Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব - ৩৭)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব - ৩৭)

ইচ্ছামণি

পর্ব ৩৭

রুমার ইচ্ছামণি আমদানির পর থেকে মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর দায়িত্বটা অনেক হালকা হয়ে গেছে অতীনের। গাড়িতে তুলে দিয়ে আসা ছাড়া বাকি কাজগুলো রুমাই সামলে দেয়। ইচ্ছার তো টিকি দেখা গেল না। নাকি রুমার বেশে তার ডামিকে দেখে গুলিয়ে গেছে। তা কী করে হয়? সারা রাত যে রুমা বিছানায় না থেকে ঘুরপাক খেয়ে গেছে, সে তো নিজের চোখে দেখল। তার মানে? রুমার মনগড়া গপ্পো! ইস্‌! ছিছিঃ! অতীনও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল? রুমার চোখ ছলছলে। অসুখ বাধালো না তো? অতীন বলল, “তুমি শুয়ে থাকো। দেখি তো।” স্ত্রীর কপালে হাত দিয়ে দেখল। গরম। “তোমার জ্বর। এই নিয়ে সারা রাত বিছানায় ছিলে না। তারপর এত কাজ করতে গেলে কেন? তোমার ইচ্ছামণি কোথায়?” “আমি কোথায় কাজ করলাম? সবই তো ইচ্ছা করেছে। আমার কয়েক ঘণ্টা আগে চোখ লেগেছে, আর কাজও সব সারা। তাই একটু আলসেমি করছি। সব কি ওর ওপর ছাড়া যায়? তোমার সামনে বাইরেও আসবে না। খবরদার ওকে লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করবে না। তাহলে সব হারাব।” “আমি পরিষ্কার দেখলাম তুমি রাতভর এঘর ওঘর করে খুটুর খুটুর করে গেলে। এমনকি বাথরুম থেকে বেরিয়েও রান্নাঘরে ঢুকলে। আর বলছ অন্য কেউ করেছে? থার্ড কেউ প্রেজ়েন্ট থাকলে আমি সেন্স করতে পারতাম না?” “বলছি তো, আমায় কিচ্ছুটি করতে হয়নি। সব ইচ্ছা করেছে। আমি তো রাত্রে ঘুমিয়েছিলাম। তুমিই তো চায়ের কথা বলে দিয়ে জাগালে? চা কে করল, তুমি? এতক্ষণে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আবার গরম করতে হবে।” “এই বললে একটু আগে চোখ লেগেছে। এখন বলছ রাতে ঘুমিয়েছিলে? তুমি ঘুমের মধ্যে হাঁটা ধরলে কবে থেকে? তাও আবার ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভোর পাঁচটার মধ্যে রান্না শেষ করে ফেললে? তোমার জ্বর দেখি। সারা রাত বিছানায় ছিলে না।” রুমার মুখটা ভেবলে গেল। “তাহলে বোধহয় পাশের ঘরে শুয়েছিলাম। আমার তো ডিসটার্বড্ স্লীপ জানো। বিছানায় উসখুস করলে তোমাদেরও ডিসটার্ব হয়।” “পাশের ঘরে গিয়েছিলে ঠিকই, তবে বইপত্র ঝাড়তে। আমি আওয়াজ পেয়ে দেখেওছি। তোমার আষাঢ়ে গল্পে পাগোল কিংবা শিশু ছাড়া কেউ ভোলে? পাথরটা হাতে নিয়েও দেখেছি। জাস্ট এমনি একটা পাথর। কোনও অলৌকিকত্ব নেই। চুপচাপ শুয়ে থাকো, গুবলুকে আমি স্কুলে পাঠাব।” “সে কী! তুমি ওকে ধরলে? আর যদি না আসে?” “কখনও কি অ্যাট অল এসেছিল কোনওদিন?” “তুমি অবিশ্বাস করে ওকে তাড়িয়ে দিলে? তোমার কাস্টডিতে দিতে চাইনি বলে আমার এত বড় ..এত দামী একটা অবলম্বন নষ্ট করে দিলে?” “ও কোনও কালেই ছিল না। তোমার কল্পনা, হালিসিনেশন, বানানো গল্প।” “ছিল না মানে? এতদিন এত কাজ কে করে দিল? ঘরের চেহারা দেখে বুঝতে পারছ না? কত শ্রী ফিরেছে।” “তুমিই করেছ ঘোরের মধ্যে। যেমন কাল সারা রাত না ঘুমিয়ে খেটে গেলে। এমনটা তার মানে বেশ কদিন ধরে চলে আসছে। এখন বুঝতে পারছি, তোমার শরীর দিনে দিনে এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? শুয়ে বসে থাকলে চোখের কোলে কালি পড়ত না।” “তুমি যা দেখেছ ভুল