Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

।। স্বদেশ সংখ্যা ।। আজকের লেখায় ঋতিক গঙ্গোপাধ্যায়

maro news
।। স্বদেশ সংখ্যা ।। আজকের লেখায় ঋতিক গঙ্গোপাধ্যায়

গ্রন্থ সমালোচনা

কাব্যগ্রন্থ - জলের ভিতর আগুনের মতো
লেখক - বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
আচ্ছা একটি সার্থক কবিতার বই হাতে নিয়ে কিরকম অভিজ্ঞতা হয় আপনাদের? কোন কোন বই কি হাতের তালুতে ফরফর করে অবাধ্য প্রজাপতির মতো? কেউ কি থানইঁটের মতো বুকে চেপে বসে? কেউ অবাধ্য ঘোড়া হয়ে সর্বনাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় কি? কেউ কি আবার কাঁধে হাত রাখে ? কবিতার বই বড়ো অদ্ভুত সব কান্ড ঘটাতে পারে চেতনা জগতে এবং মনের মধ্যে এই বিশ্বাস লালন করি বলেই ব্যক্তিগতভাবে আমি অত্যন্ত ধীরগতিতে কবিতাপাঠে বিশ্বাসী কারণ একই কবিতা ঘুরেফিরে বেশ কয়েকবার না পড়লে সেটি মনের ওপর কোন ছায়া ফ্যালেনা। আমার মতো যেকোন নভিস হয়তো তাই করবেন, মানে যারা কবিতার প্রচ্ছায়া উপচ্ছায়া সম্পর্কে এখনো সেইভাবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে উঠতে পারেননি আর কি। এই পরিস্থিতিতে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের " জলের ভিতর আগুনের মতো " কাব্যগ্রন্থটি আমার সামনে এক দুরুহ চড়াইয়ের মতো দাঁড়িয়েছে। চড়াই কেন? দু এককথায় সেটিই গুছিয়ে বলার চেষ্টা করি।
" জলের ভিতর আগুনের মতো " ভিন্নধর্মী কিছু কবিতার সমাহার। পাঠকের হয়তো শুরুর এই উক্তিতেই খটকা লাগবে। কবিতার বইতে ভিন্নধর্মী লেখা থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক! সবিনয়ে জানাই,এই " ভিন্নধর্ম" অর্থ কাব্যর দৈর্ঘ্য এবং তার বিষয়গুলি নির্বাচনের মধ্যে। বইটি চার পর্যায়ে বিভাজিত। প্রথমে কিছু আপাত দীর্ঘ কবিতার ডালি,অতঃপর ক্ষণবর্ষী কিছু প্রেমজ পাঠ, তারপর দ্রোহকাব্যজাতীয় আর শেষদিকে কিছু বেদনার রিনরিন। তবে দীর্ঘকবিতার বিষয়গুলিকে অন্যদিকে রেখে বাকি যে প্রেম, দ্রোহ আর বেদনার কাব্যগুলি খচিত সেখানে একটি অনুভুতির সাথে আরেকটি অনুভুতি অনায়াসে এবং আশ্চর্যভাবে হামেশাই মিশে যায় আর নতুন সম্পদের আভাস দ্যাখায়। তবে এই সম্পদ আহরণ করতে গেলে আপনাকে সেই চড়াই পথে হাঁটতে হবে যার কথা প্রথমেই উল্লেখ করেছি।
