Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সম্পাদকীয়

maro news
সম্পাদকীয়

ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা …….

দুই ভাই বোন, যম আর যমী, মতান্তরে যমুনার সম্পর্কের সূত্রে এই যে ভাইফোঁটার ছড়া, এর মধ্যে কোথাও একটা ফাঁক রয়ে গিয়েছে। সেটা বুঝতে হলে বেদের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই! কেন না, বেদ অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বারবার বলে- যমী কস্মিনকালেও যমকে ভাইফোঁটা দেননি! যম এবং তাঁর বোন যমীর কথা আমরা প্রথম পাচ্ছি ঋগ্বেদে। তাঁদেরকেই বলা হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম পুরুষ এবং নারী। এখানেই শেষ নয়। যমই সেই মানুষ যাঁর পৃথিবীতে প্রথম মৃত্যু হয়। খেয়াল না করলেই নয়, এখানে বোনটির নাম কিন্তু যমী। যমুনা নয়। বেশি নয়, মাত্র তিনটি সূক্তে বলা হয়েছে এই যম-যমীর কথা। জানা যাচ্ছে, বিবস্বত অর্থাৎ সূর্যের যমজ পুত্র-কন্যা এই যম আর যমী। এর পরের সূক্তে যম আর যমীর সম্পর্ক নিয়ে যা বলছে বেদ, তাতে চমকে উঠতে হয়। আজ ভাইফোঁটার দিনে সবিস্তারে সে কথা আলোচনায় যাবো না৷ শুধু ঋকবেদে উল্ল্যেখিত যমের উক্তি তুলে ধরলাম৷ যমীকে রাত্রি এবং যমকে দিন সম্বোধন করে ঋগ্বেদ যমের বকলমে বলছে, “যদি এক মুহূর্তের জন্য পরমেশ্বর পৃথিবীর সাধারণ অক্ষে ও কেন্দ্রবিন্দুতে সূর্যের গতি হ্রাস করে দেন এবং সূর্যের আলো যদি দিন ও রাত্রিতে থেমে যায়, তখন পৃথিবী এবং অন্তরীক্ষ একত্র হবে। এদের মতো তখন আমরাও (দিন ও রাত) একত্র হব, রাত্রি কোনও বাধা ছাড়া দিনের সঙ্গে দাম্পত্য মিলন উপভোগ করবে৷ হে রাত্রি! কিন্তু ওই সময় অনেক অনেক বছর পরে আসবে। যখন গতিপথ বিপরীতমুখী হবে, তখনই একত্রে এবং সহঅবস্থানে থাকা হবে অসঙ্গতিহীন৷ তাই এ সময়ের জন্য হে প্রিয়ে ও ভদ্রে, তোমার প্রেমের হাত আমি ছাড়া আর অন্য কারও প্রতি বাড়িয়ে দাও, যে হবে প্রকৃত পুরুষোচিত স্বামী৷”
আবার শতপথ ব্রাহ্মণ, গোপথ ব্রাহ্মণ এবং তৈত্তিরীয় সংহিতা যম-যমীর অর্থ করেছে আগুন আর পৃথিবী। মহর্ষি যাস্ক, যিনি বেদের ব্যাখ্যাকার রূপে সুপ্রসিদ্ধ, তাঁর রয়েছে অন্য এক ব্যাখ্যা। ও দিকে, ঋগ্বেদ না বললেও যম আর যমীকে স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্কে বাঁধছে কিছু পুরাণ। তারা বলছে, দিন এবং রাত্রি স্বামী-স্ত্রীর মতোই পরস্পরের পরিপূরক। অতএব, দিনরূপী যমের স্ত্রী হিসেবে রাত্রিরূপী যমীকে অস্বীকার করা অর্থহীন। এই মতে সায় দিচ্ছে বৌদ্ধধর্মের তান্ত্রিক শাখা বজ্রযানও। বজ্রযানী বৌদ্ধ ধর্মে যমের নাম বজ্রসত্ত্ব। বেদ যেখানে শেষ করেছে যমীর কথা, পুরাণ সেখান থেকেই শুরু করেছে যমুনার আখ্যান৷ অতঃপর মৃত্যুর পরে দেবতাদের আশীর্বাদে যম হলেন প্রধান লোকপাল, নরকের রাজা। আর তাঁর বিরহে কাতর হয়ে চোখের জলের ধারা নিয়ে যমুনা নদী হয়ে বয়ে গেলেন পৃথিবীতে। তাঁর বিবাহ হল কৃষ্ণের সঙ্গে। মতান্তরে, বলরামের সঙ্গে। আর সেই বিবাহিতা যমুনার উপাখ্যানে পাব ভাইফোঁটার প্রসঙ্গ। যা নিতান্ত লোককথা। যার কোনও বৈদিক বা পৌরাণিক ভিত্তি নেই।
