Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব - ১৮)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব - ১৮)

গোপনে গড়েছে কত স্বপ্নিল সাঁকো

এই বৈশাখ মাসটা রবিভাবনাতেই পরিপূর্ণ। পয়লা বৈশাখ থেকে পঁচিশে বৈশাখ, তারপরও রেশ থেকে যায় রবিকবির।
খুব গরম পড়েছে। আজ রাতে বাড়ির সবাই উঠোনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। সুধাময় গড়গড়াতে হুঁকো টানছেন।ছুটির ছোটদাদা পিকুকে বললেন - রবীন্দ্রনাথের "পুরস্কার " কবিতাটা শেখা আছে?
-হ্যাঁ বাবা।
-আবৃত্তি করে শোনাও তো? পারবে?
-হ্যাঁ বাবা পারব।
-দীর্ঘ কবিতা।
-হ্যাঁ বাবা এগারো /বারো পৃষ্ঠার হবে।
দীর্ঘ চওড়া কোয়ার্টারের উঠোন। ধূ ধূ করে ওই নীলাভ পাহাড়ের দিক থেকে চমৎকার হাওয়া এসে দেহমন জুড়িয়ে দিচ্ছে।
পিকু শুরু করল।
সেদিন বরষা ঝরঝর ঝরে
কহিলা কবির স্ত্রী
রাশি রাশি মিল করিয়াছ জড়ো
রচিতেছ বসি পুঁথি বড়োবড়ো
মাথার ওপর বাড়ি পড়োপড়ো
তার খোঁজ রাখো কি?
গাঁথিছ ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্ব
মাথা ও মুন্ডু ছাই ও ভস্ম
মিলিবে কি তায় হস্তী অশ্ব
না মিলে শস্যকণা
অন্ন জোটে না কথা জোটে মেলা
নিশিদিন ধরে এ কী ছেলেখেলা
ভারতীরে ছাড়ি ধরো এইবেলা লক্ষ্মীর উপাসনা.....
এবার কবির স্ত্রী কবিকে রাজার কাছে যেতে পরামর্শ দিচ্ছেন। রাজা মহেন্দ্র রায় গুণীজনের পৃষ্ঠপোষক এবং কাব্যমোদী। কবি মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। কবিপত্নী বলছেন -
আমাদের রাজা গুণীর পালক
মানুষ হইয়া গেল কত লোক
ঘরে তুমি জমা করিলে শোলক
লাগিবে কীসের কাজে!
কবি দেখছেন সামনে বিপদ। তবু স্ত্রীকে খুশি করার জন্যে বলছেন -
এই বৈ তো নয়
আমি বলি আরো কী করিতে হয়
প্রাণ দিতে পারি শুধু জাগে ভয়
বিধবা হইবে পাছে....
কিন্তু রাজসভায় যেতে সাজগোজ তো করতে হয়। কবির চাই হেমকুন্ডল, মণিময় তাজ, কেয়ুর, কণকহার, কবির চাই সারথি যে ভালো দেখে ঘোড়া বেছে নিয়ে কবিকে রাজসভায় নিয়ে যাবে।
কবিপত্নী তো কবির চাইতে কিছু কম যান না, তিনি বলছেন -
মুখাগ্রে যার
বাধে না কিছুই কী চাহে সে আর,
মুখ ছুটাইলে রথাশ্বে তার না দেখি আবশ্যক।
কবিপত্নী রাজসমীপে যাওয়ার বেশবাস পাড়াপ্রতিবেশির কাছ থেকে এতক্ষণে জোগাড় করে রেখেছেন। কবিপত্নী নিজহাতে কবিকে সাজিয়ে দিলেন।
পত্নীর একান্ত অনুরোধ কপট রাগ অভিমান এবং অবশ্যই পত্নীপ্রেম গৃহকোণ ছেড়ে কবিকে নামিয়ে দিল রাজপথে। রাজদরবারে ঢুকে কবি ভীষণ বিপদাপন্ন।
রাজসভাসদ সৈন্য পাহারা
গৃহিনীর মত নহে তো তাহারা,
সারি সারি দাড়ি করে দিশেহারা
হেথা কি আসিতে আছে।
হেসে ভালোবেসে দুটো কথা কয়,
রাজসভাগৃহ হেন ঠাঁই নয়,
মন্ত্রী হইতে দ্বারী মহাশয়
সবে গম্ভীর মুখ....