কবি তাঁর কাব্যগ্রন্থ শুরুই করছেন পরপর আটটি দীর্ঘ কবিতা দিয়ে। এই হচ্ছে " পহেলি পড়াও " মানে প্রথম চড়াই। ক্ষুদ্র পরিসরের কাব্যতে যে চকিতভাব,এখানে তা নেই। দীর্ঘ কবিতার যা মেজাজ, অর্থাৎ মন্দ্রলয়ে বাগবিস্তার - তা হুড়মুড় করে এক পশলা বৃষ্টির মতো কবিতায় অভ্যস্ত পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলবে। দীর্ঘ কবিতা বর্ষার অবিরল কখনো মৃদু কখনো তীব্র ধারাবরিষন। সবাই সে রসের খবর পায়না। তাই ছত্রে ছত্রে যখন কবিতাটি ধীরে পাপড়ি খোলে - পাঠক ততক্ষনে হাঁপিয়ে ওঠে। তাই - পাঠ করুন ধীরে। একই কবিতা পড়তে সময় নিন। কিন্ত পড়ুন - নয়তো " মড়কে ফুলের রেণু"র মতো সৃষ্টি আপনার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। "প্রতিটি কোষের কেন্দ্রে" কবিতায় " তারপরও কিভাবে বেঁচে আছি/ পারো তো উত্তর দিও তার / বাড়ি যদি একটাই তবে/ দরজা হলো কিভাবে হাজার " স্তবকের ধাক্কার আগে আপনাকে পেরিয়ে আসতে হবে সেই কবিতার নান্দীমুখটি৷ " লক্ষীর নতুন পাঁচালি" কবিতায় প্রগাঢ় অসহায়তা আর অনাদিকালের প্রকৃতি পুরুষের দ্বন্দ্ব এবং মিলনাকাঙখা একই দোলনায় দুলতে থাকে আশ্চর্যজনক সব পংক্তির তালে তালে। যখন শুনি - " কিভাবে কল্পনা করল তোমাকে মানায় / অগুনতি লাশের ভীড়ে, জল্লাদখানায়? " তখন নারীজ এবং প্রকৃতিজ সৌন্দর্যের অবমাননায় দ্রোহে মন ভরে ওঠে৷ সেই আনত প্রেমের উদ্দেশ্যে কবির প্রার্থনা " ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে যত পরিবার / জোড়া না লাগুক,তারা বাঁচুক আবার/ অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা,আধমাত্রা আরও / হাত থেকে হাতে যদি নাও নিতে পারো/ খিদে দিয়ে বুদ্ধি মেপো/ ফল দিয়ে গাছ / ভাতের পাশেই রেখো একটুকরো মাছ "। কাব্যগ্রন্থের একদম প্রথম কবিতা " পুরী" কবিতায় যখন জগন্নাথদেব তার শক্তি এবং অসহায়তা নিয়ে পাশে দাঁড়ান - সেই অকিঞ্চন মায়ার সাথে লেপটে থাকতে ভালো লাগে। তার ভোগপ্রসাদের গন্ধের সাথে ছেলেবেলার ঝিনুক কুড়োনো মিশে যায় আর নিটোল অতীত বিক্ষত বর্তমানের হাত ধরে, যেনবা স্থান বদলাবদলি করে। এই হলো দীর্ঘ কবিতা থেকে আহৃত আনন্দ, যা আজকাল দুর্লভ। যা গুরুপাক কিন্ত ধীরে ধীরে জীর্ন করলে অসামান্য আনন্দ দ্যায়।
দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হচ্ছে লিপস্টিক নামের কাব্য দিয়ে। ছোট তার পরিসর। " কোথাও আমি / তোমার নামের তিনটে অক্ষরের একটাকে দিচ্ছি পৃথিবী/ একটাকে আকাশ/ আর একজনকে নিজের মাথা/ যার মধ্যে/ অনেক ছবি ভাসমান " এই উচ্চারণ প্রগাঢ় প্রেমের,জন্মরোমান্টিকের। এই কবিতার শেষের পংক্তিতে আবার কোথাও যেন নিরুদ্ধ যৌনতা ডাক দ্যায়, যেন মনে হয় এই কবিতা শেষ করার পরই শুরু হবে আসল খেলা। আগেই বলেছি, দ্বিতীয় পর্যায়ের কবিতাগুলি ক্ষণবর্ষী, মূলত