Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে তনিমা হাজরা (পর্ব – ৩)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে তনিমা হাজরা (পর্ব – ৩)

ছড়িয়ে জড়িয়ে

ইকির মিকির চামচিকির চামে কাটা মজুমদার, ধেয়ে এল দামোদর। দামোদরের হাঁড়িকুড়ি, দুয়োরে বসে চাল কাড়ি, চাল কাড়তে হলো বেলা, ভাত খাবি আয় জামাইশালা। ভাতে পড়ল মাছি, কোদাল দিয়ে চাঁছি, কোদাল হলো ভোঁতা, খা কামারের মাথা।
ছড়াটির ছত্রে ছত্রে চিত্রিত গ্রাম বাংলার সাধারন মানুষের জীবন যাত্রার চিত্র। বাদশাহ বা রাজা কয়েকটি গ্রামের খাজনা আদায়ের জন্য এর শ্রেণীর তহশিলদার নিযুক্ত করতেন এদের বলা হত "মুজলিমদার"।মজুমদার কথাটি এরই অপভ্রংশ।
"ইকির মিকির চাম চিকির " কথাটি সম্ভবত সেই অত্যাচারী শাসক শ্রেণীভুক্ত কর আদায়কারীর চিত্র তুলে ধরেছে। যারা দাঁত কিড়মিড় করে পিঠের ছালচামড়া তুলে নেবার হুমকি দিচ্ছে নিরীহ কৃষককে। চামে কাটা মজুমদার অর্থে ছাল চামড়া ছাড়িয়ে প্রবল অত্যাচারকারী কে বোঝানো হয়েছে। একদিকে কর আদায়ের জন্য অত্যাচার অন্যদিকে দামোদরের প্রবল বন্যা।উল্লেখ্য সে সময় কোন বাঁধ ব্যারেজ স্বভাবতই নি র্মিত হয়নি, সুতরাং নিরুপায় চাষা অনিবার্য কারনেই গৃহহীন ও সর্বহারা। বন্যায় ঘরের বাসনপত্র সব ভেসে গেছে।তাই দামোদরের পলিমাটি দিয়ে তৈরী মাটির বাসনই সম্বল।আর ঠাঁই পরের দুয়োরের পরিত্যক্ত জমি। উদর পূর্তির জন্য জুটেছে আকাড়া দুমুঠো চাল। তাই বেছে কাড়া করে রন্ধনের আয়োজন। কথায় বলে না ভিক্ষের চাল আবার কাড়া না আকাড়া। তা সেই চাল ফুটিয়ে চলে বাঁচার লড়াই। বন্যায় ভেসে মেয়েজামাই ও আজ গলগ্রহ।নিজেদের জুটুক না জুটুক জামাইকে তো এক থালা বেড়ে দিতেই হয় তাই বিরক্ত শ্বাশুড়ীর ক্ষেদোক্তি "ভাত খাবি আয় জামাই শালা"।
এদিকে ঘরের মানুষটাকে পাইকবরকন্দাজ হাঁকিয়ে বেঁধে নিয়ে গেছে মজুমদারের বাহিনী। তাই অপেক্ষায় বসে বসে ভাতে মাছি বসছে। এরপরে আবার শুরু হচ্ছে অনাবাদী পোড়ো জমি কোদাল দিয়ে পরিস্কার করে পুনর্বাসনের তোড়জোড়। সেই অমানুষিক শ্রমে মজবুত কোদাল ও ভোঁতা হয়ে যাবার জোগাড়। বিরক্ত চাষার কন্ঠে তাই কামারের প্রতি উঠে আসে বিষোদগার।বড়ই বেদনাদীর্ণ করুণগাথা।।
মাংসে মাংস বৃদ্ধি, ঘৃতে বৃদ্ধি বল, দুগ্ধে শুক্র বৃদ্ধি, শাকে বৃদ্ধি মল। মাছ চিনে গভীর জল, পাখি চিনে উঁচু ডাল, মানুষ অমানুষ যে না চিনে তার বড়ো পোড়া কপাল।।
এখানে এই ছড়ায় বিবিধ খাদ্যের গুণাগুণ এবং প্রাণীর বসবাস এবং বিবেচনা সংক্রান্ত জীবন বোধের ব্যাখ্যা রয়েছে।।
পরের হাতের পিঠা, চাইয়া খাইতে মিঠা, পরের হাতের পান, খাইতা মুখে গান। আহ্লাদী লো ঢ্যাপার কই, গতর গাতর না নাড়াইয়া, এমন্যা ঠমক পাইলি কই?
অতিমাত্রায় সুচতুর ভাবে আহ্লাদীপণা দেখিয়ে অন্যকে দিয়ে কাজ হাসিল করে নিজের ধান্ধা গুছিয়ে নেওয়ার কাহিনীই এই ছড়ার মর্মার্থ।
ভাত পায় না চা চায়, মিঞা আমার সাইকেল চড়ে গোসল যায়, আহ্লাদী বৌ তুমি চিকণ তুমার গা, ঝোলে না দিও হলদি, ধুইয়ো তুমার পা, আরশী রে দেখ মুখ, আমার প্যাটে কিল, রন্ধনের মাছ দেখ খাইয়া গেল চিল, ভিজা চাল চাবাইয়া খাবাম আর না গো কাইন্দো, আকাশের চন্দর আইন্যা দিবাম, বাতাসে পাতিয়া ফান্দ।।
রূপসী বউ বিয়ে করে কপালে ভাতই জোটে না, চা চাইবে সে কোন লজ্জায়। ঝোলে দেবার হলুদ দিয়ে সে গা পা মেজে রূপ খোলতাই করতে ব্যস্ত। এই অবসরে রান্নাঘর থেকে মাছ চিলে এসে নিয়ে গেছে। ভিজা চাল আঁচে চড়িয়ে ভাত রান্ধা হয় নাই। বেলা বয়ে গেছে। তাই সে সোহাগিনী রূপসী কাঁদতে বসেছে। গৃহকর্তার প্যাটে কিল দিয়ে খিদে সহ্য করেও তাকে ভোলাচ্ছেন বাতাসে ফাঁদ পেতে আকাশের চাঁদ এনে দেবেন এই বলে। এক রম্য বাতাবরণ এর মধ্যে মজার সংসার চালচিত্র।।
আবার,
মুঘল পাঠান হদ্দ হলো ফারসী পড়ে তাঁতি, সুপারি থুইয়া ফেলে পাথর কাটেন জাঁতি।।
এখানে যার যা কম্ম নয়, সাধ্য নয় তা করার চেষ্টা। ছড়ায় ছড়ায় জীবন বোধের বিন্দু বিন্দু আকর যেন ছড়ানো ছিটানো।।

চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register