Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

গল্পেরা জোনাকি -তে রীতা চক্রবর্তী

maro news
গল্পেরা জোনাকি -তে রীতা চক্রবর্তী

কে আপন

বাড়িটা এখন ফাঁকা। দিদি আজ দুপুরের ফ্লাইটে চলে গেছে। দিদি হলো ব্যারিস্টার সেনের মেয়ে সুলগ্না।লতা ওকে দিদি বলেই ডাকে। আমস্টারডাম থেকে এসেছিল মা'র শেষ কাজ করতে। সুলগ্না যেবার ডাক্তারি ভর্তি হল সেবছর এবাড়িতে প্রথম আসে লতা। ক্লাস ফাইভে ও তখন। ওর মা এবাড়িতে রান্নার কাজ করত। একটু হাতে হাতে গুছিয়ে দেবার জন্যে মেয়েটাকে নিয়ে আসতো। লতা তখন থেকেই সব কাজ গুছিয়ে করতে পারতো। লতার মতো ছোট্ট একটা মেয়েকে এবাড়িতে কাছে পেয়ে সবচেয়ে খুশি হয়েছিল সুলগ্না। ছোটখাটো ফাই ফরমাশ খাটিয়ে নিত লতাকে দিয়ে। লতারও সুলগ্না দিদিকে খুব ভালো লাগতো। দিদির গায়ে কি সুন্দর একটা মিষ্টি গন্ধ ছিল! ওই গন্ধটা দিদির জামা কাপড়েও পেতো লতা। সুলগ্না যতক্ষণ বাড়িতে থাকত লতা ওর কাছেই ঘুর ঘুর করত। সুলগ্নারও বেশ লাগতো এই একটা ছোট্ট পুঁচকে মেয়ের সাথে অকারণে বক বক করে সময় কাটাতে। সুলগ্নার সাথে লতার গল্প করার বহর দেখে মাঝে মাঝে গিন্নিমা অবাক হয়ে যেতেন। ওরা দুজন যেন সমবয়সী বন্ধু। কত হাসি, কত আবদার দুজনের একে অপরের কাছে।
সুলগ্না লতাকে ওর বাথরুম ব্যবহার করার পারমিশন দিয়েছিল। বলেছিল মেয়েদের সব সময পরিষ্কার থাকতে হয়।রোজ সাবান মেখে স্নান করতে হয়। মাসে মাসে মেয়েদের শরীর খারাপ হয়। তাই নিজেকে পরিষ্কার না রাখলে বাজে ধরনের অসুখ হতে পারে। লতা বলেছিল "আমাদের তো বাথরুম নেই। রোজ সাবান মেখে স্নান করবো কি করে?" রাস্তার পাশে টাইমকলে জল এলে কলের তলায় বসে পরা আর উঠে চলে আসা। ওটাই স্নান। সুলগ্না ওর কথাগুলো মন দিয়ে শোনে। তারপর থেকে ওকে এখানেই স্নান করতে বলে। নিজের ছোট্টবেলার কিছু পছন্দের ফ্রক আলমারিতে গুছিয়ে রাখা ছিলো। সেগুলো দিয়েছিল লতাকে পরতে। লতা যখন কথা বলতো তখন একটা গ্রাম্য টান এসে পরতো ওর সব কথায়। ঘরোয়া ভাবে সেটা নিয়ে সবাই হাসাহাসি করতো। শুনতেও বেশ লাগতো। তবে সুলগ্নার মনে হতো মেয়েদের স্মার্ট এপ্রোচ না হলে সবাই মুরগি বানায়। তাই ওর সাথে কথা বলে বলে ধীরে ধীরে ওর কথার এই টানটা কাটাতে পেরেছে সুলগ্না। সুলগ্নারই একান্ত আন্তরিক সহায়তায় লতা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছে। তাছাড়া ওকে কম্পিউটারে কিভাবে নিজে নিজে সব কাজ বাড়ি থেকে করা যায় তাও শিখিয়ে দিয়েছে।অন লাইন জিনিস পত্র কেনা, ইলেকট্রিক বিল জমা করা, সব কিছু শিখিয়ে দিয়েছে সুলগ্না। এই ভাবেই লতা এবাড়ির একজন হয়ে উঠেছে । সুলগ্না এখন পাশ করে মেডিক্যাল কলেজেই চাকরি করছে। বিয়ে তো সেই কবেই ঠিক হয়ে রয়েছে। শুধু চিরঞ্জিতের এম. ডি- টা কমপ্লিট করে নেবার অপেক্ষা।
