Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব - ১)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব - ১)

আমার মেয়েবেলা

আমার শৈশব কেটেছে মুর্শিদাবাদ জেলার ফরাক্কায়। সেই ফরাক্কা,, যেখানে প্রকৃতি যেন নিজেকে মনের মতো করে ঢেলে সাজিয়েছে। প্রকৃতি সেখানে বাড়ির মেয়ে, পাশের বাড়ির কাকিমা। মায়ের হাতে মার খেলে যে রান্না ফেলে আগে ছুটে আসত বাঁচাতে। যে কাকিমা মায়ের মতো শাসন করত, বন্ধুর মতো মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করত প্রেমে পড়লে বলিস কিন্তু ।
ফরাক্কার কোয়ার্টার গুলো পরপর সুন্দর করে ছবির মতো সাজানো ছিল। সব কোয়ার্টার গুলোই মোটামুটি বাইরে থেকে একই রকমের দেখতে ছিল। একসঙ্গে দুটো কোয়ার্টার বা চারটে কোয়ার্টার তারপর একটু গ্যাপ। কোনও গুলো আবার একটা একটা। মাঝে বেশ খানিকটা গ্যাপ। এক এক ক্যাটাগরির এক এক রকমের কোয়ার্টার। এই গ্যাপ থাকার জন্য সব কোয়ার্টার এর সামনে পাশে প্রচুর ফুলের ফলের গাছ লাগানো হত। সবজির চাষও করা হত।
আমার একদম প্রথম জীবন কেটেছে একসঙ্গে চারটে কোয়ার্টার এর ক্যাটাগরিতে। পরে আবার দুটো ক্যাটাগরিতে।। তবে আমার মধ্যে কোনও দিন এসবের হেলদোল ছিল না। বাবা কেন বড়ো কোয়ার্টার পায়নি,, বা আমরা যদি অনেক বড়ো কোয়ার্টারে থাকতে পারতাম তাহলে আরও ভাল থাকতাম আরও সম্মান পেতাম। আসলে আমি কোনও দিন এসব ভাবিই নি কারণ আমি সেই ছোট্ট বেলা থেকেই নিজের পরিচয়ে বাঁচার চেষ্টা করতাম। পছন্দ করতাম সেইভাবে বাঁচতে আর তারজন্য গোপনে নিজেকে তৈরিও করতাম। এখনও তাই।আমার জীবনে কোনও দিন আমি আমার প্রয়োজনে আমার বাপের বাড়ি বা শশুড় বাড়ির পরিচয় কখনও ব্যবহার করিনি। আমার পরিচয় আমি নিজেই।। তো যাইহোক ফরাক্কায় এসব খুব দেখেছিলাম। আমার বন্ধুদের মধ্যেও ছিল। ওর বাবা বড়ো ইঞ্জিনিয়ার, ওর বাবা ড্রাইভার, ওর মা হসপিটালে আয়ার কাজ করে। আফটার অল সাহেবের ছেলে সাহেবই হয়।। এসব তো ইন্ডাস্ট্রিয়াল জায়গায় চলেই।। এখন ও শুনি অনেকের মুখে। তবে আমি তখনও ছিলাম আত্ম ভোলা এখনও তাই।।
যা বলছিলাম আমাদের ফরাক্কায় প্রকৃতি মনের আনন্দে যেন নেচে নেচে বেড়াত। ঝকঝকে পিচের চওড়া পরিষ্কার রাস্তা। রাস্তার দুধারে বড়ো বড়ো গাছ একে অপরের সঙ্গে ঝুঁকে প্রেমালাপে ব্যস্ত। ফলে প্রতিটি রাস্তাই একটু মেঘলা আধো অন্ধকার কেমন যেন কুয়াশা জড়ানো।রাস্তায় অত কটকটে রোদ ছিল না। রাস্তার ধারে গরম কালে গাছের ছায়ায় দু দন্ড জিরোনো যেত।। গাছে গাছে কোকিলের ডাক, ঘুঘু পাখির ঘুউউউঘূ , টিয়া কাক চড়ুই কাঠবেড়ালির ব্যস্ততা,,শালিকের ঝগড়া,,, রাস্তার ধারে ফণীমনসা আকন্দর জঙ্গল থেকে গুণগুণ একটা আওয়াজ পেতাম।
