Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

গল্পে সুনেত্রা সাধু

maro news
গল্পে সুনেত্রা সাধু

সুগন্ধি চা

সকালের চা বেশ জমিয়েই পান করেন মিষ্টার এন্ড মিসেস চৌধুরী। প্রথমে মর্ণিং ওয়াক আর তারপর জিমে কসরত সেরে দীপ্তমান চৌধুরী স্নানে ঢোকেন,বেরোনোর তাড়া থাকে। অপলা চৌধুরী সেই ফাঁকে সাজিয়ে ফেলেন ব্রেকফাস্ট টেবিল। নিয়ম মেনে পরিমিত আহার করেন দীপ্তমান, তবে চা হওয়া চাই মনের মতো এবং তা হতে হবে অপলার হাতে তৈরী নইলে নাকি দিনটাই খারাপ যায়। শুনে অপলা হাসে, মনের কোনে সুখ সুখ অনুভূতি হয়। উচ্চকিত প্রেম প্রদর্শনের ঘটা মানুষটার কোন কালেই ছিল না, এই সব টুকরো টুকরো কথা থেকে প্রেম শুষে নেয় অপলা। গরম জলে পরিমান মতো চা পাতা ভিজিয়ে রাখে ঘড়ি ধরে, তারপর টিপটে ছেঁকে নিয়ে বাহারি টিকোজি চাপা দেয়৷ ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে চায়ের সুবাস। চা আসে সুদূর দার্জিলিং থেকে ডাক যোগে, শ্রীনগরের চায়ের দোকানের উপর মোটেই ভরসা নেই দীপ্তমানের। অপলা মাঝে মাঝে বলে এই যখন তুমি পাহাড়ে জঙ্গলে জঙ্গীদের ধাওয়া করো, কতদিন বাড়ি ফেরো না, তখন চা এর জন্য মন খারাপ হয় না? দীপ্তমান হাসে বলে তখন যে আমি অন্য মানুষ অপলা, তখন শুধু 'জান' আর 'মান' এর বোধ থাকে, যার সবটুকু উজাড় করে দেশ মায়ের রক্ষা করি। শুনতে ভাল লাগে অপলার, গর্ব হয় স্বামীর জন্য।
অপলা গভীরভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাসী
তারা যখন কাশ্মীরে শিফট করছে তখন হাতব্যাগের ভিতর অপলার কোলে চড়ে দূর্গা, কালী, লক্ষ্মী, নারায়ণ, গণেশ, শিবলিঙ্গ আর গোপাল এসেছে। তার প্রশস্ত কোয়ার্টারের একটি ঘরে ঠাঁই হয়েছে তাদের। দীপ্তমান বেরিয়ে গেলে স্নান সেরে অপলা ঠাকুর ঘরে ফুলজল দেয়, সে মানে ঈশ্বর তাদের দুহাতে আগলে রাখে। আগে শুধু দীপ্তমানের মঙ্গল কামনা ছিল এখন তাতে জুড়েছে তিতলির নাম। তিতলি ওদের দু বছরের ছোট্ট মেয়ে। সে এখন রাবেয়ার কোলে চড়ে বাগানে ঘুরছে, বাতাসে শীত শীত ভাব আছে, রাবেয়া তিতলিকে রঙ বাহারি সোয়েটার টুপি মোজা পরিয়ে বাগানে নিয়ে গেছে। মালি আলগা হাতে গোলাপ গাছের গোড়া খুঁড়ে দিচ্ছে। গোলাপ ফুল গুলোর মাঝে একটা জ্যান্ত ফুল গুটি গুটি পায়ে হাঁটছে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে অপলা। আজ মিঠে রোদ উঠেছে তাই আজ বারান্দাতেই চায়ের আয়োজন। দীপ্তমান ইউনিফর্ম পরে এসে বসেছে, অপলা দেখছে দুচোখ ভরে, এমন সুন্দর সুপুরুষ মানুষটি শুধু তার একথা ভাবতেই শরীর জুড়ে ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ে। সুদৃশ্য কাপে অপলা ঢেলে দেয় গরম সুগন্ধি চা। এইটুকু সময় যা নিজের করে পাওয়া যায় দীপ্তমানকে, টুকটাক গল্প হয়, ছোটখাটো ঠাট্টা ইয়ার্কি, এই জীবনের রসদ। নইলে সারাদিন আর কাজটাই বা কী? তিনজন লোকের জন্য চারটি গৃহসহায়ক, অপলা বাগানে ঘোরে, গল্প বই পড়ে, গুন গুন গান গায়, তিতলির সাথে খেলা করে আর সোয়েটার বোনে। এই তো অলিভ রঙা একটা সোয়েটার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, দীপ্তমানের পিঠে ফেলে একবার মেপে নিতে হবে। চা পর্ব মেটে, দীপ্তমান উঠে পড়ে সেনাবাহিনীর ছাপ দেওয়া গাড়িতে, স্যালুট ঠোকে অধস্তনেরা, অপলা তিতলিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গেটে, গাড়িটা ক্রমশ ছোট হয়ে মিলিয়ে গেলে ঘরে ফিরে আসে। তারপর নিজের হাতে কাপ আর টিপট ধুয়ে প্রস্তুত রাখে পরদিনের জন্য।
মাম্মাম এইবার আমি খেলনা গুলো নিই? তুমি আবার কালকে খেলা কোরো কেমন? চার বছরের ছোট্ট তিতলি তার মায়ের ঘরে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট কাপ ডিস টিপট জড়ো করে ফ্রকের আঁচলে ভরে নিয়ে অপলার গালে চুমু খায়। অপলা তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে, দশ বাই বারোর ছোট্ট ঘরে মাত্র একটা জানলা, সেখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়ি পথ আর সাজানো বাগান খোঁজে সে। তিতলি কাপ ডিশ গুলো নিয়ে গেলে দার্জিলিং চায়ের সুবাস ফিকে হয়ে আসে, বার বার নাক টেনে সেই গন্ধ খোঁজে অপলা। মা এসে হাত রাখে মাথায়, বলে বেলা হল স্নান সেরে নে, দুপুরে খাবার পর ওষুধ খেতে হবে তো। মা দীপ্তমান ফিরেছে? দিনে অজস্রবার এক কথা জিজ্ঞেস করে অপলা। মা একই উত্তর দেয়, এই তো ফিরবে।
আগষ্ট মাস পড়লেই কলকাতার এফ এম রেডিও চ্যানেল গুলোতে ঘুরে ফিরে একই গান বাজে "যো শহীদ হুয়ে হ্যায় উনকি, যারা ইয়াদ রাখ্খো কুরবানি", গানটা শুরু হলেই নবটা ঘুরিয়ে রেডিওটা অফ করে দেয় অপলার বৃদ্ধ বাবা। বর্ষাকাল বৃষ্টি লেগেই থাকে, মাঝে মাঝে ঝকঝকে রোদও ওঠে কিন্তু এ বাড়ির মানুষগুলোর মনের মেঘ কাটেনা কখনো। অপলার বাবা ভাবেন এবার পুজোয় মেলা বসলে অপলার জন্য আর এক সেট খেলনা কাপ ডিশ কিনতে হবে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register