সুলগ্নার বিয়ের সময়ও প্রতিটা মুহূর্তে লতা ছিল সঙ্গী। বিয়ের নিমন্ত্রণের লিস্ট তৈরি করা, শাড়ি - কসমেটিকসের বাজার, পার্লার বুকিং-সব কিছুতেই লতা ওর সাথে আছে। ওর বিয়ের পর থেকে গিন্নিমা লতাকে নিজের কাছেই রেখে নিয়েছেন। লতার মা যদিও খুব রাজি ছিল না তবে মেয়ে এবাড়িতে থাকলে আরও তিন হাজার টাকা বেশী পাওয়া যাবে বলে আর আপত্তি করে নি। অবশ্য লতার নিজের কোনোরকম টাকার প্রয়োজন ছিলো না।এ বাড়িতে থাকা খাওয়া দাওয়ার সব ব্যবস্থা ওর জন্য রয়েছে। কোনো কিছুরই অভাব নেই।তাই টাকা দিয়ে ও কি করবে!গিন্নিমা তো নিজে থেকেই লতার জন্য শাড়ি পছন্দ করে কিনে দেন। কত সাজার জিনিস কত নতুন ধরনের ম্যাচ করা কানের-গলার সেট, সুগন্ধি সাবান, ডিওডোরেন্ট কিছুরই অভাব রাখেননি গিন্নিমা। বলতেন তোকে সাজতে দেখলে আমার খুব ভালো লাগে। মেয়েদের একটু সুন্দর হয়ে থাকতে হয়। আমার মেয়ে তো না শাড়ি পরল না চুল বাঁধলো। তোকে পরিচ্ছন্ন পরিপাটি দেখে শান্তি পাই। সেই গিন্নিমা গত হয়েছেন ক'দিন হল। এই কটা দিন বাড়িতে এত লোকজন ছিল যে গিন্নিমা'র অভাব বুঝতে পারেনি লতা। আজ দিদিকে ফ্লাইটে তুলে দিয়ে এসে থেকে বাড়িটা বড্ড ফাঁকা লাগছে।
আজকাল সকালে লতার মা এসে রান্না করে গুছিয়ে দিয়ে যায়। এখন কাজ বলতে "মশাই"-কে ঠিক সময়মতো খেতে দেওয়া, ওষুধ পত্র এগিয়ে দেয়া আর সন্ধ্যাবেলায অরূপ যখন মশাই-র কাছে আসে তখন দুজনকে জল খাবার দেওয়া। মশাই মানে ব্যারিস্টার সেনের সহকারী হিসেবে কাজ করে অরূপ। অরূপ যে লতাকে পছন্দ করে সেটা সুলগ্না বুঝতে পেরে বাবাকে বলেছে এ বিষয়ে অরূপের সাথে সরাসরি কথা বলতে। অরূপের বাড়ির লোকজন রাজি থাকলে ব্যারিস্টার সেন ওদের এই সম্পর্কটাকে পরিনতি দেবেন বলে মেয়েকে কথা দিয়েছেন। কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় লতার ডাক পরে মশাইয়ের ঘরে। লতা এখন আর আগের মতো সহজ ভাবে মশাইয়ের সামনে যেতে পারে না। খুব লজ্জা করে অরূপের সামনে বেশিক্ষণ থাকতে। আগে যখন দুজনের চোখে চোখে মন দেয়া নেয়া হয়েছে তখন এত আড়ষ্ট লাগতো না। বরং অনেক সময় ইচ্ছে করেই নানা ছল ছুতোয় ওর সামনে থাকার চেষ্টা করতো। ওদের ব্যাপারটা মশাই জানে বলেই লতার যত লজ্জা। তবুও মাথা নিচু করে সামনে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ব্যারিস্টার সেন অরূপকে দেখিয়ে বললেন, "আজ আমি ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম ওর মায়ের সাথে কথা বলতে। ওর মা আমার শর্ত মেনে নিয়ে তোদের বিয়েতে মত দিয়েছেন।" লতা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে মশাইয়ের দিকে। মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, "কি শর্ত মশাই?" ব্যারিস্টার সেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, "আমার শর্ত হল বিয়ের পর তোরা দুজন আমার কাছেই থাকবি। অন্য কোথাও না।"লতা বুঝে উঠতে পারে না এরকম অবস্থায় কি করা উচিত। ও তাড়াতাড়ি মশাইয়ের পায়ে মাথা ঠেকায়। অরূপও প্রণাম করে তার কর্ম জীবনের গুরু ব্যারিস্টার সেনকে। উনি ধীরে ধীরে বলেন, "আমার মেয়ে আর কোনোদিন বোধহয় এদেশে ফিরবে না। তুই চলে গেলে এতবড়ো বাড়িতে একা থাকবো কি করে! তুই ছাড়া তো আমার সব কাজ অচল হয়ে যাবে। তাই তোকে তো আমি সম্প্রদান করে দিতে পারবোনা। বরং বেঁধে রাখতে পারি আমার আর একটা মেয়ের মর্যাদা দিয়ে।" আনন্দে লতার দু'চোখ ভরে ওঠে কৃতজ্ঞতার অকাল বর্ষায়।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register