Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ৪৬)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ৪৬)

বুনকারি আর পুপুর ঘোমটা

ছোটো পুপু বাবা মায়ের সঙ্গে গলির ১ নং বাড়িতে থাকে। একতলার এক কামরার বাড়ি। পাশের দু কামরার ঘরসংসারের মাথার ওপর দীপি পিসি, নোনা কাকুর মা, ফর্সা টুকটুকে দিদা আছেন। তাঁর বড় ছেলের ছেলে লালটু পুপুর চেয়েও বেশ খানিকটা ছোটো। ঠাকুমা তাকে ডাকেন, গোপাল। সেও দিদার মত একেবারে ধবধবে সাদা, নরম সিল্কের মত চামড়া। ঠাকুমার চুলগুলো ও ধবধবে সাদা সিল্কের মতো। সবটা চুল টেনে নিয়ে, মাথার ঠিক ওপরে একটি নিটোল বড়ির মত খোঁপা করে রাখেন। দেখে বোঝা যায়, এক কালে ছোটোখাটো একটি অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু ছোটো মাপের হলে কী হবে? কী ভয়ংকর দাপট আর গলার জোর ছিলো দিদার, ওরে বাবা!! সবাই ভয় পেতো। অত গুলি ছেলে মেয়ে, তারাও। একজন লম্বায় খাটো বহরে চওড়া কাকু ছিলেন। তার নাম দাসি। কেন যে, কে জানে। যতদূর মনে পড়ে তিনি বেশ ব্যায়ামবীর ছিলেন, গায়ে খুব জোর। বড়ো মেয়ের নাম সুন্দরী। কিন্তু ভীষণ খরখরে। ছোটো বোন দীপি পিসি,সে কিন্তু খুব মিষ্টিও ছিলো দেখতে, আর স্বভাবে ও ভারি ভালো। পুপুর মা, তার খুব পছন্দের বৌদি। দিদা সর্বদা সবাইকে এত বকেন, কিন্তু পুপুর মাকে দেখলেই গলা নেমে আদরে গলে যায়। –---দীপালি খেয়েছো? কখন ফিরলে আপিস থেকে, আহা… একেবারে মুগ্ধ হয়ে থাকতেন তিনি, এমন গরীবের পাড়ায় এত পড়াশোনা করা, অথচ এত বিনয়ী বউ দেখে। তার ওপরে দেখো, আপিস করে আসে ব্যাটা ছেলেদের মতো, কিন্তু মাথা থেকে কখনো ঘোমটাটি নড়ে না? যে কোনো সুবিধে অসুবিধে, অসুখ, মা ভেতরের ছোটো রকের পাশে, কাঠের পার্টিশন ঠেলে, মাসিমা, বলে ডাক দিলেই দিদা ছেলেমেয়েদের নিয়ে হাজির। মায়ের নিজের জ্বর, পুপুর হাম, পড়ে যাওয়া, কুকার বার্স্ট হওয়া, যত যত রকম বিপদ, এমারজেন্সি, দিদা একেবারে মায়ের মতো আগলে রাখতেন এই চাকরি করা রোগা মেয়েটিকে। আবার শিবরাত্রির পরদিন, ওই পার্টিশন পেরিয়েই এদিকে এসে যেত প্রসাদের থালা আর বেল পানার পাথরের গেলাস। সঙ্গে বাজখাঁই গলা; –--- বৌমা, ছেলেকে বলো, হাতের কাছে ব্রাহ্মণ পাবার সুবিধেটা ছাড়তে পারছিনা। আপিসে যাবার আগে ব্রাহ্মণ এ টুকু মুখে দিলে আমিও একটু পারণ সারি। বাবার সঙ্গে সরাসরি কখনো কথা বলতেন না দিদা। বয়সে ছোটো হলেও বড়োদের চিরকালই পুপু দেখতো বাবার সাথে ভারি সম্ভ্রমের সাথে কথা বলতে। বাবাও