Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

আজকের লেখায় চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

maro news
আজকের লেখায় চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

“অনেন উদকেন তৃপ্যতায়... ”

বছরের পর বছর দেনা শোধ না করতে পেরে তিন লক্ষ গরিব ভারতীয় এখনও দাস শ্রমিক। দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে দেশ দাস শ্রমিক নির্মূল করার প্রকল্প নেওয়ার পরেও এঁদের মুক্তি হয়নি। দাস শ্রমিকদের মুক্তির সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছিল সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী স্বামী অগ্নিবেশের নীতিনিষ্ঠ আন্দোলনের কারণে। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং তারপর সন্ন্যাস নিয়ে আর্য সভা গঠন করে একাই ভারত থেকে দাস শ্রমিক মুক্তির লড়াইকে সাফল্যে নিয়ে যাওয়া মানুষটি চলে গেলেন এই সেপ্টেম্বরেই। দাস শ্রমিকদের উপর পুলিশের গুলিচালনায় প্রতিবাদে ১৯৭৭-এ হরিয়ানার শিক্ষামন্ত্রীর মতো আকর্ষণীয় পদ মুহূর্তে ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। এমন মানুষকেও বার বার নিজেরই ধর্মের একটি বিশেষ মতাদর্শের লোকেদের হাতে আক্রান্ত হতে হয়েছে। সরকার এই পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। সেই দায় মানুষদের, যারা দাস শ্রমিকের মতো ঘৃণ্য প্রথার অবসান চান। দেশবাসী তার কাছে ঋণী। সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন ছত্তিসগড়ের খনি শ্রমিক ও উপজাতীয় মানুষদের লড়াইয়ের সাথী ইলিনা সেন। সেখানকার খনিশ্রমিক ও আদিবাসী মহিলাদের জীবন সংগ্রামের না-বলা কথা উঠে এসেছিল তাঁর লেখা ‘ইনসাইড ছত্তিশগড়ঃ আ‌ পলিটিক্যাল মেমোয়ার’‌ এবং ‘‌সুখভাসিনঃ দ্য মাইগ্রেন্ট উওমান অফ ছত্তিশগড়’ নামে দুটি বইতে। গোণ্ড, মুড়িয়া গোণ্ড, শবর ও নানা আদিম উপজাতির মেয়েরা কিভাবে দিনের পর দিন রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপোষিত শক্তির দ্বরা অত্যাচারিত, সেইসব কথা বিশ্ব জানতেই পারতো না, ওয়ার্ধার মহাত্মা গান্ধী আন্তর্জাতিক হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপিকা ইলিনা সেন না লিখলে। সালওয়া জুদুম-এর অত্যাচার প্রতিরোধে নারীর ক্ষমতায়নের নতুন মডেল অসামরিক নজরদারী বাহিনী ‘কোয়া কমান্ডো’ গড়েছিলেন নিরস্ত্র আদিবাসী নারীদের নিয়ে। তাঁর কাছে অনেক ঋণ এই দেশের নিপীড়িত মানুষের। তিনি চিনিয়েছেন সেই সব এলাকার বাস্তব চিত্র ও মানুষকে। সুখভাসিনকে চিনতেন না ভারতের মানুষও। ইলিনা সেন পূর্বপুরুষ নন, কিন্তু পূর্ব নারী। মহালয়ায় তাঁদের স্মৃতি তর্পণ করি অনুচ্চ স্বরে বলি, “অনেন উদকেন তৃপ্যতায়। অনেন তিলোকদেন তৃপ্যতায়...” – এই জলে তোমরা তৃপ্ত হও। এই তিল ও অন্যান্য খাদ্য তোমাদের দিলাম। এই আমি নতজানু হয়ে ভূমিস্পর্শ করছি। আমরা আমাদের প্রাণের পাত্র ভরে নিচ্ছি তোমাদের মধুর স্মৃতিতে। তোমরা আমাদের পূর্বজ, এই অর্পণ করছি তোমাদের তর্পণ। এবছরেই এমন আরেক প্রিয় মানুষ, দেবেশ রায়, কয়েকমাস আগে প্রয়াত হয়েছেন। ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে জড়িয়ে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠা এই বিশিষ্ট ঔপন্যাসিকের হাত ধরেই বাঙালি, এবং পরে অনুবাদের সূত্রে অন্যরাও, জেনেছেন রাজবংশী সমাজের কথা। কথকতার এক নতুন ধাঁচে বলে গিয়েছেন একের পর বৃত্তান্ত - মফস্বলী বৃত্তান্ত (১৯৮০), সময় অসময়ের বৃত্তান্ত (১৯৯৩), তিস্তা পারের বৃত্তান্ত (১৯৮৮)। তিস্তা নদীর জলধারায় পুষ্ট দেবেশ রায়ের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে এই সময়ের একমাত্র পুরাণ, তিস্তাপুরাণ, রচনা। নিজে দলিত না হয়েই তিনি ছিলেন দলিত জীবন ও সাহিত্যের অকপট পৃষ্টপোষক। লিখতে পেরেছেন বরিশালের যোগেন মন্ডল, ইউসুফ জুলেখা, যযাতি, লগন গান্ধার-দের কথা তাঁর কালজয়ী সাহিত্যে। দলিত সাহিত্য ছাড়াও বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য তার কাছে অনন্তকাল ঋণী থাকবে। তাঁর প্রতি জানাই অপরিসীম শ্রদ্ধা। অর্পণ করি তর্পণ। এরা কয়েকজন প্রতীক মাত্র। এরকম যে মানুষরা মাটির পৃথিবীর পথে নিজেদের মতো করে মাটি, জল, পাহাড়, জঙ্গল, প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশকে রক্ষা করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন, মাটির মানুষদের শক্তি দিয়েছেন, আত্মপরিচয় দিয়েছেন, তাঁদের সকলের জন্যই বলি “অনেন উদকেন তৃপ্যতায়। অনেন তিলোকদেন তৃপ্যতায়।...” আমরা চলেছি মহামারীর ভয়াবহ পথে। অতিমারী কেবল বহু জীবন ছিনিয়ে নিচ্ছে তাই নয়, গ্রাস করেছে সুস্থ জীবন ও চেতনাও। মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে সমাজ করোনা যোদ্ধাদেরও ঘরছাড়া, পাড়াছাড়া করছে! মনুষ্যত্বের পতন হলেও, মৃত্যু হয়নি। তাঁর প্রমাণ, সারা দেশে সৎকার না নিকটাত্মীয়দের ফেলে যাওয়া বহু হিন্দু নাগরিকের মরদেহ ধর্মীয় বিধি মেনে সৎকার করেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। আবার অসহায় মুসলমান নাগরিকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন হিন্দু নাগরিক, কবরের জন্য জমি দিচ্ছেন প্রবীণ হিন্দু ব্রাহ্মণ, হিন্দু গ্রামের মানুষ সচল রেখেছেন ১৫০ বছরে প্রাচীন মসজিদ। মানবতার জয়গানই প্রেরণার স্রোত। তরণী ঘোষ আর প্রদীপ দাস আমাদের ভালবাসার শহর কলকাতার দুই গরিব যুবক। বেসরকারি ঠিকেদারের হয়ে তাঁরা সাইনবোর্ড লাগানোর কাজ করতেন। আলিপুর চিড়িয়াখানার দেওয়ালের ভিতরে রাস্তার ধারে সাইনবোর্ড লাগাতে গিয়ে লকডাউনের মধ্যে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। পেটের দায়ে তাঁরা যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, সিইএসসি-র বিদ্যুতের তাঁদের ছিনিয়ে জীবন নিয়ে গিয়েছে। এভাবেই আনলকের প্রথম ধাপ থেকে মালিকদের নিরাপত্তা বিধি না মেনে কারখানা খোলার চেষ্টায় গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র সহ সারা দেশে মৃত প্রায় ১৫০ জন শ্রমিক। বেসরকারি কারখানার সঙ্গে এই অপরাধে অভিযুক্ত কেন্দ্র সরকারের নিয়েভেলি লিগনাইট কারখানাও। সরকারি তথ্য বলছে, শুধু গুজরাটেই এই পর্বে ৫১টি শিল্প দুর্ঘটনায় ৭৪ জন শ্রমিক মারা গিয়েছেন। জানুয়ারি থেকে জুলাই এর মধ্যে ১৩০ জন শ্রমিক শিল্প দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন গুজরাটে। বয়সের ভারে বা রোগে ভুগে তাঁরা মরেননি, মালিকরা কার্যত তাঁদের মরতে বাধ্য করেছেন। এর জন্য দায় কার, তাঁর কোঁজ হবে না। অমিতাভ দাশগুপ্ত লিখেছেন, “কে বা কারা দায়ী?