Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

গল্পকথায় মহুয়া ঘোষ

maro news
গল্পকথায় মহুয়া ঘোষ

আজীবন লকডাউন

আজ আমার আঠারো পূর্ণ হল। আমি ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক ভোটারের মর্যাদাপ্রাপ্ত হলাম। এখন থেকে আমার স্বাধীন মতামত প্রকাশ করার লাইসেন্স পেলাম। ঠাকুরঘর থেকে ঠাকুমার ঘন্টার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি ও সেই সাথে তেত্রিশকোটি দেবতার মন্ত্রোচ্চারণ। কিন্তু আমি জানি ঠাকুমার বোজা দুচোখ বেয়ে কুলকুল করে নেমে আসছে অশ্রুনদীর জলোচ্ছ্বাস। আজ যে আমার ছোটকাকার ছেলেরও জন্মদিন। অথচ ঠাকুমার সেই গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা নেই তার আরেক আদরের নাতিটিকে কাছে বসিয়ে মাথায় আশীর্ব্বাদের দূর্বা ছোঁয়াতে! কারণ,আমাদের চলছে পারিবারিক লকডাউন। সেই আমার ছোট্টবেলা থেকে। বয়স তখনো দশ পেরোয় নি.... হঠাৎ একদিন আমরা দুই ভাইবোন খেলতে খেলতে থমকে দেখলাম উঠোনে জড় করা বাবা কাকার পৈতৃক সম্পত্তি। মাঝখানে বসে আমার বাবার জ্যাঠামশাই জিনিসপত্র ভাগ করে দুদিকে রাখছেন ঠিক যেমন করে বাজারে কেউ একটা গোটা বেশী ওজনের মাছকে দুজনে ভাগ করে নেয়। মাথাটাও আধা করে, ল্যাজাটাও আধা। একদিন অবাক হয়ে মাছকাকুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, " এ রকম হাফ হাফ মাছের মাথা কেউ নেবে কেন? কারো যদি গোটা মাথাটা খেতে ইচ্ছে করে?" মাছকাকু বলেছিল, " যখন কুনো ভাগাভাগি হয় না, সে দ্যাশেরই হউক, জমিরই হউক বা কুনো জিনিসের.... হেইডা যারা ভাগ করে তাগো উপর নির্ভর করে.... যেইডা নিয়া করতাসে তার কুনো হক থাকে না মামনি। কথাডা মনে রাইখ্যো। হয়ত আইজ বুঝবা না। একদিন বুঝবা।"
আজ বুঝি.... ঠাকুমাকেও সেদিন বাটখারায় বসিয়ে ভাগ করা হয়েছিল। পহেলা বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত্য ঠাকুমা আমার। বাকি মাসগুলোর জন্য ঠাকুমা আমার ভাইয়ের। হ্যাঁ, আমার ভাইয়ের। কাজিনের নয়। খুড়তুতো ভাইয়েরও নয়। আমার ভাইয়ের। এটা আমরা দুজনই মনে মনে বিশ্বাস করি আমরা দুজন ভাইবোন। আমরা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলতে শিখি নি... উই আর কাজিনস্। এবং এটাই আমাদের রুচিবোধ, শিক্ষা ও প্রতিবাদ। আর এক বছর পরেই আমার ভাই আঠারোতে পড়বে। ঠিক আজকের দিনেই। সেইদিন আমাদের জীবনেরও লকডাউন উঠবে। আমরা প্রতীক্ষায় সেই মুহুর্তের। আমরা কেউ কারো সাথে কোনরকম যোগাযোগের চেষ্টাও কোনদিন করিনি। আমাদের ভাইবোনের সেতু হয়ে বেঁচে আছে আমার শীর্ণা বুড়িমা। ও হ্যাঁ। আমরা দুজনেই আড়ালে ঠাকুমাকে 'বুড়িমা' বলে ডাকি। রাতে দরজা বন্ধ করে জড়িয়ে কারণে অকারণে বুড়িমা বলে ডাকি। কারণ, ওই ডাকটায় আমার শৈশবের গন্ধ পাই,আমার মাটির উঠোনটার সোঁদাগন্ধ পাই যেখানে বৃষ্টির জলে কাদা মেখে আমরা সুখে গড়াগড়ি দিয়ে খেলতাম। সেই থেকে আমার জন্মদিনে আমি কেক কাটি না। কাউকে ডাকি না। ডাকব আগামী বছর ভাইকে আমার বাড়িতে। কারণ ততদিনে আমরা দুজনেই বলতে পারব... হ্যাঁ, এটাই আমার বাড়ি। আমার অধিকার। আমার গণতান্ত্রিকতা। যেটা বলার জন্য আমরা অপেক্ষা করে আছি। দীর্ঘ আট বছর। তাই সবাই যখন লকডাউন পিরিয়ডে হাঁসফাঁস করত.... আমি তখন নিঃশব্দে চিৎকার করে হাসতাম। মনে হত... উচিৎ শিক্ষা হয়েছে সবার। আজ লকডাউন উঠেই গেছে প্রায়। আমাদের লকডাউন এখনও উঠল না। আরও একটা বছরের অপেক্ষা। কেন আমরা আজীবন এই লকডাউন পিরিয়ড কাটালাম! আমাদের অপরাধ কী! জানি, কারো কাছেই এর উত্তর নেই। কিন্তু, আমার অনুরোধ.... এভাবে কোন পরিবারকে দাঁ দিয়ে কাটবেন না। ওদের শরীরের ঝরতে থাকা রক্ত আপনারা বড়রা দেখতে পান না। আমরা শিশুরা দেখতে পাই। যেদিন আমরাও বড় হয়ে যাব.... সেদিন কি আমরাও মাছের মত গাদা-পেটি, পেটি-গাদা করব আমাদের পরিবারকে!
হঠাৎ ঠাকুমার হাত মাথায়। " উইঠ্যা পড় দিদিভাই। এ কী! চোখে জল ক্যান তোমার আইজ! জন্মদিনে তো কাইন্দন লাগে না!"
তাড়াতাড়ি ডায়েরীটা বালিশের তলায় লুকিয়ে আমি বললাম, "বুড়িমা,তোমারও তো চোখে জল!"
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register