প্রেম যার উপজীব্য। সেখানে অবশ্যই বিরহ আছে, আশ্লেষ আছে, আছে দেহের শিরশিরানি থেকে থিতু দাম্পত্যের দিকে যাওয়ার আটপৌরে সিঁড়ি। বাজার কবিতাটি আদ্যোপান্ত সেরকমই যেন - কিছু না কিনলেও বাজার তোমারই/ যা এখনও তোমার চোখে আছে/ আর তুমি যা হারিয়ে ফেলেছ/ দুটোকে দুই পাল্লায় ওজন করে সে। বাজার, তার নিত্যনৈমিত্তিকতার আশ্চর্য নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আগাগোড়া,এই কবিতায়। এই পর্যায়ের কবিতাগুলিতেও দৃশ্যকল্পগুলিকে খুব সতর্কভাবে পাঠ করতে হবে। নয়তো "সার্টিফিকেট" কবিতায় " সবকিছুর মাঝখানে ওই যে/ ঘাসের গায়ে এসে পড়ছে প্রথম শিশিরকণা/ বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে ফেরার পথে মুসুম্বি দর করছো তুমি" জাতীয় পঙক্তি চোখ এড়িয়ে যাবে। ঘাসের ওপরে শিশিরকণা জমার মতো আলতো জিনিসের পাশেই মুসুম্বি দর করার মতো রুক্ষ ব্যাপার কেন? নাকি রুক্ষ নয়? দুটোর মধ্যে একই আবেগময়তা লেগে আছে কি? আপনি থমকে থাকবেন। ভাববেন। এই পর্যায়ের কবিতাগুলি হলো এমনই ছোট ছোট অসমান টাঁড়জমিতে ভরা, যা আপনাকে স্বস্তি দেবেনা এক মুহূর্ত।
তৃতীয় পর্যায়ে পরপর বিস্ফোরণ! সাম্প্রদায়িকতা হোক বা ছদ্ম বামপন্থা - কলম সমান ক্ষুরধার। জানিনা দাবীটা সত্যি কিনা, তবে নেকুপুষু মানবতাবাদকে ঝেড়ে কাপড় পরানো ইদানীংকালের কোনো কবিতায় দেখেছি বলে মনে পড়ছেনা। "তোমরা কারা " কবিতায় সেই 'একদা সম্রাট ' কোন মানুষগুলো? চিনে নিতে অসুবিধা হয় কি? " তোমরা যারা কয়েকটা ঘটনা তুলে এনে / কয়েকটা চেপে রাখতে চাও / ভিয়েতনামের থেকে আলাদা করো চুকনগরকে / যারা আমার মায়ের মতো অজস্র মায়ের আত্মত্যাগ আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠিয়ে দিয়ে / নিজেরা চলে গেছো সাত, এগারো, সতেরো তলার ফ্ল্যাটে / জেনে রেখো/ মাটিতে মিশিয়ে দিলেও কঙ্কাল ফিরে আসতে পারে আবার/ কিন্ত তোমরা ফিরবেনা। আমরা এই অভিশাপধ্বনি বুক পেতে নিয়ে বুঝতে পারি - তোমরা বলতে কাদের বলা হচ্ছে। হয় / হবে, প্রতিক্রিয়া, সেই ট্র‍্যাডিশন, আগুপিছু, চৌহদ্দি - একেকটি কাব্যে কষাঘাতের পর কষাঘাত চলতে থাকে। পচে যাওয়া বিশ্বাস উন্মুক্ত হয় লাইনের পর লাইনে। সুবিধাবাদ ঠিক কোন জায়গায় - ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিশুদ্ধ ধান্দাবাজির ফাঁদ - দেখতে পাই তাও। অথচ এরই মধ্যে " গুড়ের রসগোল্লা " কবিতায় কবি কি আশ্চর্য নরম! " তারপর জমানা পাল্টায় / সফিদাও অবয়ব থেকে পালটে যান ছবিতে/ কেবল এখনও শীত এলেই আমি গণতন্ত্র বলতে / মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিম্বা মনোনয়ন পেশ করা বুঝিনা / বুঝি গুড়ের রসগোল্লা... / যা প্রতিপক্ষকে খেতে দিলে সুগার বাড়লেও বাড়তে পারে / সন্ত্রাস কমে যায়।
