Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব - ১৪)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব - ১৪)

গোপনে গড়েছে কত স্বপ্নিল সাঁকো

সেই আকাশ কিন্তু সেভাবে আর দেখা হল না ছুটি যেভাবে দেখেছিল, সেই স্বচ্ছ নিবিড় অগণিত নক্ষত্রখচিত আকাশ, সেই দূষণমুক্ত খোলা স্বচ্ছ আকাশ, সেই আকাশ আর দেখা যায় না। অদ্ভুত এক ধোঁয়াশার ঘোরে আকাশ আচ্ছন্ন থাকে। ধোঁয়াশার আড়াল থেকে দু'চারটে তারা ফুটফুট করে। আমি ছাদে যাই, রাস্তার যানবাহনকে অনেকটা ভারসাম্যহীন জরাগ্রস্ত ডাইনোসরের মতো মনে হয়। ৷ সেই মুক্ত আকাশ ছুটিকে কি বার্তা দিয়েছিল? দিয়েছিল অবাধ অগাধ হবার বার্তা, দিয়েছিল দক্ষিণের জানালা হাট করে খুলে, হু হু করে ভুবন পাহাড় থেকে পাহাড়ি হাওয়া এসে ঢুকে পড়ার বার্তা। আর এখন সন্ধ্যা হতে না হতেই জানালা দরজা বন্ধ করে আলো জ্বালিয়ে দিই। টুকাই এর ফোন আসে। "মা, কবে আসবে?" বলি - আসছি সোনাবাবা, এই তো ক'দিন পর গরমের ছুটি পড়ছে। চলে আসব। টুকাই বেশি সময় ফোন ধরে রাখতে পারে না। কথা বলে কম, কিম্বা একই কথা বারবার বলে। টুকাই এর জগতে যে আলোআঁধারির রহস্যময়তা, কেউ তা বোঝে না। ৷ অটিজম একটি জটিল মানসিক কিম্বা বলা ভালো বৌদ্ধিক বিক্রিয়া যার সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আজ অবধি সেভাবে করে ওঠা সম্ভব হয়নি। একেবারে শৈশবে আরও দশটা শিশুর থেকে টুকাই এর আচরণ যখন কিছুটা আলাদা রকম হল তখন অচিনপুরের ডাক্তারের নির্দেশে দূর দক্ষিণে নিয়ে যাওয়া হল টুকাইকে। মাসখানেকের নিবিড় পর্যালোচনার পর "অটিস্টিক" শব্দের সাথে আনকোরা নতুন পরিচয় হল আমাদের। সেই থেকে চেনা অচেনা যুদ্ধের শুরু। সেই থেকে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশুদের পথচলার সাথে নিরন্তর পা মেলানো। ৷ সামনেই পঁচিশে বৈশাখ। ইশকুলে চলছে জোর প্রস্তুতি। ছোট্ট একটি নাটক হবে। "বিনি পয়সার ভোজ"। ব্যঙ্গকৌতুকের এই একক অভিনয়ে এগিয়ে এসেছে নবম শ্রেণির প্রীতম। সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন মধুরিমাদি ও তনিমা। রিহার্সালে আজ আমাকে ডেকে নিয়ে গেল প্রীতম। যেমনটা হয়ে থাকে আমার, সময়টাকে ধরে রাখতে পারি না হাতের মুঠোয়, সে শুধু পেছনের দিকে ছুটতে শুরু করে। আজ এই রবীন্দ্রজয়ন্তীর রিহার্সালে সেই পেছনের পথেই ছুটবে আমার বাঁধনহারা মন, যদিও সেটা দৃশ্যমান নয়। অচিনপুরে এই একক বাস কিম্বা বলা ভালো শুধুমাত্র ইশকুল সঙ্গী করে থাকতে শুরু করেছি যবে থেকে এক প্রচ্ছন্ন প্রেক্ষিত আমাকে বারবার পেছন থেকে ডাকছে। অথচ সময় বলে শুধু আমায় দেখো। যা ফেলে এসেছ তা আর ফিরে আসবে না। যা যায় তা দীর্ঘ যায়। তবু কিছুতেই পিছুটান ছাড়তে পারি না। পেছন ফিরে দেখি এক গাঢ় নীলাভ শূন্যতার ঢেউ। কী রহস্যময়, কী অনাবিল, কী মেদুর মনোময় আলোর সাথে মাখামাখি হয়ে আছে। উচ্চ মাধ্যমিকের পিউকে তনিমা শিখিয়ে দিচ্ছে - "প্রভু বুদ্ধ লাগি/ আমি ভিক্ষা মাগি/ ওগো পরবাসী কে রয়েছ জাগি /অনাথপিণ্ডদ কহিলা অম্বুদনিনাদে" পিউ এর উচ্চারণ সংশোধন করে দিচ্ছে তনিমা। ওদিকে মধুরিমাদি প্রীতমকে নিয়ে পড়েছেন। ওখানে হাওয়া বেশ উৎফুল্ল। ছাত্র ছাত্রী জড়ো হয়েছে বেশ। ইশকুল ছুটি হয়ে গেছে। তবু এই "বিনি