/ অনন্ত ডিবেট শুনে নিশ্চিন্তে শুয়েছে আততায়ী/ সঠিক সময়ে তার ছুরি/ ফের ছিঁড়ে নেবে দশ বিশ কুঁড়ি।” এই পৃথিবী তাঁদের বাঁচার পথ দেয়নি। আজ অন্তত তাঁদের স্মৃতির তর্পণ করি। তাঁদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। অন্ন জলের বদলে আমরা দিয়েছি মৃত্যু। আমাদের ক্ষমা করো, হে পৃথিবী। লকডাউনের পর ২৫ মার্চ থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত ৯০৬ জনের বেশি পরিযায়ী শ্রমিক মারা গিয়েছেন। কেউ বাড়ির পথেই ক্লান্তিতে বা দুর্ঘটনায় মরেছেন। কেউ অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায়, কেউ খাবারের অভাবে, কেউ মানসিক স্থিরতা হারিয়ে আত্মহত্যা করে ছেড়ে গিয়েছেন পৃথিবীর ধূলিকণা, জল, বাতাস। তাঁরা আমাদেরই সহনাগরিক, আমাদেরই প্রয়োজনীয় পণ্যের জোগান দিতে ঘাম ঝড়িয়েছেন এতদিন। আমরা তাঁদের বাঁচার ব্যবস্থা করতে পারিনি, এ আমাদের অক্ষমতা। মানবতার দোহাই, ক্ষমা করো আমাদের। করোনা ও নানা রোগে যারা এই মাটির পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, মহালয়ার পিতৃপক্ষের শেষে তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। গোটা বিশ্বেই করোনায় মৃত লক্ষ লক্ষ মানুষের একটি বড় অংশ তরুণ, যাঁদের সমাজকে অনেক কিছু দেওয়ার ছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “সভ্যের বর্বর লোভ নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।” বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পরিবেশের উন্নতি ছাড়া এমন অতিমারী রোধ করা যাবে না। সভ্যের বর্বর লোভেই ঘটছে মারক ভাইরাসের সংক্রমণ। পরিবেশের অপমৃত্যু রোধে প্রয়োজন সচেতনতা। পরিবেশের মৃত্যু হলে তর্পণ করার জন্য কেউ বেঁচে থাকবে না। পুরাণ বলছে, মৃত্যুর পর মহাবীর কর্ণের আত্মা অন্যলোকে গেলে তাঁকে খাদ্য হিসেবে স্বর্ণ ও রত্ন দেওয়া হয়। জিজ্ঞাসা করলে বলা হয়, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণ ও রত্ন দান করলেও প্রয়াত পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কখনও খাদ্য বা পানীয় দান করেননি। তাই এখানে তার খাদ্য স্বর্ণ আর রত্নই। কর্ণ বলেন, তিনি তো পূর্বজদের পরিচয় পেয়েছেনই মাত্র একদিন আগে। তার অপরাধ কোথায়? যমরাজ সেই যুক্তি মেনে কর্ণকে প্রায়শ্চিত্তের উপায় বলেন। উপায়, পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে ১৫ দিন তাঁকে পূর্বজদের উদ্দেশ্যে জল ও খাদ্য নিবেদন করতে হবে। পক্ষকালের জন্য ফের মর্ত্যে ফিরে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার পর ভাদ্র সংক্রান্তির দিন কর্ণ ফের মহা আলয়ে বা স্বর্গে ফিরে যান। সেই সুবাদেই এই পক্ষকালকে বলা হয় পিতৃপক্ষ। সময় ও সমাজ বদলাচ্ছে। আজ তর্পণ শুধু পূর্বপুরুষদের জন্য করলেই হবে না। পূর্বনারীদের অবহেলা করা অন্যায় হবে। সমাজে তাঁদের অবদান কোনও অংশেই কম নয়। মধুশালা কবিতাগুচ্ছ লিখেছেন হরিবংশ রাই বচ্চন। তাঁর ‘মধুশালা’ কোনও পানশালা নয়, জীবন। জাগতিক সবকিছুই তার অঙ্গ। তার একটি অংশে তিনি লিখেছেন, - “পিতৃপক্ষ মে পুত্র উঠানা, অর্থ না কর মে, পর পেয়ালা। ব্যায়ঠ কহী পর জানা, গঙ্গা সাগর মে ভরকর হালা।। কিসি জগহ কি মিট্টি ভিগে, তৃপ্তি মুঝে মিল জায়েগি। তর্পণ অর্পণ করনা মুঝকো, পড় পড় করকে মধুশালা”।। হে পুত্র, পিতৃপক্ষে তুমি হাতে অর্থ না দিয়ে হাতে নিও পেয়ালা (জলপূর্ণ পাত্র)। যে কোনও জায়গাকে মদে পূর্ণ (পানীয় জল) গঙ্গা সাগর মনে করবে ভাসো। যে কোনও জায়গার মাটি একটু ভিজলেই আমি তৃপ্ত হবো। আমার তর্পণ করবে বার বার মধুশালা (জীবন) পাঠ করে। আসুন, আমরা জীবনের গানে প্রয়াতদের শ্রদ্ধা জানাই।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register