মৃত্যুর পরেও ভাই তাঁর ধারণ করেছেন শরীর। যম এখন নরকের রাজা। ফলে, তিনি আমন্ত্রণ পাঠালেন যমের কাছে। তাঁকে দেখার জন্য। যম যে দিন এসেছিলেন যমুনার কাছে, সেই দিনটি ছিল এই কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। ভ্রাতা এই দ্বিতীয়া তিথিতে এলেন বলেই তার নাম ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। যমকে দেখে তখন যমুনা কী করলেন? না, স্বাগত জানাবার জন্য তাঁর কপালে পরিয়ে দিলেন টীকা! তাঁকে খেতে দিলেন নানা সুস্বাদু মিষ্টান্ন। তৃপ্ত যম কথা দিলেন, যমুনার দেখাদেখি যে নারী এই ব্রত করবে, তার ভাইয়ের আয়ু বৃদ্ধি পাবে। যমের মতো সে অকালে বোনকে ছেড়ে চলে যাবে না। এভাবে ঋগ্বেদের আখ্যানকে লোকাচারে বাঁধল লোককথা। এখানেও ভাতৃদ্বিতীয়ার আর এক আখ্যান পাই৷ ভাইকে স্বাগত জানাবার এই এক প্রথার কথা শোনা যায় কৃষ্ণ আর সুভদ্রার উপাখ্যানেও। সেই কাহিনি বলে, ধনত্রয়োদশীর পরের দিন চতুর্দশী তিথিতে নরকাসুরকে বধ করলেন কৃষ্ণ। তার পর প্রাগজ্যোতিষপুর থেকে দ্বারকায় ফিরে এলেন দ্বিতীয়া তিথিতে। কৃষ্ণকে দেখে সুভদ্রার উচ্ছ্বাস বাধা মানল না। তিনি বরাবরই কৃষ্ণের আদরের বোন। এই কয়েকদিন তিনি দাদাকে দেখতে পাননি। তার উপর আবার খবর পেয়েছেন সুভদ্রা, নরকাসুরের অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়েছেন কৃষ্ণ। অতএব, দ্বারকা পৌঁছতেই কৃষ্ণকে তিনি বসালেন আসনে। তাঁর কপালে পরিয়ে দিলেন বিজয়তিলক। এবং, মুখমিষ্টি করালেন। সেই প্রথাই স্বীকৃত হল ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা নামে। আবার ভারতের সবচেয়ে পবিত্র মন্দিরগুলোর একটিতে, নীলাচলক্ষেত্রে দাদা কৃষ্ণ-বলরামের সঙ্গেই অবস্থান করছেন সুভদ্রা। আর ভাগবত-মহাভারত ধরলে তিনি জীবনের অধিকাংশ সময়টাই কাটিয়েছেন দাদাদের সঙ্গে দ্বারকায়। অর্জুনের সঙ্গে স্বামীগৃহে গিয়েছিলেন মাত্র একবার!
তাহলে এখানে বড় প্রশ্ন, যম যমী বা যমুনাই কেন, ভাইফোঁটার ছড়ায় স্থান পেল, যেখানে পুরাণ এবং বেদ দুই জায়গাতেই তাদের সম্পর্কের স্বচ্ছতা নিয়ে বারবার বিরূপ মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়েছে ! কৃষ্ণ বলরাম সুভদ্রার সম্পর্কও তো সেই মর্যাদা পেতে পারত ! কখনও কখনও ধর্ম ত্বত্তজ্ঞান বেদ পুরাণকে গৌণ করে দেয় লোকের বিশ্বাস৷ তাই এক্ষেত্রে মানুষই বড় হয়ে উঠে, তাঁর লোক উপাখ্যান বলুন আর লোকাচার ধীরে ধীরে লোকমুথে সংযোজিত পরিবর্তিত হতে হতে বর্তমান এই " যমের কপালে দিলাম ফোঁটা....." ছড়ার জন্ম ৷
সে যাই হোক, মৃত্যুর দরজা থেকে ভাইকে ফিরিয়ে আনার এই উৎসব দুটো প্রাণকে অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে ফেলে৷ ভাই-বোনদের সঙ্গে বন্ধন আরেকটু মজবুত করে নেওয়ার । দাদা-ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে যমের দুয়ারে কাঁটা দেওয়ার কাজ এদিন সেরে রাখলেন দিদি-বোনেরা। পাল্টা উপহার ও আশীর্বাদের মাধ্যমেও নিজেদের ভালোবাসা উজাড় করে দেয় ভাইরা। বাঙালিদের মধ্যে এই দিন পরিচিত ‘ভাইফোঁটা’ বা ‘ভাতৃদ্বিতীয়া’ হিসেবে। অন্যদিকে অবাঙালি সমাজ বা মূলত হিন্দিভাষীদের জন্য আজকের দিন ‘ভাইদুজ’। নাম আলাদা হলেও এই দিনের বিশেষত্ব একই।
✍️ রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register