Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে সম্বুদ্ধ সান্যাল (পর্ব - ১১)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে সম্বুদ্ধ সান্যাল (পর্ব - ১১)

নারীশক্তি এবং সপ্তেন্দ্রিয়

রামমোহন রায় কর্তৃক বাঙালি সমাজসংস্কারের দরুণ সে আমল থেকেই ধীরে ধীরে আমাদের সমাজে নারীশক্তির বিকাশ হয়। পরিস্ফূটন হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সত্যেন্দ্রনাথ পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ও খানিকটা কাদম্বরী দেবীর মাধ্যমে। এই প্রসঙ্গে ইংরেজদের অবদান অনস্বীকার্য, তার সঙ্গে বিলিতি শিক্ষায় সমৃদ্ধ বাঙালি নাগরিকেরাও এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এরপর বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্র মারফৎও নারীসমাজ পুরুষদের সমতূল্য হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। বিদেশে জোয়ান অফ আর্ক, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, মেরি শেলী, আগাথা ক্রিস্টি, এমনকি হেলেন কেলার প্রমুখ এই প্রসঙ্গে নানা আলোচনায় অতীব জনপ্রিয়।
কিন্তু বাঙালি নারীশক্তির চরমতম বিকাশ ঘটে স্বাধীনোত্তর যুগে। তবে তাঁরা তেমন প্রচার না পাওয়ায় আধুনিক যুগের নারীদের কাছে প্রায় বিস্মৃত হয়ে পড়েছেন। এই প্রসঙ্গে আমার সামান্য অভিজ্ঞতা ও গবেষণায় লক্ষ্য করেছি জুকেরবার্গোত্তর যুগে বাঙালি নারীশক্তির বিকাশ অত্যধিক হারে খর্ব হয়ে পড়েছে। তার নানা রকম প্রমাণ আমি দিতে পারি, কিন্তু বিতর্কের প্রতি অনীহায় সেই প্রসঙ্গ এখানে উত্থাপন করার কোনওরকম সাহস দেখাতে চাইছি না। হাজার হোক, সমস্ত বাঙালি লেখকদের মতো আমারও খানিক সুপ্ত বাসনা আছে শীতকালীন দুপুরে বিছানায় বালিশে উপুর হয়ে কোনও রমণী আমার লেখা পড়ে ফিক করে নীরবে একটু হাসবে, তবেই যেন এই লেখক জীবন সার্থক।
আমার দেখা প্রচুর শক্তিশালী নারী আছেন, তাদের প্রত্যেকের অবতারণা এই স্বল্পস্থানে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে মা ভবতারিণীর কল্যাণে স্কুলে পড়াকালীন এমন কিছু শক্তিরূপেণ মহীয়সীদের চাক্ষুষ করেছি যে আমার মাধ্যমে তাদের সামান্য প্রচার এই মুহূর্তের সামাজিক অবস্থানের প্রতি অত্যুপযোগী। মাষ্টারমশাইদের প্রতি তাঁদের অবস্থানের কিছু নমুনা এখানে তুলে দিচ্ছি। আর গুণীজনেদের সন্মানার্থে নামগুলি পরিবর্তিত রাখছি। তবে কিছু কিছু নাম আসল থাকছে, আমি জানি উল্লেখ্য ব্যাক্তিগুলি এতে কিছু মনে করবে না।
মাতৃশক্তি শব্দটি মনে পড়লেই সবার আগে আমার সামনে ভেসে ওঠে সজলের মায়ের মুখ। আমি তাঁকে ডাকি পিসি বলে। তাঁর শাসন ও আস্কারা সজলের সঙ্গে আমার ভাগ্যেও বেশ খানিক জুটেছে। পিসির ছিল চরম বিচারবুদ্ধি। এমন বিবেচক মহিলা আমি আমার জীবনে কমই দেখেছি। একদিন কোনও এক স্যার সজলের উপর বেজায় খাপ্পা হয়ে স্কুল থেকে বেড়িয়ে সজলের বাড়িতে গেল তার সম্পর্কে নালিশ করতে। সজলের মায়ের সামনে এসে বললো, “জানেন, আপনার ছেলে আমার ব্যাগ থেকে সমস্ত বই বের করে রেলবাজারে ঠোঙার দোকানে বেচে কুলপি খেয়েছে? এমন বাঁদর ছেলে...” ইত্যাদি ইত্যাদি। সজলের মা মন দিয়ে সব অভিযোগ শুনলো। তারপরসেই মাষ্টারের উদ্দেশ্যে বলল, “তা তোর স্কুল নেই মিনসে, মরতে আমার কাছে বলতে এসেছিস?” স্যার তো হতভম্ব, “মানে, ইয়ে, আসলে আপনি তো ওর