সেই রকমই মাকে ডেকে বলতেন,, মাসিমাকে বলো, আমি প্রসাদ নিয়েছি, এবার খেয়ে নেন যেন। এইসব চলতে চলতেই এসে যেত সরস্বতী পুজো। পুপুর ঠাকুমা গলির একদম শেষে, ভ্যান্টা দাদাদের বাড়ির দোতলায় থাকতেন। ভ্যান্টাদা বড়ো ভাই। তার ছোটো বকুদা। একটু লম্বা, কোঁকড়াচুল। ওরা পুপুর কাকাদের বন্ধু কিন্তু। তবু কেনো জানি ওদের কাকা বলে না, দাদাই বলে পুপু। ওদের মা খুব নরম মতো মানুষ ছিলেন। মিষ্টি করে কথা বলতেন। কিন্তু ভারি অসুস্থ। মস্ত পালঙ্কের মত খাটে বিরাট চেহারা হয়ে গেছে, সেই নিয়ে কোনো রকমে বালিশে হেলান দিয়ে একটু ওঠার চেষ্টা করতে পারতেন মাত্র। দোতলা থেকে পুপুর ঠাকুমা রাস পূর্ণিমায় মেলা হলেই পুপুকে খেলনা কিনে পাঠিয়ে দিতেন। পোড়া মাটির লাল টুকটুকে হাঁড়ি, কড়াই, উনুন, হাতা, খুন্তি, গামলা, খোঁপা করা মেয়ে পুতুল, আর সরার ওপর পাতলা কাগজে লাল রঙ দিয়ে ফুল পাতা আঁকা আর কাঠি লাগানো, সামনে দড়ি বাঁধা ট্যামটেমি। পুপু দড়ি ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেলেই আওয়াজ ওঠে,ট্যাম ট্যাম ট্যাম… আর আসতো ছোট্ট খাঁচায় পাখিরা। তাদের ঘোরালে তারা দাঁড়ে বসেই দুলে দুলে ঘুরতে থাকে। পুপু কথা বলতে শিখেই তাদের দেখে বললো, আকুমা!! সেই থেকে সে পাখি দেখলেই কয়, আকুমা। সবাই ভাবে, এ কেমন নাম? আসলে বোধহয় পুপু বলার চেষ্টায় থাকে, যে ঠাকুমার কাছ থেকেই আসে এসব মিষ্টি মিষ্টি খেলনাপাতিরা। রাসের মেলা ছোটো পুপুর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তাই। একটু বড়ো হতে, বাবার সাথে পুপু সশরীরে গিয়েছিল রাসের মেলায়। গলির শেষে, ঠাকুমার বাড়ির পিছনের দিকে গেলেই, মোড়লদের পুকুর। তাতে জল নেই এক ফোঁটা ও। কিন্তু বিরাট গর্ত। প্রায় চার পাঁচ মানুষ গভীর। আর অনেক অনেক চওড়া। মোড়লরা নাকি এখানকার মালিক ছিলেন। তাদের নায়েবখানার এজলাসটাই ঠাকুরমাদের বাড়ির মুখোমুখি, মস্ত বাড়িটা। যাতে কাকাদের বন্ধু মাঙ্কুদা, শাঙ্কুদা-রা থাকে। ওদের বাবা নাকি মস্ত ভূতত্ত্ববিদ ছিলেন। আর ওরা তাই ভারি বড়লোক। ওদের বড়ো জিপ আছে, যা চালায় ফর্সামতো সুরেনদা। এরা সবাই পুপুর বাবা মাকে ভারি সমীহ করে, পুপুকেও দূর থেকে কেমন আছো মা, বলে। বাবার সাথে পুকুরের গর্তের পাড় ধরে নিউ আলিপুরের দিকে গেলে, প্রমোদ কাকুদের বাড়ি যাওয়া যায়। আর তার আগেই রাস্তায় পড়ে পুরোনো রাজপ্রাসাদের মত ভেঙে চুরে যাওয়া বড় বড় খিলান দেয়া বাড়ি। বাবা বলেন, ছোটো রাজবাড়ী। আমার অনেক