Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

প্রবন্ধে ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

maro news
প্রবন্ধে ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

তুমি আমাদের পিতা’ - রবীন্দ্রনাথের স্মরণে মননে যিশু

যিশু এমন একজন মানুষ, তাঁকে সকলেই দেবতার আসনে বসিয়েছেন। যিনি নিজে ক্রুশকাঠ বয়ে নিয়ে যান বধ্যভূমিতে। বধ্য হওয়ার মুহূর্তে যিনি ঈশ্বরের কাছে ঘাতকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এমন একজনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। তবুও কেউ কেউ মনে করেন বড়দিনের আনন্দ-উত্সব শুধু খ্রিস্টীয় সমাজের জন্য। বস্তুত এ উত্সব সর্বজনীন। রবীন্দ্রনাথ বড়দিন বা যিশুখ্রিস্টের আবির্ভাব তিথিকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতেন। দেশে থাকলে তিনি যেমন বড়দিন পালন করতেন, তেমনি বিদেশেও তিনি বড়দিনের আয়োজন করতেন। তিনি একবার একটি চিঠিতে হেমলতা দেবীকে লিখেছেন, “আজ বড়দিন। এই মাত্র ভোরের বেলা আমরা খ্রিস্টোত্সব সমাধা করে উঠেছি। আমরা তিনজনে আমাদের শোবার ঘরের একটি কোণে বসে উত্সব করলুম। কিছু অভাব হল না। উত্সবের যিনি দেবতা তিনি যদি আসন গ্রহণ করেন তা হলে আয়োজনের ত্রুটি চোখেই পড়ে না। যাঁকে আজ প্রণাম করেছি তাঁর আশীর্বাদ আমরা গ্রহণ করেছি, আমরা একান্ত মনে প্রার্থনা করেছি— "যদ্‌ ভদ্রং তন্ন আসুব: যাহা ভদ্র তাহাই আমাদিগকে প্রেরণ করো।" আর একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “খ্রীষ্ট আজ জন্মেছিলেন, তিনিই আজ আমাদের জীবনের মধ্যে জন্মগ্রহণ করুন— নিষ্কলঙ্ক শুভ্র শিশুটি হয়ে একেবারে নিরুপায় পিতার সন্তানটি হয়ে, একেবারে নিঃসম্বল, নিষ্কিঞ্চন হয়ে। আজ সকালে তাঁর দরবারে একবার দাঁড়িয়েছি”। ২৫ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে মহাসমারোহে পালন করা হয় খ্রীষ্টোৎসব। তাও আবার উপাসনা মন্দিরে। যে ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীরা নিরাকার তত্ত্বে বিশ্বাসী, তাদের উপাসনা গৃহে এক ব্যক্তি বিশেষের পূজা আয়োজন দেখে বিস্মিত হতে হয়। পাশাপাশি কোন গাছের তলায় বা বাউল মেলার মাঠে এ উৎসবের আয়োজন না করে, মন্দিরে বসে রীতিমত বাইবেল থেকে পাঠ, খ্রিস্টানী সঙ্গীত সহযোগে কেন এই খৃষ্টোৎসবের আয়োজন? অথচ মহর্ষিদেবের জীবদ্দশায় (১৯ জানুয়ারি, ১৯০৫ সালে মহর্ষি পরলোক গমন করেন) শান্তিনিকেতনে এই অনুষ্টানের আয়োজন করা হয়নি। রবিজীবনীকার প্রশান্ত কুমার পাল বলেছেন, ’১০ পৌষ [রবি 25 Dec] মন্দিরে প্রথম খৃষ্টোৎসব পালিত হয়’। মহর্ষির খ্রীষ্টধর্ম সম্বন্ধে বিরূপতার কথা কবির অজ্ঞাত ছিল না। খ্রিস্টান. হওয়ার কারণেই ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ও রেবাচাঁদকে ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। মহর্ষির এই মনোভাবের কারণ সম্পর্কে কবি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে এক পত্রে. লিখছেন, “ধৰ্ম্মসাধন সম্বন্ধে তাঁর [মহর্ষির] একটা অত্যন্ত শুচিত্ববোধ ছিল, সেই