এই কাব্যগ্রন্থের অন্যতম সেরা পংক্তি,আমার মতে।
পাঠক - আপনি বন্ধুর অথচ অভিযাত্রিক মহিমায় ভাস্বর এই কাব্যপাঠের রাস্তা পেরিয়ে এলে পৌঁছবেন শেষ পর্যায়ে, যেখানে আগে উল্লিখিত " বেদনায় রিনরিন" কিছু কবিতা রয়েছে। সেই বেদনা কখনো ভয়ানক তিক্ত অথবা " কত কি বলছিলে আমার সম্পর্কে/ কিন্ত তোমার কুৎসা 'সা' স্পর্শ করতে পারছিল না" জাতীয় নৈবক্তিক। কিন্ত বেদনা আছে। " যব দীপ জ্বলে" কবিতায় মায়ের স্মৃতিচারণে অন্ধ শিল্পী মুচকি হেসে বলেন ঃ অন্ধের বিশ্বাস ভাঙবেননা বৌদি, অন্ধের বিশ্বাস ভাঙতে নেই " তখন শেষ লাইনে বেদনা আমাদের বলিয়ে নেয় " পৃথিবীর সব স্মৃতি শিল্প হয়ে উঠেছে, অন্ধের বিশ্বাস ভাঙতে ভাঙতে.. "। বেদনার হাত বহুমুখী। যেকোন সংবেদনশীল মানুষের অস্তিত্বে বেদনা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে। পিছনে পড়ে থাকা অথবা ধুসর হয়ে যাওয়ার কষ্ট একের পর এক কাব্যের জন্ম দেয় - এবং সেই কষ্ট পেরিয়ে গিয়ে কবি তার অস্তিত্বকে নতুন মহার্ঘতায় ফিরে পান। গ্রন্থের শেষ কবিতা " বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা" একটি দীর্ঘ খতিয়ান - বেদনাসম্ভার থেকে মুক্তো খুঁজে বের করার। কবিতাটি বস্তুত একটা লঙ শটের মতো। প্রায় পাঁচটি পাতা জুড়ে বিস্তারিত যেন একটিই দীর্ঘ স্তবক। তার ভেতরে আমরা কি পাচ্ছি? " রেখে দিয়ে সব শত্রুতা মুলতুবি / পেরিয়ে আসছে হাজারও নৌকাডুবি / হাসতে হাসতে দেখছে দুর্নিরীক্ষে / কখনও নিচ্ছে,কখনও দিচ্ছে ভিক্ষে " - একটা প্রচন্ড সুপ্ত উল্লাস, যা বেদনাকে সইতে সইতে শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসে।
" জলের ভিতর আগুনের মতো" আপনাকে ফিরে ফিরে পড়তে হবে। যেকোন সার্থক কাব্যগ্রন্থের মতোই। তার অমোঘ স্তবকগুলি থেকে প্রিজমের বিচ্ছুরণ পাবেন,যতবারই তাকাবেন। যেকোন সার্থক কাব্যগ্রন্থের মতোই। তার সাথে পাবেন মনের মধ্যে জুড়ে বসা একরাশ খচখচানি( যা অনেক সার্থক কাব্যগ্রন্থেও পাবেন না)। এই খচখচানি নতুন দিগন্তের আভাস পাওয়ার আকুতি। নতুন কথা, নতুন আরো কতভাবে বলা যেতে পারে তার হদিশ পাওয়ার জন্য অন্বেষণ। তাই আশা থাকবে দুহাজার কুড়ির রাহুলগ্নের বছরে জন্মানো এই বইটি আরো অনেক আতশবাজির প্রথম ফুলকি হয়ে ওঠে যেন।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register