ আল্লাদে গদগদ হয়।
তারপর বলে, দিদা তুমি এখনো এমব্রয়ডারি করো ? ব্লাউজের হাতায় এত সুন্দর কাজ করা দেখি যে ?
দিদা পাতলা ঠোঁটের ভাঁজে মুচকি হাসেন। এক কালে করেছি অনেক। এই যে মিস্টার মুখার্জি কে দেখছ ? ইনি মুগ্ধ হয়ে গেছেন দেখে। দাদু হইহই করে বলেন, আররে হ্যাঁ। এর কত গুণ ছিলো জানো? কি নিপুণ করে সংসার খরচ সামলে রান্নাবান্না করে এই নয় ছেলেমেয়ে নিয়েও আবার বাহারের জামাকাপড় বানাতেন, নিজের সাজ ছিলো পরিপাটি। আর রান্নায় তো সাক্ষাৎ দ্রৌপদী।
হাতের ধাক্কায় থামিয়ে দেন আশি পেরোনো লাজে রাঙা বউ, থাক থাক আর আদিখ্যেতা করেনা।
নাতবউ মুগ্ধ হয় এত দীর্ঘ দাম্পত্যের পরেও এই গাঢ় আদর দেখে। কি মিষ্টি!! তারপর বলে, তবে, এখন ব্লাউজের কাজ?
দিদা বলেন, কেন আমার বড় মেয়ে ? তার হাতের কাজ অপূর্ব। সেও নিপুণ সংসারী।
আচ্ছা দাঁড়াও, আমি ত আর চোখে ভালো দেখিনা। কিন্তু আমার কাজের নমুনা তাকে দিয়ে একখানা করিয়ে দেব তোমাকে। সব শিখিয়েছি তাকে। আমার কুমারের মেয়ের জন্য স্মৃতি একটা থাকবে। নাতবউয়ের কর্তার ডাক নাম কুমার।
এল এক দিন সেই কাজ। দিদিপিসিরা বাপেরবড়ি এসেই ডাক দিলেন দিদাদাদুর ঘরে। নতুন মা, গোড়ার দিকের বিরক্তিদের সব ভুলে গেল সেই মুহূর্তে। এত ক্ষমতা এই ভদ্রমহিলার ? এবং এত আর্টিস্টিক সেন্স?
কলার দেয়া ঘটি হাতা ধবধবে সাদা ছোট্ট ফ্রক। নিখুঁত সেলাই এবং কাটিং। ফ্রকের নিচের দিকে তিনটি লাল হাতি। প্রায় ছয় ইঞ্চি একেকটা । সুঁড় তুলে আছে। পিঠে হাওদা আর ঝালর দেওয়া। হাতিরা লাল কাপড়ের এপ্লিক। সুঁড় চোখ পায়ের নখ পিঠের ঝালর এত রঙের সুতোর সুক্ষ্ম কারুকাজ যে দেখে আঁকা বলে মনে হয়। প্রতিটা ফোঁড় সমান। কি রঙের ব্যবহার!! এ যে অপূর্ব শিল্পকলা!!
কুর্নিশ জানায় ডাক্তার শিল্পীর পটুত্বকে।
আর ষাট পেরিয়ে আসা সংসারের চাপে তেতো হয়ে যাওয়া পিসিশাশুড়ি মতের অমিল সত্ত্বেও এই অমলিন প্রশংসা পেয়ে অবাক হয়ে যান কেমন।
সেই থেকে দুজনের বেশ একটা হাসিখুশি সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। খুব ভালোবাসা না হলেও , অনাবিল হাসির সম্পর্ক।
মায়ের আলমারিতে যত্নে তোলা রইল, বাচ্চারা বড় হলে তাদের হাতে তুলে দেবার জন্য, হাতিতে সাজানো ছোট্ট ফ্রক। চারুকলার নিদর্শন।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register