শুচিত্ব ধর্মের স্থুল মতবাদকেও সহ্য করতে পারত না। রামমোহন রায়ের মধ্যে একেশ্বরবাদের একটা প্রবল ঐকান্তিকতা ছিল, যে জন্য আজও ভারতবর্ষ তাঁকে প্রসন্ন মনে স্বীকার করতে পরেনি – আমার পিতা বাল্যকালেই সেই অতি বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদের আদর্শ রামমোহন রায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন – সেই কারণে বিগ্রহপূজার সংস্রবমাত্র যেখানে আছে সেখানে তাঁর মন আঘাত পেয়েছে। কেশবচন্দ্র ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করেছিলেন খৃষ্টধর্মের সিংহদ্বার দিয়ে – সেইজন্য আত্মউপলব্ধির বিশুদ্ধ আত্মসমাহিত আনন্দের সাধনা তাঁর ছিল না – শাক্ত বৈষ্ণবধর্ম থেকে হৃদয়াবেগ মন্থন করে নেওয়া এবং তাঁর আন্দোলনে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া তাঁর [পক্ষে] সহজ ছিল”। কিন্তু আশ্রমে বিশেষ করে উপাসনা মন্দিরে বড়দিনে খ্রিষ্টোৎসব পালন করা কেন? এর প্রামাণ্য উত্তর পাওয়া যায় অজিতকুমার চক্রবর্তী ব্রহ্মবিদ্যালয়’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘১৩১৬ সালে মহাপুরুষদিগের জন্ম কিংবা মৃত্যু দিনে তাহাদিগের চরিত ও উপদেশ আলোচনার জন্য [শান্তিনিকেতনে] উৎসব করা স্থির হইল। খৃষ্টমাসে প্রথম খৃষ্টোৎসব হইল। তার পরে চৈতন্য ও কবীরের উৎসব হইয়াছিল। সকল মহাপুরুষকেই ভালো করিয়া জানিবার ও বুঝিবার সংকল্প হইতেই এ অনুষ্ঠানের সৃষ্টি।’ ইতিহাস আরও একটা সাক্ষী দিচ্ছে যে, রবীন্দ্রনাথ বাইবেল মন দিয়ে পড়েছিলেন। সেই মন নিয়েই তিনি পাঠ করেছিলেন শ্রীচুনীলাল মুখোপাধ্যায়ের বাইবেল প্রকাশ নামক গ্রন্থটি। গ্রন্থটির আখ্যাপত্রের আগে পুস্তানিতে গ্রন্থকাবের. হস্তাক্ষরে লেখা আছে— “পূজ্যপাদ শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়কে/গ্রন্থকার কর্তৃক উপহার. প্রদত্ত হইল।” অজিতকুমারের সাক্ষ্যে ১৩১৬ই হোক বা শান্তিনিকেতনের নথিতে ১৩১৭ই হোক এ কথা নিশ্চিত যে রবীন্দ্রনাথই শান্তিনিকেতনে খৃষ্টোৎসবের প্রচলন করেন। এবং বলাবাহুল্য, এর জন্যে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কবি অনেক দিন আগে। শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০১ সালে, মহর্ষির প্রকট কালে রবীন্দ্রনাথের. আত্ম-মানসিকতা প্রসঙ্গে হেমলতা দেবীকে এক চিঠিতে যে কথা লিখেছেন, “যে বিধাতা আমাকে বুদ্ধি দিয়েচেন, মানুষভ্রাতার প্রতি শ্রদ্ধা দিয়েছেন, মানবপ্রেমের ত্যাগপরায়ণ দুঃসাধ্য সাধনার দিকে আহ্বান করেছেন, তাঁকে ভক্তি করেই আমার ভক্তিবৃত্তিকে ধন্য বলে মানি— তাঁরই বিধান আমার যুক্তিতে আমার শুভবুদ্ধিতে সহজ বলে বোধ হয়, তাই আমার শিরোধাৰ্য্য। এই ‘শুভ-বুদ্ধি’-র দৌলতেই তিনি সমস্ত সংস্কার মুক্ত চিরনবীনতার পুজারী, সাম্যবাদী, মানুষ রবীন্দ্রনাথ। তার সাধনা মানুষের. দেবতার সাধনা। তিনি বলেছেন, “মানুষের আত্মায় যিনি মহাত্মা, মানুষের কৰ্ম্মে যিনি বিশ্বকৰ্ম্মা, আমি জেনে না-জেনে সেই দেবতাকেই মেনেচি,—তিনি যেখানে উপবাসী পীড়িত সেখান থেকে আমার ঠাকুরের ভোগ অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারিনে। খৃষ্ট