Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

গল্পে দেবদাস কুণ্ডু

maro news
গল্পে দেবদাস কুণ্ডু

আনন্দলোকের ডাক

আমি কখনো ভাবিনি আমার আগে ঋতু চলে যাবে। ঋতু আমার থেকে দশ বছরের ছোট। আমি ওকে বাংলা পড়াতাম। সেই পুরনো গল্প। ছাত্রী ঋতু একদিন হয়ে গেল আমার প্রেমিকা। তারও পাঁচ বছর পর হয়ে গেল আমার স্ত্রী। ঋতু একটা বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়াচ্ছিল। এভাবেই আমাদের সংসার জীবন কাটছিলো, ঋতু একদিন বলল, ‘জানো কৃশানু আজ না ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।’ আমি বললাম কেন? আজ হঠাৎ কিসের জন্য আনন্দ? ‘আমি না মা হতে চলেছি।’ শব্দগুলো এমনভাবে উচ্চারণ করল ঋতু যেন প্রতিটি শব্দ এক একটা স্বপ্ন। স্বপ্নই তো! বিয়ের চার বছর হতে চলল আমাদের কোন উত্তরসূরী আসছে না। খুব কষ্ট আর হতাশা ছিল বুকের পাঁজরে। বাইরের কেউ বুঝতে পারতো না, আজ উত্তরসূরীর আগমনের ডাক শুনতে পেয়েছি ঋতু এটা ঋতু কেন, আমারও স্বপ্ন। ঋতু যে শব্দগুলো উচ্চারণ করল, তার প্রতিটি শব্দ বাঁচাতো মা মা গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। আমি অনুভব করতে পারছি। ঋতুর চোখ দু’টোর মধ্যে গুপ্তধন খুঁজে পাওয়ার আনন্দ। সারা মুখটা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার মতো সোনালী আভায় মাখামাখি। আমি তেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছি। কারণ এত খুশি ঋতুকে কোনদিন আমি দেখিনি ঋতুরা ছয় বোন, দুই ভাই। ওর বাবা গেঞ্জির কারখানায় কাজ করেন। মা মেসিন সেলাই করেন। ঋতু যখন আমার প্রেমে পড়লো, কিংবা আমি যখন ঋতুর প্রেমে মজলাম, তখন ঋতুর একটা ছোট্ট বোন এলো পৃথিবীতে। সেটা জানলাম ঋতুর এক বন্ধুর কাছ থেকে। ঋতু তখন বারো ক্লাস পাশ করে বি. কম ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হবে। ঋতু দেখা করছে না আমার সঙ্গে। ওর বন্ধুকে দিয়ে খবর দিলাম। এমারজেন্সি। ঋতু যেন একবার দেখা করে। তবু দেখা করে না ঋতু। আমি জানতাম বৃন্দাবন লেনে ঋতু একটি ছাত্রকে পড়াতে যায়। আমি সেই রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। একেবারে ঋতুর মুখোমুখি। ‘কি ব্যাপার তুমি দেখা করছো না কেন?’ ‘আমার ভীষণ লজ্জা করছে কৃশানু।’ ‘কেন?’ ‘মা বাবা যে কি করে না? কি কষ্ট করে আমাদের সংসার চলে, তুমি কিছুটা জানো। তার ওপর...।’ ‘তারপর তোমার একটা বোন হয়েছে, তাই তো?’ ‘কিছু বলে না ঋতু। যেন লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে। ঘাড় নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। ‘এতে তোমার লজ্জা পাওয়ার কি আছে? বুঝতে পারছি না।’ ‘তুমি জানো না কৃশানু আমরা দু’বেলা ঠিক মতো খেতে পাই না। একবেলা ফ্যানভাত খাই। রোজ বাজার হয় না। কলেজের মাহিনা দিতে পারি না। আমার পরের বোনটা নাইন পর্যন্ত পড়ে ছেড়ে দিল। এখন মার মতো মেশিন সেলাই করে। আমার বড় ভাই অশোক ছেড়াপ্যান্ট সেলাই করে পড়ে কলেজে যায়। বি.এস.