ভোরে ফুল তোলার কাজটা একটা নৈতিক দায়িত্ব এবং কর্তব্যের মধ্যেই নিয়ে ছিলাম। প্রতিদিন মোটাসোটা আকন্দ ফুলের মালা শিব ঠাকুরকে উপহার দিতাম। বলা যায় খুব তুষ্ট রাখতাম, ঘুষ দিতাম মাথায় বেলপাতা দিয়ে। মা বলেছিল - শিব ঠাকুরকে বলবি তোমার মত বর চাই। প্রথম প্রথম মায়ের কথা মতো তাইই বলতাম। কিন্তু একটু জ্ঞান হতে আর বলিনি। তখন শিব ঠাকুরের কাছে একটাই অনুরোধ করতাম গলায় মালা পরিয়ে,,
ঠাকুর মদ গাঁজা সিদ্ধি ভাঙ খাওয়া, খালি গায়ে বাঘছাল পরা, শ্মশানে মশানে ঘোরাঘুরি করা বর আমার চাই না। তাতে যদি আমার বিয়ে না হয়, না হোক। আমি মা দুগ্গার মতো আত্মহত্যা করতে পারব না। তখন তো আমি আবার শশী কাপুরের প্রেমিকা। অমন ছাই মাখা খালি গা ওলা শিব ঠাকুর আমার পছন্দ হবে কেন?
স্কুল ছুটির দিনে ভাই এর সঙ্গে বেরিয়ে পরতাম ঘুড়ি লাটাই নিয়ে। লাটাই ধরে একটা গাছের তলায় বসে থাকতাম। ভাই সব বুঝিয়ে টুঝিয়ে আমাকে বসিয়ে সাইকেল চালাত। সামনেই চালাত। বেশি দূরে যেত না। খেয়াল রাখত। আমি ঠিকমতো ঘুড়ি ওড়াতে পারছি কিনা।
তখন তো অত কাটাকাটি রেষারেষি ছিল না। যে যার মতো পাড়ায় ঘুড়ি ওড়াতে ব্যস্ত । তাই ঘুড়ি দেখলেই ওমনি কাটতে হবে এসব অত ছিল না। একটা ঘুড়ি দু পয়সা। মুখের কথা! ঐ একটা ঘুড়ি বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে কত দিন চালাতে হত। তখন আমাদের হাতে পয়সা কোথায়? অবশ্য তাতে আমাদের দুঃখ ছিল না। আসলে পয়সা না থাকার সেই দুঃখ বোধটাই তো ছিল না। চাহিদা ছিল না কোনও কিছুরই। যা পেয়েছি তাই যথেষ্ট ভেবে নিতাম। তাই আমরা তখন খুব ভালও ছিলাম, আনন্দে ছিলাম। যদি কেউ কখন সখন ঘুড়ি কাটল,, আমি কান্নাকাটি করে ঘুড়ি ঠিক ছাড়িয়ে আনতাম। কারণ ঘুড়ি না আনলে পরবর্তীতে লাটাই ধরার সাধ অধরাই থেকে যাবে এ আমি বিলক্ষণ জানতাম।
পাড়ায় আমাদের অত বয়েসের শ্রেণী বিভাগ ছিল না। ওয়ান থেকে ফোর একটা বিভাগ আর ফাইভ থেকে যত বয়সই হোক সব এক সঙ্গে খেলা করতাম। ডাংগুলি,,, ফুটবল,,, কাঁচের গুলি,,, মার্বেল,,, কাবাডি,, ক্রিকেট,, ঘুড়ি ওড়ানো,, সাইকেল রেস,, লুকোচুরি, ছোঁয়াছুঁয়ি,, সব চলত একসঙ্গে। আর একটা ছিল। আমরা সাইকেলের টায়ার চালাতাম একটা লাঠি দিয়ে। বেশ লাগত কিন্তু। তবে কিতকিত,, এক্কাদোক্কা আর পুতুল খেলা ছেলেরা কিন্তু কিছুতেই খেলত না। আমার ভাইকে তো কোনও দিন এই তিনটে খেলায় পেতামই না। এটা নাকি ছিল একদম মেয়েদের। এই একটা ব্যাপারে ওদের আবার সুপার ইগো কাজ করত। তবে পুতুলের বিয়ে হলে তখন সব সার বেঁধে খেতে আসত । আমি বলতাম খেলবি না তো খেতে আসিস কেন? ওরা বলত আমরা বর যাত্রী।