বলেচেন, বিবস্ত্রকে যে কাপড় পরায় সেই আমাকে কাপড় পরায়, নিরন্নকে যে অন্ন দেয় সে আমাকেই অন্ন দেয়—এই কথাটাই ব্ৰহ্মভাষ্য। এই কথাটাকেই “দরিদ্র নারায়ণ” নামে আমরা হালে বানিয়েছি”। এই হলো তার নিগূঢ় অন্তরের সত্য, যার সাথে মিলে যায় — উপনিষদের বক্তব্য। এষ দেবো বিশ্বকর্মা মহাত্মা সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ । হৃদা মনীষা মনসাভিক৯প্তো য এতদ্‌বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি ।। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ-র সময় থেকে কবির মনে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ চেতনা উদ্ভাসিত হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন তিনি। রাখিবন্ধন উৎসব পালন করতে খালি পায়ে কলকাতার পথে মিছিল করে বেরিয়ে চিৎপুর রোডের উপর অবস্থিত নাখোদা মসজিদে গিয়ে মুসলমানদের হাতে রাখি বেঁধে এসেছিলেন ভ্রাতৃত্বের অঙ্গীকারে। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে শিলাইদহে অবস্থানকালে আশ্রমে রাখি উৎসব সম্বন্ধে নির্দেশ দিতে গিয়ে কবি লেখেন, “যে রাখিতে আত্মপর শত্রু-মিত্র স্বজাতি বিজাতি সকলকেই বাঁধে সেই রাখিই শান্তিনিকেতনের রাখি। ..... তোমাদের আশ্রমে তোমাদের রাখিবন্ধনের দিনকে খুব একটা বড়ো দিন করে তোলো। বড়দিন মানেই প্রেমের দিন মিলনের দিন”। একটু পিছনদিকে তাকালেই দেখতে পাব, রবীন্দ্রনাথ ঋগ্বেদ পাঠেই প্রথম যিশুখ্রিস্টের পরিচয় পান। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়াকালীন একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক অধ্যাপক ফাদার ডি পেনেরান্ডার–‌এর গভীর প্রভাব কবির জীবনে বিশেষ ভাবে ছায়া ফেলেছিল। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ‘‌জীবনস্মৃতি’‌ গ্রন্থে লিখেছেন— “… সেন্ট জেভিয়ার্সের একটি পবিত্র স্মৃতি আজ পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে অম্লান হইয়া রহিয়াছে— তাহা সেখানকার অধ্যাপকদের স্মৃতি।.‌.‌.‌ ফাদার ডি পেনেরান্ডার সহিত আমাদের যোগ তেমন বেশি ছিল না;‌ বোধকরি কিছুদিন তিনি আমাদের নিয়মিত শিক্ষকের বদলি রূপে কাজ করিয়াছিলেন। তিনি জাতিতে স্পেনীয় ছিলেন।.‌.‌.‌ তাঁহার মুখশ্রী সুন্দর ছিল না, কিন্তু আমার কাছে তাহার কেমন একটি আকর্ষণ ছিল। তাঁহাকে দেখিলেই মনে হইত, তিনি সর্বদাই আপনার মধ্যে যেন একটি দেবোপাসনা বহন করিতেছেন, অন্তরের বৃহৎ এর নিবিড় স্তব্ধতায় তাঁহাকে যেন আবৃত করিয়া রাখিয়াছে।.‌.‌.‌ অন্য ছাত্রদের কথা বলিতে পারি না কিন্তু আমি তাঁহার ভিতরকার একটি বৃহৎ মনকে দেখিতে পাইতাম;‌ আজও তাহা স্মরণ করিলে আমি যেন নিভৃত নিস্তব্ধ দেবমন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিবার অধিকার পাই”।