Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্তী (ইতিহাস কথা পর্ব ৪)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্তী (ইতিহাস কথা পর্ব ৪)

শ্রীরামপুরের কথা

ড্যানিশ কোম্পানির অধ্যক্ষ সর্টম্যান সাহেবের দূত হয়ে ফরাসী ল সাহেব চন্দননগর থেকে পৌঁছলেন বাংলার নবাব আলিবর্দী খাঁয়ের দরবারে। সঙ্গে প্রচুর উপঢৌকন। উদ্দেশ্য ড্যানিশদের জন্য গঙ্গার তীরে ওই দুটি গ্রাম। শ্রীপুর ও মোহনপুর। যথারীতি ল সাহেব নবাবের কাছ থেকে সেই অনুমতি নিয়ে ১২ দিন পরে ফিরে এলেন চন্দননগরে। সঙ্গে ৬০ বিঘা জমি প্রদানের অনুমতি পত্র এবং হুগলীর ফৌজদারকে সেই জমির অধিকার ড্যানিশ কোম্পানিকে বুঝিয়ে দেবার হুকুমনামা। নবাবের পত্র নিয়ে ড্যানিশ অধ্যক্ষ সর্টম্যান সাহেব পৌঁছলেন শ্রীপুর। হুগলীর মুঘল ফৌজদার শ্রীপুর গ্রামে ৩ বিঘা ও আকনা গ্রামে ৫৭ বিঘা জমি বুঝিয়ে দিলেন। ১৭৫৫ সালের ৮ই অক্টোবর শ্রীপুরে ডেনমার্কের রাজপতাকা উড়িয়ে জয়যাত্রা শুরু করল ড্যানিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। চারজন পাইকের হাতে উঠলো গ্রাম পাহাড়া দেবার ভার। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এত দীর্ঘসময় পরে বাংলার একটি বর্ধিষ্ণু গ্রামে স্বতন্ত্র উপনিবেশের মাধ্যমে বাণিজ্য শুরু হল ড্যানিশদের। এদিকে শ্রীপুর ও আকনায় বিদেশী বণিকদের হাতে নতুন ব্যবসার গোড়াপত্তন হলে দলে দলে যুক্তও হতে লাগলো স্থানীয় মানুষ। শ্রীপুরের বিখ্যাত গোস্বামী বংশের রামনারায়ণ গোস্বামী ও হরিনারায়ণ গোস্বামীও সরাসরি যুক্ত হলেন কোম্পানির বাণিজ্যের সাথে। তাঁদের পরামর্শ মতো শ্যাওড়াফুলীর রাজা মনোহরচন্দ্র রায়ের কাছ থেকে ড্যানিশ কোম্পানি শ্রীপুর আকনা ছাড়াও মোহনপুর, গোপীনাথপুর ও পিয়ারাপুর গ্রামের চিরস্থায়ী পাট্টা গ্রহণ করার বন্দোবস্ত করল। পরিবর্তে কর ধার্য হল বার্ষিক ১৬০১ টাকা। নগরীর প্রথম প্রশাসক নিযুক্ত হলেন ড্যানিশ কোম্পানির গভর্নর সর্টম্যান সাহেব স্বয়ং। বাণিজ্যে সুবিধার জন্য গঙ্গাতীরবর্তী অঞ্চলে তৈরি হল কুঠি ও গুদামঘর (বর্তমান এস ডি ও বাংলো)। কুঠিতে গোমস্তা হিসাবে নিয়োগ করা হল স্থানীয় এক অধিবাসীকেই। ১৭৫৫ সালের শেষদিকে সমগ্র শ্রীরামপুরের ৬০ বিঘা জমি জরিপ করবার সিদ্ধান্ত নিলেন কোম্পানির ক্যাপ্টেন জিনজেন বাল্ক। পরবর্তী কোনো পর্বে প্রশাসক হিসাবে শ্রীরামপুরে তাঁর ভূমিকার কথা আমরা অবশ্যই জানব। অঞ্চলটির সম্পূর্ণ জরিপের কাজ শেষ হলে পুরো জমিটি পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেবার প্রক্রিয়া শুরু করলেন তিনি। ডেনমার্ক অধিপতি দ্বিতীয় ফ্রেডরিক্সের নামানুসারে শ্রীপুর, মোহনপুর ও গোপীনাথপুর গ্রামতিনটির নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ হল ফ্রেডরিক্সনগর। আকনার বিখ্যাত রাম-সীতার মন্দিরের নাম অনুযায়ী কেউ কেউ বললেন শ্রীরামপুর।