কবি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে, শত শত লোক কত কী
দরবার নিয়ে এসেছে। রাজার কৃপা সবার প্রতি বর্ষিত হচ্ছে। কারো কন্যাদায়, কারো পিতার শ্রাদ্ধ,  রাজা সবাইকেই দাতাকর্ণের মতই সাধ্যমত বরাদ্দ দিয়ে চলেছেন। কবি কী করবে ঠিক বুঝে পায় না। অত:পর রাজার নজর পড়ল বিপন্ন কবির দিকে।
কহে ভূপ হেথা বসিয়া কে ওই
এসো তো মন্ত্রী সন্ধান লই।
কবি কহে ওঠে,  আমি কেহ নই
আমি শুধু এক কবি।
কাব্যমোদী কবি উৎসাহিত হয়ে বলে উঠলেন -
বটে, এসো এসো তবে, আজিকে কাব্য আলোচনা হবে
বসাইলা কবি মহা গৌরবে ধরি তার কর দুটি।
মন্ত্রী ভাবিল, যাই এইবেলা
এখন তো শুরু হবে ছেলেখেলা
কহিল, মহারাজ কাজ আছে মেলা
আদেশ পাইলে উঠি।
এরপর একের পর এক সবাই উঠে গেল। রইলেন শুধু রাজা আর কবি।
এখানে পিকু থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে-মন্ত্রী কবিতাকে ছেলেখেলা কেন বলছে বাবা? বাকিরা সবাই উঠে গেল কেন?
বাবা বললেন -কবিতা কাব্য আলোচনা সবাই তো বোঝে না!
মা বললেন - তাই বলে, এতজন সভাসদ,  এত লোক কেউ বোঝে না!
ছুটি বলে ওঠে -তবে পঁচিশে বৈশাখে তো কত লোক বসে আবৃত্তি শোনে। তাহলে রাজার লোকদের কাজগুলো বুঝি অন্যরকম?  কীসব কাজ করে এরা? কবিতাপাঠকে ছেলেখেলা কেন বলল? এত কীসের কাজ?
সবাই হেসে ওঠে।
দিদি হেসে বলে - রাজকার্য।
পিকু বলে - বাকিটা শুরু করি?
শুরু হল কবির সরস্বতী বন্দনা। অপরূপ কাব্য আবেশে সবাই যেন মুহ্যমান। পিকু বলছে -
তুমি মানসের মাঝখানে আসি
দাঁড়াও মধুর মূরতি বিকাশি
কুন্দবরণ সুন্দর হাসি
বীণা হাতে বীণাপাণি।
ছুটি চেঁচিয়ে ওঠে -ওসব সরস্বতী পুজোর চিঠিতে লেখা থাকে। সরস্বতীর ছবির নীচে।
আবার সবাই হেসে উঠল।
হাসুক সবাই। ছুটি কি কিছু ভুল বলছে?
আজকের রাতটা কী সুন্দর। এমন রাত কখনও ভুলবার নয়।
কিন্তু কবি যে শুধু রাজকন্ঠের মালা নিয়ে ফিরলেন। কবিপত্নী যে জন্যে কবিকে রাজসভায় পাঠালেন তার কিছুই না নিয়ে ফিরলেন শুধু রাজকন্ঠের মালা নিয়ে। কবির কাব্যঝঙ্কার বীণা ঝঙ্কারের মতই রাজার হৃদয়ে ঝঙ্কৃত হচ্ছে। মুগ্ধতায় বিবশ রাজা কবিকে বুকে জড়িয়ে বলে উঠলেন -
কহিলা ধন্য কবিগো ধন্য
আনন্দে মন সমাচ্ছন্ন
তোমারে কী আমি কহিব অন্য
চিরদিন থাকো সুখে।
ভাবিয়া না পাই কী দিব তোমারে
করি পরিতোষ কোন উপহারে
যাহা কিছু আছে রাজভান্ডারে
সব দিতে পারি আনি।
প্রেমোচ্ছ্বসিত নয়নের জলে
ভরি দুনয়ন কবি তারে বলে
কন্ঠ হইতে দেহ মোর গলে
ওই ফুলমালাখানি।
তার মানে?  একী হল?  যার ফুটো ছাদ দিয়ে ঘরে জল পড়ে, খাবার জোটাতে কষ্ট হয়, সে শুধু রাজকন্ঠের মালা নিয়ে ফিরল! কবির রমণীর অত:পর কী প্রতিক্রিয়া? প্রথমে তিনি অপ্রসন্ন,  মুখ নিলেন ফিরিয়ে। তারপর উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন। অত:পর ভীত কবির স্বস্তি।
এছাড়া কবিপত্নীর আর করারই বা কি ছিল? -মা হাসতে হাসতে বললেন।
ক্রমশ
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register