… শান্তিনিকেতনে প্রতিবছর ২৫শে ডিসেম্বরে 'খৃষ্টোত্সব' অনুষ্ঠিত হয়। একদিকে মাঠে চলতে থাকে পৌষমেলা আর অন্যদিকে উপচে পড়া ভিড়ে শান্তিনিকেতনে ধ্বনিত হয় মধুর খ্রিস্টীয় প্রার্থনাসংগীত। যিশুখ্রিস্টের ওপর রবীন্দ্রনাথের দশটি রচনা পাওয়া যায়। তার মধ্যে সাতটি প্রবন্ধ ও তিনটি কবিতা। এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো—বেশির ভাগ প্রবন্ধ ও কবিতা ২৫শে ডিসেম্বরেই লেখা। রবীন্দ্রনাথের ‘‌মানসী’‌ কাব্যগ্রন্থর অন্তর্গত ‘‌ধর্মপ্রচার’‌ কবিতাটিতে “ধন্য হউক তোমার প্রেম, ধন্য তোমার নাম, ভুবন-মাঝারে হউক উদয় নূতন জেরুজিলাম।.. মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রথম যিশু খ্রিস্টের কথার শিল্পিত রূপ দেখতে পাই। কবিতাটির রচনাকাল ৩২ জৈষ্ঠ, ১২৯৬ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি ১৮৮৮ সাল। যিশু খ্রিস্ট ও খ্রিস্টধর্ম বিষয়ে কবি–‌রচিত প্রবন্ধগুলির মধ্যে ‘‌যিশুচরিত’‌ (‌২৫ ডিসেম্বর, ১৯১০)‌, ‘‌খ্রিস্টধর্ম’‌ (‌২৫ ডিসেম্বর ১৯১৪)‌, ‘‌খ্রিস্টোৎসব’‌ (‌২৫ ডিসেম্বর, ১৯২৩)‌ ‘‌মানব সম্বন্ধের দেবতা’‌ (‌২৫ ডিসেম্বর, ১৯২৬)‌, ‘‌বড়োদিন’‌ (‌২৫ ডিসেম্বর, ১৯৩২)‌, ‘‌খ্রিস্ট’‌ (‌২৫ ডিসেম্বর, ১৯৩৬)‌ প্রবন্ধগুলি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। যিশুর বাণীর মূল কথা তাই প্রেমের কথা, বিশ্বজনের প্রতি প্রেমের নির্দেশ। রবীন্দ্রনাথ এই কথার ভাষ্য রচনা করতে গিয়ে উপনিষদের একটি বাণীকে স্মরণ করেছেন, “যাহারা ধীর তাহারাই সকলের মধ্যে প্রবেশের. অধিকার লাভ করে। ধীরাঃ সর্বমেবাবিশন্তি।” যিশুর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি কর্মকাণ্ডই তার বাণী রূপে জন মনে চির আদৃত। রবীন্দ্রনাথ এ কথা নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন প্রথম যৌবনের. আত্মদর্শনের প্রভাতে সদরস্ট্রিটের বাড়ির বারান্দায়। হৃদয়দ্বার খুলে যাওয়ায় জগতের সঙ্গে কোলাকুলির আনন্দ উদ্ভাসন তাঁর অনেক গান কবিতার মধ্যেই পাওয়া যায়। আমরা অবশ্য সেই সব গান কবিতাকে বিশেষত উপনিষদীয় আলোকসম্পাতে বিচার করতেই অভ্যস্ত। তবে এ কথা সত্য যে কী উপনিষদ, কী ধম্মপদ, কী কোরাণ, কী বাইবেল সর্বত্রই মূল. কথাগুলি এক। সর্বত্রই দেখা যায় সত্য রূপে প্রতিভাত হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের গান— তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর তুমি তাই এসেছ নীচে। আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে। যিশু বারে বারেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন ইশ্বরের পুত্র বলে। ঈশ্বরকে তিনি পিতা বলে. মেনেছেন, বোধ করেছেন। আমাদের মনে হয় যিশুর প্রতি কবির আকৃষ্ট হবার এও একটি কারণ। ব্রহ্মধর্মের প্রার্থনা মন্ত্রতেই বলা হয়েছে – ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি নমস্তেহস্তু, মা মা হিংসীঃ । তাঁর ব্রহ্মবিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশে তাঁর নির্দেশ ছিল, “ছাত্রগণ পাঠ আরম্ভ করবার পূর্বে সকলে [যেন] সমস্বরে ওঁ পিতা নোহসি, উচ্চারণপূর্বক প্রণাম করে। ঈশ্বর যে আমাদের পিতা এবং তিনিই যে আমাদিগকে পিতার ন্যায় জ্ঞান শিক্ষা দিতেছেন, ছাত্রদিগকে তাহা প্রত্যহ স্মরণ করা চাই। অধ্যাপকেরা উপলক্ষমাত্র, কিন্তু যথার্থ যে জ্ঞানশিক্ষা তাহা আমাদের বিশ্বপিতার