কথায় কথায় যাওয়া যাক শ্রীরামপুরের বিখ্যাত গোস্বামীদের কথায়। গোস্বামীদের সমস্ত সম্পত্তি, জায়গা জমি একরকম শ্যাওড়াফুলীর রাজার পৃষ্ঠপোষকতাতেই। আসা যাক সেই গল্পে। শান্তিপুরের পরম বৈদান্তিক রামগোবিন্দ গোস্বামী তাঁর স্ত্রী সমেত শান্তিপুর থেকে চলেছেন কলকাতার দিকে। রামগোবিন্দ শান্তিপুরের বিখ্যাত পন্ডিত ভীম তর্কপঞ্চাননের মেয়ের ঘরের নাতি। ভীম হলেন শান্তিপুরের চৈতন্য পার্ষদ শ্রী অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। সুতরাং বংশ সূত্রে রামগোবিন্দের শিরায় বৈষ্ণব রক্ত বইছে। কলকাতা যাত্রাকালে শ্রীরামপুরের কাছে স্ত্রীয়ের প্রসবযন্ত্রণা শুরু হলে একরকম বাধ্য হয়েই নৌকা বাঁধতে হল ঘাটে। স্থানীয় মানুষের সহায়তায় একটি ফুটফুটে সন্তান প্রসব করলেন রামগোবিন্দের স্ত্রী। এদিকে খবর পৌঁছলো শ্যাওড়াফুলী রাজ মনোহরচন্দ্রের কাছে। দানধ্যানে তাঁর নামডাক জগতজোড়া। তাঁর রাজ্যের সীমানায় পরম ভাগবত রামগোবিন্দ গোস্বামীর স্ত্রী সন্তান প্রসব করেছেন শুনে শ্রীরামপুরে গঙ্গাতীরেই প্রচুর জায়গা জমি দান করলেন তিনি। রামগোবিন্দ রাজার দান গ্রহণে অস্বীকার করে একটি কড়ির বিনিময়ে কিনে নিলেন সেই জায়গা। এভাবেই কালের চক্রে শান্তিপুরের রামগোবিন্দের হাত ধরে গোস্বামী পরিবার এসে পৌঁছলো শ্রীরামপুরে। এরপর শুধুই উত্তরণের গল্প। গোস্বামী পরিবারের রামনারায়ণ গোস্বামী ও হরিনারায়ণ গোস্বামীর কথা কিছু আগে উল্লেখ রয়েছে। ড্যানিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান হিসাবে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে সম্পদ বৃদ্ধি করেন হরিনারায়ণ। এছাড়াও বংশের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির মূল কান্ডারী হিসাবে যাঁদের ধরা হয়, তাঁরা হলেন রঘুরাম গোস্বামী ও রাজা কিশোরীলাল গোস্বামী। রঘুরাম প্রথমে ছিলেন কলকাতার বিখ্যার জন পামার কোম্পানির মুৎসুদ্দি। পরে তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের শেয়ারহোল্ডার হিসাবেও প্রচুর উপার্জন করেন। ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক পরে উঠে গেলেও তিনি আগেই সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে ভাগ্যজোরে বিশাল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পান। শোনা যায় ১৮৪৫ সালে ড্যানিশরা শ্রীরামপুর বিক্রি করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলে রঘুরাম একাই ১২ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সমগ্র শহরটা কিনে নিতে চান। কিন্তু ব্রিটিশরা শেষমেশ আর ১ লক্ষ টাকা বেশি দিয়ে ১৩ লক্ষ টাকায় শ্রীরামপুর ক্রয় করে। এমনই ছিল শ্রীরামপুরের গোস্বামীদের প্রতিপত্তি। পরে রঘুরামের পৌত্র কিশোরীলাল 'রায় বাহাদুর' ও 'রাজা' উপাধি পান। আজও রাজা কিশোরীলাল গোস্বামীর কাছারী বাড়িটি থেকেই শ্রীরামপুর পৌরসংস্থার কাজ রোজ পরিচালিত হয়। শ্রীরামপুর রাজবাড়ির দুর্গাপুজোও এক জীবন্ত ইতিহাস। পরিবারের মানুষদের কাছে শোনা যায় এই পুজোয় সংগীতানুষ্ঠানে গান গেয়ে গেছেন অ্যান্টনি কবিয়াল, ভোলা ময়রা থেকে বাগবাজারের রূপচাঁদ পক্ষীরাও।
ক্রমশ...
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register