Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

"নীল সুনীলে দিন যাপন" গল্পে স্বাতীর আলোয় হেমন্ত সরখেল

maro news
"নীল সুনীলে দিন যাপন" গল্পে স্বাতীর আলোয় হেমন্ত সরখেল

যোদ্ধা

ইন্টারকমটা আওয়াজ করতেই চটক ভাঙে সেলিমে'র | '--- একটু আসবেন? --- হ্যাঁ, আসছি ' | বসের ডাকে সাড়া দিতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চেয়ারটা ছাড়তে হয় তাকে | আজ সকাল থেকেই একটা অন্যমনস্কতা ঘিরে রয়েছে | আটতলা'র কাঁচে ঘেরা অফিস কেবিনের জানলা দিয়ে ক্ষয়িষ্ণু সূর্যের গলন্ত সোনার ঝিলিকও অন্য দিনের মতো আজ টানছে না | এটাই তার কাছে সব থেকে প্রিয় বস্তু, বিকেলের সূর্যাস্ত, নিজের কেবিনে বসে দেখা | সেটাও যেন আজ খোল নলচে বদলে ফেলেছে | ----আশ্চর্য্য! কেন এমন হচ্ছে? নিজেকেই ছুঁড়ে দিল প্রশ্নটা |
' আজ অফিস থেকে ফেরবার সময় ফুলওয়ালা বিশুকে বলে দিস্ তো, কাল সকালে একটা তোড়া বানিয়ে দিয়ে যাবে..' বৃদ্ধ বাবা'র দিকে অবাক হয়ে তাকালো সেলিম- ' কেন ? হঠাৎ ফুল কি হবে ?' ' কালকে'র তারিখটা ভুলে গেলি? কাল একুশে ফেব্রুয়ারী!' ' তো! আমার এখন অনেক চাপ | ২১ -২২ ভাবতে পারছি না, মনে থাকলে বলে দেব' -- খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে ওয়াশ বেসিনের দিকে এগোয় সে..... ' অমর!' -- শব্দটা ফেটে পড়ে বাবা'র গলা থেকে | অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় সে | আজ বহুবছর পর এই নামটায় বাবা তাকে ডাকলেন, ' তোমার থেকে অন্ততঃ এটা আশা করিনি |'- গলাটা ধীর, অসম্ভব গম্ভীর | যেন কোনো দিগন্ত থেকে ভেসে আসা সুদূর পরাহত ধ্বনি | মা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো | বাবার শরীরটা মৃদু তালে কাঁপছে | পঁচাশি ছুঁই ছুঁই আসগার আলী এখনও যথেষ্ট ঋজু,সুঠাম ব্যক্তিত্বের অধিকারী | ' আমি আসগার | আসগার আলী | নিজের চোখের সামনে দেখেছি, কীভাবে প্রাণের কথা প্রকাশের দাবিতে তোমার থেকেও অনেক বেশি প্রতিশ্রুতীবান ছেলেরা অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিল-- আহমেদ, জব্বার, বরকত, সালাম, শফিউর - নামগুলো তো তোমার ছোট্টবেলা থেকেই শোনা-তাই না?' - প্রশ্নের সাথে একটা শ্লেষ যেন ছিটকে এ'ল ! কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে আটকালো সে | সাধারণতঃ চুপচাপ থাকা মানুষটা আজ কিছু বলছে- বলছে বিশেষ কিছু | নয়তো- এতো অশান্ত কেন? কাহিনিগুলো মোটামুটি জানা তার দাদীর কাছ থেকে | পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, ১৯৫২-র ২০ শে ফেব্রুয়ারীর ১৪৪ ধারা | মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার সম-মর্যাদায় দেখার দাবিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সরকারী দমন নীতির বিরুদ্ধে এক প্রাণখোলা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন | ধর্মঘট-হরতাল-সমাবেশ-মিছিল- নিরীহ মানুষকে হত্যা-অবশেষে ১৯৫৬ সনের ২৯শে ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষাকে সেই সরকারের স্বীকৃতি দান-- দাদী এমন ভাবে বলতো, যেন চোখের সামনে দেখছে- মহাভারতের সঞ্জয়! ' আজ তোমার কাছে নিজের ভাষার জন্য সামান্যতম সময় নেই ? তাহলে ওরা কি নির্বোধ ছিল ? আজকের দিনটা আর আগামীকালের তারিখটা- ২০ আর ২১, পুলিশের রক্তচক্ষু- বেয়নেট, বুলেট, রক্তে ভেজা ইতিহাস লিখেছিল ৫২ তে | যাতে-যাতে- তুমি, তোমার মা কে 'মা' বলতে পারো-সারাজীবন--আমৃত্যু...' ' শান্ত হও, শান্ত হও- বসো, চেয়ারটাতে বসো ' - পেছন থেকে ধরে মা ওনাকে বসিয়ে দেন চেয়ারে | ' জলটা খাও |' চুপচাপ হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে সেলিম | কী আছে ঐ কথাগুলোর মধ্যে ? কেন চোখে চোখ মেলাতে পারছে না ?বেড়িয়ে যেতে যেতে 'আমি আসি' বলার সময় এক লহমায় দেখ'ল তখনও জল ভরা কাঁচের গ্লাসটা সামনে রাখা, উনি প্রখর দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রয়েছেন | যেন পালিয়ে বাঁচল আজ! আনমনেই কখন যেন ফেসবুকটা ক্লিক করে খুলে ফেলেছে।বাংলাদেশের সরকারী সাহিত্য পরিষদের সাইটটা ক্লিক করতেই একটার পর একটা পোষ্ট- বাংলা ভাষাকে নিয়ে | মন্দ নয়! দু-তিনটে পড়েও ফেলল! ---আচ্ছা! এই যে পড়ছি, চিন্তা করছি-- এটাও তো সেই বাংলাতেই--সত্যিই যদি '৫২ তে ওরা প্রতিবাদের ঝড়টা না তুলতো, তবে কী হতো ? মাথাটা যেন অসার হয়ে এল | সত্যিই তো! এটা তো ভেবে দেখা হয়নি! ভাবতে ভাবতে কখন জানি একটা অদ্ভুত ভালো লাগা ছড়াতে থাকে মাথায়-প্রাণে-সমস্ত শরীরে- সত্ত্বায় আত্মস্ত হয়ে যায় সেই বোধ...
ভোরবেলাতেই ঘুমটা ভাঙে অ্যালার্মে | চুপচাপ বেড়িয়ে সটান বিশু'র বাড়ি | কাল বলেনি, সকালেই তাজা ফুলের তোড়াটা তার চাই | বললে হয়তো বাসি ফুল দিয়ে বানিয়েই ফ্রিজে রেখে দিত বিশু | ফেরার পথে কাশীদা'র চায়ের দোকানে এক কাপ চায়ের ফরমাইশ কর'ল | কাশীদা হাতের তোড়াটা দেখে বল'ল, ' আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারী- তাই না অমর ?' ' ত্ -তুমি? তুমি আমার এ নাম জানলে কী করে? আর ২১ শে ফেব্রুয়ারীটা ? ইন্ডিয়াতে?' ' তুমি অনেক ছোট ছিলে | তোমার বাবা আসগার আলী নিজেই একজন ভাষা আন্দোলনের কর্মঠ যোদ্ধা | অনেকে হারিয়ে গেছেন, তাদের সাথে উনিও হারিয়েছেন সকলের বিস্মৃতিতে | নাও, চা খাও | অমর একুশের নামেই আসগার'দা তোমায় অমর বলে ডাকেন...'
বাড়ি অব্দি আসতে আসতে মনে হ'ল তার আকাশটা আজ হঠাৎ, অনেক বড়ো হয়ে গেছে | দরজায় আাকাশের দিকে মুখ তুলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আনমনা অনমনীয় যোদ্ধা | চোখে চোখ পড়তেই হাতটা বাড়িয়ে দিলেন তোড়াটার জন্য- চোখে আনন্দের বন্যা নিয়ে- চুপচাপ।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register