Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে তনিমা হাজরা (পর্ব - ২)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে তনিমা হাজরা (পর্ব - ২)

ছড়িয়ে জড়িয়ে

সবচেয়ে প্রাচীন ছড়া বলে যেটি লিপিবদ্ধ আছে সেটা পাওয়া যাচ্ছে প্রখ্যাত ভাষাচার্য সুকুমার সেনের "বাংলার ছড়া" গ্রন্থে। এটি আগে ঠাকুমা দিদিমাদের মুখে মুখে শোনা যেতো কিন্তু এখন তেমন আর শোনা যায় না। এটি প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। গ্রাম বাংলার মানুষের মুখ থেকে এটি সংগ্রহ করেছিলেন উইলিয়াম কেরী।
মাছ আনিলা ছয় গন্ডা, চিলে নিলো দুই গন্ডা, বাকি র'লো ষোলো, তাহা ধুতে আটটা জলে পলাইলো তবে থাকিলো আট, দুইটায় কিনিলাম দুইকাটি কাঠ, তবে থাকিলো ছয়, প্রতিবেশীকে চারিটা দিতে হয়, তবে থাকিলো দুই, তার মধ্যে একটা চাখিয়া দেখলাম মুই। তবে থাকিলো এক, ঐ পাতপানে চাহিয়া দেখ। এখন হইস যদি মানষের পো, তবে কাঁটাখান খাইয়া মাছখান থো, আমি যেই মেয়ে, তেই দিলাম হিসাব কয়ে।।
কত্তা আর গিন্নির সংসার। কর্তা মহা কৃপণ। গুণে গুণে ছয় গন্ডা অর্থ্যাৎ ২৪ টি পুঁটিমাছই বোধহয় কিনে এনেছেন। প্রতি গরাসে একখান করে মুড়া খাইবেন এই আশা। কিন্তু গিন্নিও কম যান না। তাঁরও বড় নোলা। মাছ ভাজতে ভাজতে সব সাবাড় করে ফেলেছেন। এখন উপায় কি? কত্তার পাতে এক বাটি ঝোলে এক খানি মোটে কুচো মাছ। রেগে অগ্নিশর্মা কত্তা হিসেব চাইছেন। আর গিন্নিও আগডুম বাগডুম গুলগপ্পো ফেঁদে কত্তাকে ছড়া কেটে তার হিসাব দিচ্ছেন।। ছড়াটির মধ্যে সামান্য সংসার জীবনের এক চালচিত্র যেমন আঁকা তেমনি শেখানো হচ্ছে গাণিতিক হিসাব।।
কিংবা,
ছিঃ ছিঃ ছিঃ রানী রাঁধতে শেখেনি, জ্যাঠাইমাকে বলে, ঝোলে মশলা দেব কি? শুক্তুনিতে ঝাল দিয়েছে, অম্বলেতে ঘি, পরমান্ন রেঁধে বলে ফ্যান গালবো কি, ভোজবাড়িতে খোঁজ পড়েছে এখন উপায় কি? ছিঃ ছিঃ ছিঃ রানী রাঁধতে শেখে নি।।
রান্না ছাড়া আর কিছু দিয়েই তখন মেয়েদের নিজের গুণ প্রকাশের রাস্তা নেই। সেই রান্না না শিখতে পারার জন্য মেয়েটি বিদ্রূপের শিকার।
আতা গাছে তোতাপাখি, ডালিম গাছে মৌ, কথা কও না কেন বৌ? কথা কইবো কি ছলে, কথা কইতে গা জ্বলে।।
যোগীন্দ্রনাথ সরকারের এই বিখ্যাত ছড়াটিতে ছোট ছোট ছন্দবদ্ধ শব্দগুলি দিয়ে যেন তুলিতে একটি সংসার পট আঁকা। তাই না?
আবার,
এলাডিং বেলাডিং সইলো, কিসের খবর হইলো, রাজামশাই একটি বালিকা চাইলো, কোন বালিকা চাইলো, সবচেয়ে চিকণ যাহার গড়ন সেই বালিকা চাইলো, বলো বলো কি নাম তার??
তখন একটি নির্দিষ্ট বালিকার নাম বলা হচ্ছে। এবং বালিকা দলের সাথে ছদ্ম পাইক পেয়াদা দলের একটা টানাটানি হচ্ছে। এটাই ছিল আমাদের শৈশবের খেলার বিষয়বস্তু। কিন্তু তখন আমরা জানতাম কি, এই ছড়ার ভিতরে রাজার বরকন্দাজ পাঠিয়ে গ্রামের সুন্দরী মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে তীব্র নারীনিগ্রহের একটি বেদনাদীর্ণ কাহিনীও লুকিয়ে আছে? হয়ত এমনই কোনো নাম না জানা নির্যাতিতা নারী তাঁর কাহিনী আমাদের জন্য বলে রেখে গেছেন শিশুদের মুখে মুখে খেলাধুলার আঙ্গিকে।।
তাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এইসব ছড়াগুলি কেবল মাত্র ক্রীড়ার আমোদে মেতে থাকা শব্দগুচ্ছ নয়। আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানবিক ইতিহাসের এক একটি হলুদ বিবর্ণ হয়ে যাওয়া দলিল।।
আরও খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসবো আপনাদেরই শৈশবের রঙ দিয়ে তৈরি ইতিহাসের একটি একটি জীর্ণ পাতার গল্পগুচ্ছ।।

চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register