বুড়োমানুষ বলেন, ছোটো রাস বাড়ি। এখন সেখানে গরীব মানুষেরা থাকেন। সারি সারি ছোটো ছোটো মাটির মূর্তি বিক্রি হয় দালানের লম্বা লম্বা সিঁড়িতে। ওইখানেই বানানো ও হয়। কাঁচা সরস্বতী লক্ষ্মী ঠাকুর শ্যামলা মাটিতে বনে, তারপর শুকিয়ে রঙ হচ্ছে দেখে পুপু বাবার সাথে হাঁটতে হাঁটতে। এ বাড়ির পাশ দিয়ে গিয়ে ফের পিচের রাস্তা টালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, পেরিয়ে ব্রিজের দিকে এগোলে আরেকটা মহল। বড়ো রাজবাড়ী। আর সেই মহলের তোরণদ্বার পেরোলে ঘাট। সেইটা গঙ্গার ঘাট। বুড়োরা বলেন টালির নালা। দুর্গা পুজোর দশমীর দিন বাবার ঘাড়ে চড়ে পুপু ঠাকুর বিসর্জন দেখতে আসে এই ঘাটে। জোয়ারের লাল জল একবার পুপুদের গলি অবধি চলে এসেছিল কল কল করে। রাসের মেলা এইসব জায়গা ঘিরেই বসত। এইখানকার কারিগর, মহিলা পুরুষরাই তৈরী করে দিতেন অপূর্ব পোড়া মাটির হাঁড়ি ডেকনো হাতা খুন্তি মায় ছোট্ট নিখুঁত শিল নোড়া পর্যন্ত। আর এক অন্যরকম মাটির পুতুল। তেমনটি আজকের দিনে কোথাও দেখা যায়না। রাসের পরেই আসত সরস্বতী পুজো। রাসবাড়ি থেকে বাবা আর পুপু ছোট্ট ঠাকুর কিনে আনত। আর ঠাকুমার কাছ থেকে পুপুর জন্য আসতো ছোট্ট শাড়ি। বাসন্তী হলুদ, কখনো কমলা, একবার চাঁপা ফুলের মতো রঙ। পুপুকে বাবা বাঙলা করে শাড়ি পরিয়ে দিলেই সে তাড়াতাড়ি বলত, ঘোমলা দাও। মাকে সদাসর্বদা মাথায় ঘোমটা দেয়া দেখত কিনা। শাড়ি পরা হলেই তড়াক করে খাটে উঠে মাকে ডাকাডাকি। —- কি হলো, কি হলো, বলে মা রান্নাঘর থেকে এলেই মায়ের গলা ধরে কপালে নিজের কপালটা চেপে ধরে কন্যে। মায়ের কপালে টকটকে বড়ো সিঁদুরের টিপ পরা থাকে সক্কাল থেকে। পুপু কপাল ঠেকালেই তার কপালে এসে যায় মায়ের টিপ। কী আনন্দ!! ঘরের বড়ো আয়নায় দেখাতে হয় সে টিপ কোলে করে নিয়ে গিয়ে। মা হেসে মাছের মত দেখতে কাজলপাটি থেকে টেনে কাজল পরিয়ে, কপালের ধারে কালো টুক্কা দিয়ে দ্যান। আর পা ছড়িয়ে বসে থাকা মেয়ের পায়ে আলতা পরিয়ে, পায়ের মাঝখানে লাল দিয়ে ফুল আঁকা হয় তারপর। সেই শাড়ির আঁচল আর আনন্দ বুড়োবেলায় ও মনে ভেসে আসে। সাদা কালো অ্যালবামে ছবিরা হাসে। পাখি পাখি আঁকা শাড়ির ঘোমটা টানা সুন্দরী মা, তার কোলে আলতা পরা এত্তো বড় টিপ কপালে ঘোমটা দেয়া পুপু, খুদি খুদি দাঁতে হাসি আর দু হাতের মধ্যে মাকে আদর। শাড়ি পরার মজা সেই থেকেই ঘোমটা ওয়ালি টের পেয়ে গেছে কিনা।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register