নিকট হইতে পাই”। এ শুধুমাত্র প্রার্থনাই নয়, এই মন্ত্র যে ব্রাহ্মদের মধ্যে কতটা ভরসাস্থল ছিল তার প্রমাণ পাই কবি-কন্যা রানীর অসুস্থতার সময়ে, ‘বাবা বল, ওঁ পিতা নোহসি,’- এই করুণ স্মৃতিচারণায়। রবীন্দ্রনাথ এই বাণীটির প্রতি কতখানি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন তা তাঁর রচনাবলী থেকে বেশ বোঝা যায়। শান্তিনিকেতন ভাষণমালায় তিনি বহুবার এই শ্লোকটির. ব্যাখ্যা করেছেন। একবার বলেছেন “আমরা তাঁকে পিতা রূপেও আশ্রয় দিতে পারি, প্রভুভাবেও পারি, বন্ধুভাবেও পারি। … সব সম্বন্ধের মধ্যে প্রথম সম্বন্ধ হচ্ছে পিতা-পুত্রের সম্বন্ধ”।… এই ভাব তাঁর গানে মূর্ত হয়েছে, - “তুমি আমাদের পিতা, তোমায় পিতা ব'লে যেন জানি, তোমায় নত হয়ে যেন মানি, “শান্তিনিকেতন” গ্রন্থের 'পিতার বোধ' শীর্ষক ভাষণে কবি বলছেন, “পিতা নোহসি : পিতা, তুমি আছ, তুমি আছ- এই আমার অন্তরের একমাত্র মন্ত্র । তুমি আছ। এই দিয়েই আমার জীবনের এবং জগতের সমস্ত কিছু পূর্ণ। সত্যং এই বলে ঋষিরা তোমাকে একমনে জপ করেছেন, সে কথাটির মানে হচ্ছে এই যে : পিতা নোহসি, পিতা তুমি আছ। মহাত্মা যিশুর জীবন-সত্য এই সত্যালোকে উদ্ভাসিত। ঈশ্বরকে তিনি শুধু যে পিতা বলেছেন. তাই নয়, তিনি বলেছেন, ‘আমাকে সেবা করলেই ঈশ্বরের সেবা করা হবে’। এই উক্তি থেকে অনুমান করা যায় তার পিতা নো বোধি-র ব্যাপ্তি অর্থাৎ তিনি কত গভীর ভাবে ইশ্বরকে পিতা বলে বোধ করেছিলেন। আবার অন্যদিকে তিনি আলোকপাত করেছেন যে, খ্রীষ্টান অনুসারীরা তাদের বিশ্বাস ও ধর্মচর্চার বৈশাদৃশ্যের মধ্য দিয়ে খৃষ্টের শিক্ষাকে পুরোপুরি অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে, খ্রীষ্টান অনুসারীরা তাদের জীবন ও ধর্মচর্চার মধ্য দিয়ে বারবার তাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, - “একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে রাজার দোহাই দিয়ে”… এই মহাত্মার বাণী যে তাঁর ধর্মাবলম্বীরাই গ্রহণ করেছিল তা নয়। তারা বারে বারে ইতিহাসে তাঁর বাণীর অবমাননা করেছে, রক্তের চিহ্নের দ্বারা ধরাতল রঞ্জিত করে দিয়েছে-- তারা যিশুকে এক বার নয়, বার-বার ক্রুশেতে বিদ্ধ করেছে। সেই খৃষ্টান নাস্তিকদের অবিশ্বাস থেকে যিশুকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁকে আপন শ্রদ্ধার দ্বারা দেখলেই যথার্থ ভাবে সম্মান করা হবে। আবার বড়দিন সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ খৃষ্টের জন্মের বিশ্বজনীনতার গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, বড়দিন নিছক এক উৎসবের বিষয় নয় কিন্তু খৃষ্টানদের আত্মনবায়নের সময়। তিনি লিখছেন, - “আজ তাঁর জন্মদিন এ কথা বলব কি পঞ্জিকার তিথি মিলিয়ে। অন্তরে যে দিন ধরা পড়ে না সে দিনের উপলব্ধি কি কালগণনায়। যেদিন সত্যের নামে ত্যাগ করেছি, যেদিন অকৃত্রিম প্রেমে মানুষকে ভাই বলতে পেরেছি, সেইদিনই পিতার পুত্র আমাদের জীবনে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেইদিনই বড়োদিন-- যে তারিখেই আসুক। …. খৃষ্টের ভালবাসা তার অনুগামীদের