পয়সার ভোজে"র মজা নিতে সবাই আগ্রহী। একক অভিনয় তো সোজা ব্যাপার নয়! প্রীতম ছেলেটি পড়াশোনায় ভালো। সরকারি বাংলা মাধ্যম ইশকুলে পড়তে আসে যারা তারা সবাই সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের ছেলেমেয়ে। বাড়িতে পড়াশোনার সেই শক্ত ভিতের কারুকাজ নেই, যা দিয়ে সে রবীন্দ্রনাথকে চিনে উঠতে পেরেছে অনেকটাই কিম্বা বুঝতে পেরেছে অনেকটাই। সুতরাং তার কাছে রবীন্দ্রনাথ মানে সিলেবাসের বইয়ে যতটুকু কিম্বা পঁচিশে বৈশাখে যতটুকু। তাই মধুরিমাদি কিম্বা তনিমাকে কসরত করতে হবে অনেকটাই। তবে হ্যাঁ, প্রীতম পারবে। খুব উৎসাহ আছে ছেলেটার। মাঝে মাঝে যা বুঝতে পারছে না জিজ্ঞেস করে জানতে চাইছে, যেটা বুঝতে পারছে না হাতের স্ক্রিপ্টে কলম দিয়ে তার নীচে রেখা টানছে আর মধুরিমাদিকে প্রশ্ন করছে।যেমন বলল- "হুঁকো কলকেও কিনে আনতে হবে? সেও তোমার বাবু লোহার সিন্দুকে পুরে রেখে গেছেন নাকি? বাঙাল ব্যাঙ্কে সেফ ডিপোজিট করে আসেন নি কেন? " প্রীতম জানতে চাইছে হুঁকো কলকে কি? তারপর বাঙাল ব্যাংক কি? তারপর বলল - "এই বুঝি বাবুর বাগানবাড়ি, তা হলে ভদ্রাসন -বাড়ি কেমন হবে জানি না।" প্রীতম 'নিম্নরেখ' করে রেখেছে "ভদ্রাসন -বাড়ি"। সুতরাং প্রশ্ন - ম্যাম, ভদ্রাসন -বাড়ি মানে কি? মধুরিমাদি এইবার একটু বিরক্ত হলেন। বললেন -তুই স্ক্রিপ্টটা এদিকে নিয়ে আয় তো। গোটা স্ক্রিপ্টটা দেখে বললেন - এতটা শব্দ বাক্য আন্ডারলাইন্ড। তোকে কি আগে সব অর্থ বুঝতে হবে, তারপর রিহার্সাল করবি? প্রীতম ছেলেটি ভারি নম্র স্বভাবের। সে কী বলবে ঠিক বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে। মধুরিমাদি এবার একটু নরম হয়ে বললেন - "ভদ্রাসন" মানে বসতবাড়ি, মানে বাস্তুভিটা। প্রীতম গলা একেবারে খাদে নামিয়ে আমতা আমতা করে বলে - তাহলে "ভদ্রাসন -বাড়ি" কেন? মধুরিমাদি এবার আমার দিকে তাকালেন। ওঁনার দৃষ্টি দেখে আমি তাড়াতাড়ি বললাম - ওটা ঐ "অশ্রুজলে"র মতই ব্যাপার আর কি। মধুরিমাদি ফিসফিস করে বললেন - আর ঝামেলা বাড়িও না তো। এখন এটাও বুঝিয়ে দিতে হবে। তনিমা ইতিমধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। সে কিছুটা শুনেছে। এবার বলল - আরে বুঝতে পারছিস না, এটা তোর গন্ডগোল। প্রীতম অবাক গলায় বলে - আমার কি গন্ডগোল? তনিমা বলে - আরে তুই মানে তুই নোস। যে বিনি পয়সার ভোজ খেতে চায় সে আর কি! যে বিনি পয়সার ভোজ খেতে আসে সে কি আর অর্থ নিয়ে ভাবে না বোঝে! এতসব অনর্থের মাঝে অর্থ সব গুলিয়ে যায় বুঝলি? মধুরিমাদি মুচকি হেসে বলেন - উফ এজন্যেই তনিমা ছাড়া একদম চলে না আমার। তনিমা তাড়া দেয়- চল চল পার্ট আগে মুখস্ত কর। সেটা হয়েছে? গোটা স্ক্রিপ্ট ঝরঝরে মুখস্ত করতে পারলে সব ঠিকঠাক হবে। কিছু এগিয়েছে? প্রীতম বলে - হ্যাঁ ম্যাম। ওটা হয়ে গেছে। মধুরিমাদি আশ্চর্য হয়ে বলেন -সে কি রে? সবটা শিখেছিস? বেশ বলতো। প্রীতম বলতে শুরু করল। গড়গড় করে বলে যাচ্ছে। আশ্চর্য, মাত্র চারদিন আগে প্রোগ্রাম ঠিক করা হয়েছে, এরমধ্যেই পুরোটা শিখে নিয়েছে প্রীতম। শুনেছি, প্রীতমের বাবা নেই। মা হাসপাতালে আয়ার কাজ করে। ধুর ছাই, এতে আমার চোখে কেন জল আসে! ক্রমশ
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register