সি পড়ছে। করে টিউশন, করে এল.আই.সি. তা দিয়ে নিজের খরচ চালায়। এই হাভাতে আকালে সংসারে বাবা মা আর একটা সন্তান আনলো কি ভেবে? আমি ভেবে পাচ্ছি না। ভীষণ ঘেন্না করছে বাবা মাকে।’ খাটের ওপর শুয়ে আছে ঋতু। ওর চোখ মুখ যেন আমাকে পুরনো দিনের কথাগুলি মনে করিয়ে দিচ্ছে। ওর ছয় বোন, দুই ভাইকে খবর দিতেই এসে গেছে। ওরা দিদিকে সাজাবে। আমি দেখেছি। আর শ্রাবণের ধারার মতো পুরনো দিনগুলি চোখের পর্দায় ভাসছে। ঋতু তখন বি. কম. অনার্স পাশ করেছে। কর্মাসের স্টুডেন্ট পড়াচ্ছে। ভাল আয় হচ্ছে। একদিন আমি ওদের বাড়িতে গেলাম। তিন বছর পর। ঋতুর কথা মতো। ওর বাবাকে বললাম, আমি ঋতুকে বিয়ে করবো।’ কথাটা শুনে ঋতু বাবা দেশলাই কাঠির মতো জ্বলে উঠলেন, বললেন, ‘তুমি কি করো?’ ‘আমি কোচিং করি।’ ‘তোমায় তো বড্ড সাহস।’ ‘একথা বলছেন কেন?’ ‘আমার মেয়ের দিকে তুমি হাত বাড়িয়েছো, তোমার আস্পর্ধা তো কম নয়। বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। আর কোনদিন আসবে না।’ ঋতুর মা মেশিন সেলাই বন্ধ রেখে বললেন, ‘তুমি কি করে জানলে ও তোমার মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে। তোমার মেয়েও তো ওর দিকে হাত বাড়াতে পারে!’ ‘তুমি চুপ করো।’ গর্জে উঠলেন ঋতুর বাবা। ‘ওরা যখন ভালবেসেছে। ওরা বিয়ে করুক। তুমি আপত্তি করছো কেন?’ ‘তুমি একদম কথা বলবে না, তুমি কি বোঝ?’ আমরা বুঝতে পারছিলাম। তাই ঋতুর কথা মতো আবার আমি আর একদিন ঋতুর বাড়িতে যাই। আমি বলি, ‘ঋতু এখন যেমন টাকা দিচ্ছে, বিয়ের পরও দেবে।’ ঋতুর বাবা ঠান্ডা হয়ে গেল। ‘বসো। চা খাবে?’ ‘না।’ ‘সত্যি দেবে তো তোমরা?’ ঋতু মাঝখান থেকে বলেছিল, ভয় পেও না বাবা আমি না পারি ও এসে তোমাকে মাসে মাসে দিয়ে যাবে।’ সেই ঋতু যে দিন সাড়ে তিন কেজি ওজনের একটা ফুটফুটে ফর্সা শিশুর জন্ম দিলো। শিশুটিকে কোলে নিয়ে ঋতুর মুখে এত আলো ফুটে উঠেছে যে একটা সূর্য এতো আলো দিতে পারে না। সেদিন আকাশে দু’টো তিনটে সূর্য উদয় হয়েছিলো। ওর ছটা বোনই খাটের পাশে দিদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কারো কারো চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন, কারো চোখ বৃষ্টিতে থার্ড আর মেয়ে তিতলি! অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে। এই ফ্ল্যাট বাড়িতে আটটা পরিবার থাকে। সকলেই এসে দেখে যাচ্ছে। শেষ দেখা। তারা ভাবতে পারছে না কাল দেখলাম, আজ সকালেও দেখলাম। কখন কি করে ঘটলো এখন অঘটন! সবাইকে একই কথা বলে যেতে হচ্ছে বার বার ভালো লাগছে না। তবু বলছি, ঋতু আজ স্কুল থেকে ফিরতে দেরি করেছে। রাস্তায় জ্যাম ছিল। আমি অপেক্ষা করছিলাম। আমরা দু’জেন এক সঙ্গে খাই। আজ নয়। বিয়ের পর থেকেই। খেতে খেতে আমরা গল্প করি। আজও গল্পই করছিলাম। একটা হাসির গল্প। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের। ঋতু খুব হাসছিলো। হাসতে হাসতে খাবার আটকে গেল গলায়। জল খাচ্ছে। তবু নামছে না খাবার। কাশছে। একসময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। হাতের কাঁচের গ্লাসটা ভেঙে ছড়িযে পড়লো মেঝেতে। জল আর ভাঙা কাঁচের টুকরোর মাঝে শুয়ে আছে ঋতু। আমি ক করবো ভেবে পাচ্ছি না। আমার চেনা গৌর ডাক্তারকে কল করি। ওর চোখে মুখে জল দিই। ঋতুকে নাড়া দিই। পাখাটা জোরে চালিয়ে দিয়েছি। টিভি চলছিল, বন্ধ করে দিলাম শব্দ। গৌর ডাক্তার দেখে বললেন, স্টোক। শেষ। ছ’ ঘণ্টা পর ডাক্তারের চেম্বার থেকে ডেড সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে হবে। এখনও ছ’ঘণ্টা হয়নি। চলে যাবার মতো বয়সও ঋতুর হয়নি। মাত্র ৫৫। এর আগে দু’বার ই. পি. এস হয়েছে ওর। হার্টের ব্লকেজ। প্রতি দশ বাইপাশের ধারে একটা নার্সিংহোমে ই. পি. এস করিয়ে আনলাম। নার্সিংহোমে বলেছিলাম, ঋতু তুমি একটা ‘রেকারিং খরচ রেখেছো।’ ‘কি ব্যাপারে বলতো কৃশাণু?’ ‘ও তুমি হার্টের কথা বলছো? এই হার্টটা ছিল বলেই তো তোমাকে ভালোবাসতে পেরেছি। এটা হলো দশ বছর অন্তর প্রেমার্ঘ্য দেওয়া।’ ‘আর কতবার এই প্রেমার্ঘ্য দিতে হবে?’ ‘বোধহয় আর দিতে হবে না।’ ‘মানে?’ হাসতে হাসতে ঋতু বলল, ‘সময় হয়ে আসছ। আমি বুঝতে পারছি। এবার যাবো।’ ‘কি যা তা বলছো? ‘আমি ৬৫। যাবার কথা ভাবছি না। তুমি পঞ্চান্নতেই যাই যাই করছো? তুমি কি শীতের রোদ্দুর নাকি? ‘না গো? ভিতর থেকে কে যেন বলছে, এখানকার সব কাজ তোমার হয়ে গেছে। তুমি একজনের মেয়ে হয়ে এসেছিলে, তারপর কৃশানু স্ত্রী হলে, তারপর তিতলির মা হলে, এখন কুসোর দিদা। আর তো কোন পর্বে অভিনয় করা বাকি নেই। এবার চলো অসীম আনন্দলোকে। ‘মানে? এই অসীম আনন্দলোকটা কি?’ ‘এই জীবনের দুঃখ কষ্ট, যন্ত্রণা আর সামান্য আনন্দের পর্ব শেষ। এবার অন্য এক জীবন। এই গ্রহ ছেড়ে অসীম আনন্দলোকে যাত্রা। সেখানে শুধু আনন্দ, আনন্দ আর আনন্দ।’ আমি ঋতুর দিকে তাকাই। ফুল এসে গেছে। চন্দন ঘষা হচ্ছে। খুব করে সাজাচ্ছে বোনেরা দিদিকে। চন্দনে ফুলে ঋতুর মুখটা বড্ড উজ্জ্বল। মনে হচ্ছে মুখে এক রাশ হাসি, শীতের রোদ্দুরের মতো ঝলমল করছে। তাহলে কি সত্যিই ঋতু অসীম আনন্দলোকে পৌঁছে গেল? আমার আগে? ‘চিরটা কাল আমি এগিয়ে গেছি। ঋতু পিছনে পড়ে থাকতো। বলতো, আমাকে ফেল তুমি এগিয়ে যাও কেন কৃশানু?’ ‘তুমি আমার সঙ্গে সমানতালে হাঁটতে পার না ঋতু?’ ‘আমি মেয়ে, তুমি পুরুষ। তোমার সঙ্গে পারবো কেন? তবে কথা দিচ্ছি একদিন দেখবে আমি তোমার আগে চলে গেছি।’ ‘আমি জোর দিয়ে বললাম, ‘কোন দিন তুমি পারবে না আমাকে পিছনে ফেলে আগে চলে যেতে।’ ‘কথা দিচ্ছি, দেখবে একদিন।’ সেই দিনটা আজ। ওরা ঋতুকে নিচে নামিয়ে নিয়ে গেছে। এতক্ষণে কাঁচের গাড়িতে ঋতু উঠে গেছে। আমি শূন্য ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। বিয়ের পর তোলা আমাদের যৌথ ছবিটা আমার চোখের সামনে। মাথায় সিঁদুর নিয়ে ঋতু হাসছে। যেন বলছে, ‘কৃশানু আমি কিন্তু কথা রেখেছি।’ সত্যি আসি কখনো ভাবিনি আমার আগে ঋতু চলে যাবে। তবে কি কেউ কেউ আনন্দলোকের ডাক আগে থেকে শুনতে পায়?
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register