দেখেছ। ইচ্ছাকেও আমার মতো দেখতে। যখন যা পরে থাকি, ওও তখন তাই পরে। শুধু দুজনকে একত্রে দেখা যায় না। তুমি আমার পাথরটা ছুঁয়ে সব শেষ করে দিলে। ইচ্ছা, আমায় ছেড়ে যেও না।” ডুকরে উঠল রুমা। অতীন থার্মোমিটার এনে সোজা রুমার বগলে চেপে ধরল। রুমা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বিড় বিড় করে চলেছে, “দুটো দিন সুখে ছিলাম, তোমার সহ্য হল না। নিজের সুবিধার জন্য তাকে টানাটানি করে সব শেষ করে দিলে। পাথরটা কোথায় রেখেছ তুমি? এক্ষুণি দাও। ইচ্ছা.. প্লিজ় আমাকে ছেড়ে যেও না। তুমি ছাড়া আমি ভালো থাকব না। আমায় আবার উদয়াস্ত খাটতে হবে। পরিবর্তে বরের অসন্তোষ, দাঁত খিঁচুনি। আমার পক্ষে মেয়েকে কারো জিম্মা করে চাকরি বাকরিও তো করা সম্ভব হচ্ছে না। সব ভুলে ভালো ছিলাম...” “চুপ।” “আমি পারব না কিছু করতে। কেন ওকে তাড়ালে? ইচ্ছা, যদি যেতেই হয়, আমায় ঘুমের ওষুধ বা আফিং দিয়ে যাও। আমি চিরকালের মতো ঘুমিয়ে পড়ি।” “তোমাকে এখন কিছু পারতে হবে না। আবোল-তাবোল না বকে ঘুমোও – যেটা ভালোবাসো। গুবলুকে তৈরি করতে হবে। শেষে সিজোফ্রেনিক হয়ে গেলে? এটাই তো স্প্লিট পার্সোনালিটি। তোমারই আর একটা সেলফ্‌কে ইচ্ছামণি বানিয়েছ। সে করে দিচ্ছে ভেবে নিজেই করে যাচ্ছ।” ‘পণ্ডিতি ফলিও না। আমি তাই নিয়েই যদি খুশি থাকি, তোমার কী? এখন সজ্ঞানে দগ্ধাতে হবে।” “তোমায় ডাক্তার দেখানো দরকার। প্রথমে জেনারেল। তারপর সাইকায়াট্রিস্ট। ডক্টর মেহেতার ওষুধ বন্ধ করলে কেন?” “ওষুধগুলো দুমাস খেয়ে আবার দেখানোর কথা ছিল। নিয়ে গেছ? বহুকাল আগেই বলা হয়েছিল। আমার মা বাবার কথা তুমি পাত্তা দাওনি। এখন ডাক্তার আমার কোনও কম্মের নয়। সে আমার..আমার দুটো পার্সোনালিটি এক করে দেবে। ঘরের কাজ কি করে দেবে? একটা ভদ্রস্থ চাকরি দিতে পারবে? লেখাগুলো জায়গা মতো...ইচ্ছামণি, তুমি চলে যেও না। আর কোনওদিন কারও কাছে তোমার গল্প করব না। এবারের মতো –প্লীজ়!” “চাকরি চাকরি করে শেষ পর্যন্ত লিটারারি উন্মাদ হয়ে গেলে? মেয়েটাকে বড় করে তোলা- সেটা কি কোনও কাজ নয়?” গুবলুকে আজ ওঠাতে হয়নি। মা বাবার গলায় ওর ঘুম ভেঙে গেছে। তাড়াতাড়ি করলে ওকে স্কুল পাঠানো যাবে। মেয়েকে অসুস্থ মায়ের কাছে রাখার বদলে স্কুলে পাঠানোই ভালো। কিন্তু অতীন অফিস বেরিয়ে গেলে রুমাকে কে দেখবে? মেয়ে স্কুল থেকে ফিরলে ওকে বড় রাস্তা থেকে রুমা নিয়ে আসতে পারবে তো? গায়েই তো এখন একশো তিন ডিগ্রী জ্বর। মুখে নিলে আরও এক ডিগ্রী বেশি – বাপরে! আর মাথাটা তো ভালো মতো বিগড়েছে। অবশ্য এতটা বিকার জ্বরের ঘোরেও হতে পারে। রুমা যখন শুধু মন খারাপ করত, তখন গুরুত্ব না দিয়ে অতীন শুধু বিরক্ত হয়েছে। এখন ভেবে লাভ নেই। শ্বশুর শ্বাশুড়ি ছোট মেয়ের বাড়ি থেকে ছমাস পরে নিজেদের চিত্তরঞ্জনের বাড়ি গেছেন। ওঁদের কাছে আপৎকালীন সাহায্য পাওয়া যাবে না। শ্বশুর নিজেই তো মানসিক রুগী। গায়ের ঝাল ঝেড়ে তো সমস্যা মিটবে না। দিদিকে খবর দিতে হবে। হাজারটা প্রশ্ন! হাজারটা উত্তর অতীনের জানা নেই। “মায়ের কী হয়েছে বাবা?” “অসুখ। তুমি ঝটপট বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে এসো। রেডি হতে হবে স্কুলের জন্য।” “কী অসুখ বাবা? নিজের মনে কথা বলার অসুখ?”

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register