মরুক গে যাক্ । খেলে খেলবে না খেলে না খেলবে আমার কিচ্ছু যায় আসেনি কখনও । তবে হ্যাঁ আমাকে মেয়ে বলে কোনও খেলায় বাদ দিলে কান্নাকাটি ঝগড়াঝগড়ি করে খেলাটাই বানচাল করে দিতাম। তাই যে কোনও খেলায় দল নির্বাচনের সময় আমার নাম থাকত সবার আগে।
তখন আমরা একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসতাম। গোটা পাড়াটা যেন একটা বৃহৎ একান্নবর্তি পরিবারের মতো ছিল। সবকিছুই একসঙ্গে মানে যেকোনো কাজই খুব দলবদ্ধ ভাবে করা হত। আপন পর এই জ্ঞানটাই ছিল না।
সকালে উঠে ফুল তোলা আমার একটা নেশা ছিল বলা যায়। সারা রাত ফুলের গন্ধেই কাটত আমার। বাবার বাগানের সখ ছিল। কোয়ার্টার এর সামনে সারা বছর নানা ধরনের ফুল ফুটে থাকত। গরম কালে বেলফুলে গাছটাই দেখা যেত না। কি যে গন্ধ ! আহা। এই এত্তো বড়ো বড়ো ফুল ফুটত। বাবার হাতে যাদু ছিল। কোয়ার্টার এর সামনের জমিতে ফুল গাছ লাগানো হত। আর পাশের জমিতে নানা ধরনের সবজি ফলানো হত। আমরা বছরে মাত্র তিন চার মাস আলু পেঁয়াজ কিনতাম। তবে বাগানের গল্প পরে একদিন। আজ শুধু ফরাক্কার কথা ।।
ফরাক্কা স্টেশনে বা বাস স্ট্যান্ডে নেমে আগে আমরা ঘোড়ার গাড়িতে (টাঙ্গা)করেই ব্যারেজের মধ্যে ঢুকতাম। সাইকেল রিক্সাও ছিল। কিন্তু প্রথম টার্গেট টাঙ্গা। টাঙ্গাতে না চড়লে যেন দিনটাই মাটি, ফরাক্কায় আসাটাই বৃথা। দাদুর বাড়ি থেকে বাসে করে ফরাক্কায় নেমেই বাবাকে বলতাম বাবা টাঙ্গা,, সামনে সিট আছে কিনা দেখ।
টাঙ্গার ঘোড়াগুলো ছিল বেশ তাগড়াই। বেশ সাজুগুজু করে থাকত। তবে যত না দৌড়োত, তার থেকে বেশি হাঁচত। মুখ দিয়ে যে কত রকমের আওয়াজ বের করত। ওদের ভালই খেতে দিত টাঙাওলা কাকুরা। কৃপণতা করত না। বেশ গতর ছিল। কিন্তু শুধু ছোলা খেয়ে আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে এত শক্তি যে কোথায় পেত,, এটা আমার খুব বড়ো জিজ্ঞাস্য ছিল সেই সময়।

হঁড়র হঁড়র শব্দ করে কি ছুটত বাপরে! আমি সামনের দিকে বসতাম। যে কোনও গাড়িতেই সামনে বসতে আমি খুবই ভালোবাসি। সব ঠিকঠাক পর্যবেক্ষণ করা যায় আরকি। তো যাই হোক ঘোড়া সটাং করে এক চাবুকের মার খেয়ে চলতে শুরু করত।। যখনই টাঙাতে লোক উঠতে শুরু করত ওরা ঠিক রেডি হয়ে যেত। দুটো পা সমানে মাটিতে ঠুকতো। অধৈর্য হয়ে উঠত। মাথাটা এদিক ওদিক দোলাত। হঁড়র হঁড়র শব্দ করে ফ্যাঁচাত ফ্যাঁচাত হাঁচত। টাঙ্গা সওয়ারিতে ভর্তি হয়ে গেলেই পিঠে চাবুক।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register