প্রলোভন জয় করতে এবং খৃষ্টের ভালবাসা প্রচার অন্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে সক্ষম করে তোলে। তিনি লিখছেন, - “খৃষ্টকে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে ভালোবাসতে পেরেছেন তাঁরা শুধু একা বসে রিপু দমন করেন নি, তাঁরা দুঃসাধ্য সাধন করেছেন। তাঁরা গিয়েছেন দূর-দূরান্তরে, পর্বত সমুদ্র পেরিয়ে মানবপ্রেম প্রচার করেছেন। মহাপুরুষেরা এইরকম আপন জীবনের প্রদীপ জ্বালান; তাঁরা কেবল তর্ক করেন না, মত প্রচার করেন না। তাঁরা আমাদের দিয়ে যান মানুষরূপে আপনাকে। তার লোকদের কাছে প্রকৃত খৃষ্টকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে মিশনারীদের ব্যর্থতার সমালোচনা তার রচনাসমূহে লক্ষ্য করা যায়। এটা মিশনারীদের প্রতি তার ঘৃণাবোধ নয়, বরং এটা হচ্ছে তার খৃষ্টের প্রতি মহান ভালবাসার প্রকাশ। যদিও সেই সময়ের চিন্তাধারা অনুযায়ী তারা সদিচ্ছা নিয়েই বাণী প্রচার করেছিলেন তথাপি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উল্লেখ করেছেন যে নির্যাতনের পরিস্থিতিতে তার সময়ের খৃষ্টধর্মের চিত্র ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, - “এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি, মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি”… যুগ যুগ ধরে মানুষ বারবার দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে, হিংসা আর অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে, আবার সেখান থেকে বেরোবার রাস্তা খুঁজে পেয়েছে এক-এক জন সত্যদ্রষ্টার হাত ধরে। আবার পথ ভুলেছে, কখনও বা যাঁরা পথ দেখাচ্ছেন তাঁদেরই ধ্বংস করতে চেয়েছে। এই আরোহণ-অবরোহণের মধ্যে দিয়েই কিছু জ্ঞানী মানুষ আমাদের নিয়ে চলেন এমন গন্তব্যে, যেখানে নতুন প্রাণ জন্ম নিচ্ছে, নতুন আশা নিয়ে সূর্যোদয় হচ্ছে। খড়ের বিছানায়, মাতৃক্রোড়ে জিশুর আবির্ভাব এমনই এক নতুন আলোর দিশা। রবীন্দ্রনাথ ‘শিশুতীর্থ’-তে আহ্বান জানালেন “মা বসে আছেন তৃণশয্যায়, কোলে তাঁর শিশু, উষার কোলে যেন শুকতারা।… জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের। জীবনের প্রান্তসীমায় এসে চার্লস এন্ডুজের রচিত কবিতার অনুবাদ করলেন রবীন্দ্রনাথ (২২ এপ্রিল ১৯৪০। মংপু দার্জিলিং) “গির্জাঘরের ভিতরটি স্নিগ্ধ, সেখানে বিরাজ করে স্তব্ধতা, রঙিন কাচের ভিতর দিয়ে সেখানে প্রবাহিত রমণীয় আলো । এইখানে আমাদের প্রভুকে দেখি তাঁর ন্যায়াসনে, মুখশ্রীতে বিষাদ-দুঃখ, বিচারকের বিরাট মহিমায় তিনি মুকুটিত”। …. রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “আজ পরিতাপ করবার দিন, আনন্দ করবার নয়। আজ মানুষের লজ্জা সমস্ত পৃথিবী ব্যাপ্ত ক'রে। আজ আমাদের উদ্ধত মাথা ধুলায় নত হোক, চোখ দিয়ে অশ্রু বয়ে যাক। বড়োদিন নিজেকে পরীক্ষা করবার দিন, নিজেকে নম্র করবার দিন”।
ঋণঃ রবীন্দ্ররচনাবলী। রবিজীবনী - প্রশান্ত কুমার পাল। ব্রহ্মবিদ্যালয় – অজিতকুমার চক্রবর্তী। চিঠিপত্র।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register