মা।” “তোরে কি ইস্কুল থেকে ছাঁটিয়ে দিয়েছে রবি?” “না, তা ছাড়াবে কেন?” “স্কুলে বেত নেই? নাকি তোর হাত নুলো?” “নুলো হবে কেন, এই তো দেখুন নড়ছে।” “গায়ে জোর নেই? বাড়িতে খাইতে দেয় না?” “দেবে না কেন? প্রতিদিন খাই।” “কে দেয়, মা না বউ?” “বিয়ে করিনি এখনও, মা-ই দেন।” “মাইনে পাস না? নাকি বাপের প্যানশনে চলে?” “মাইনে পাবো না কেন?” “সংসারডা কে চালায়? বাপে না তুই?” “আগে বাবা চালাতো, এখন আমিই চালাই।” “বাপে কি করতো?” “রেলে চাকরি।” “তয় ত প্যানশনও ভালই পায়।” “তা পায়।” “তার মানে কিপডা আছিস তোরা।” “না, কিপটে হবো কেন। কোন কিছুরই অভাব নেই বাড়িতে।” “তা এখানে এয়েছিস কেন?” এত প্রশ্নে মাস্টার রীতিমত খাপ্পা, “আপনার কাছ থেকে দয়া চাইতে আসিনি। ছেলেকে একটু সামলে রাখবেন। তাই বলতে এসেছি।” পিসি সব শুনে শেষে বললেন, “বাড়িতে পয়সার অভাব নাই, মায়ের খাবার খাচ্ছিস, জোয়ানমদ্দ ছেলে, গায়ে জোর আছে, স্কুলে অন্য মাস্টার আছে, বেতও আছে, তো সেগুলোই সজলের পিঠে ভাঙ না গিয়ে। ফের যদি নালিশ করতে এয়েছিস তো ইস্কুলের বেত তোর পিঠে ভাংবো আমি।” বলে লম্বা লম্বা পায়ে পিসি বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। পরের দিন কয়েক অবশ্য সজলকে স্কুলে দেখা যায়নি।
এ তো গেল অনুশাসন। এবার পিংকির গল্পটা মনে পড়ে গেল। পিংকির ঝলকে তখন পড়ার ব্যাচের ছেলেরা কাত। প্রতিদিন তিন চারটে প্রেমপত্র তার বাঁধা। পিংকির মা মহা চিন্তায় তার জন্য গৃহশিক্ষক নিয়োগ করলো। আমরা চোখের সামনে দেখতে পেলাম সে গৃহশিক্ষক একদিন পিংকির জন্য তার একমাত্র মনখানি নিবেদন করে ফেলেছে। নতুন বাইক কিনে মাঝে মাঝেই দেখা যায় তাদের উড়ে যেতে। পিংকির মা তখনও এই প্রসঙ্গে কিছু জানে না।
একদিন যুগলে আশ্রমে ঘুরতে গেল। আমাদের আশ্রমের পেছন দিকে একটি পুকুর আছে, তার পাশে বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ। খানিক দূরে অঞ্জনা নদী। এক সময় পুকুরের ধারে কলাবাগান ছিল। সেই আমলে কলাবাগান পেরিয়ে মাঠের পাশে আবডালে নানা যুগলকে প্রেমরত অবস্থায় দেখা যেত। সেদিনও উক্ত দুজনে কলাবাগানের ধারে বসে বিকেলের সূর্যাস্ত দেখছে পুকুরের উঁচু পাড়ে বাইকটি রেখে। হটাৎ পেছনে ধড়মড় করে বিকট এক শব্দ। পিংকির মা তার দশাসই চেহারা নিয়ে হাতে একখানা কচা গাছের ডাল ধরে সটান নেমে আসছে পার বেয়ে। তাই দেখে দুইজনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পিংকির মা নেমে এসে মাস্টারের কলার ধরে পুকুরের উপর টেনে তুললো। এরপর শুরু হলো বেধড়ক মার। এক লাথিতে বাইকটা ফেলে দিলো পুকুরের মধ্যে। অনেকক্ষণ মার চলার পর তাকেও পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পিংকিকে টানতে টানতে নিয়ে চলল বাড়িতে।
ভাগ্যিস সেদিন আমরা কিছু বন্ধু মিলে অঞ্জনা নদীর থেকে ফিরছিলাম। এমন কাণ্ড দেখে দৌড়ে এসে পুকুর থেকে মাস্টার আর তার বাইকটিকে তুললাম। কদিন বাদে জানতে পারলাম বাইক বেচে দিয়ে সেই মাস্টার নাকি পণ্ডিচেরী চলে গেছে। তার পর থেকে এখনও অবধি আর তার খোঁজ আমরা পাইনি।
আমাদের এক বন্ধুর মা স্কুলে এমন এক খেল দেখিয়েছিল যে এখনও সেই বন্ধুকে স্কুলের মাস্টাররা সমীহ করে চলে। তখন যদুবাবু পি.টি.র স্যার। শীর্ণকায়, কিন্তু অত্যধিক রাশভারী মানুষ। সর্বক্ষণ স্কুলের দিকে তার খেয়াল। একদিন সেই বন্ধু কোনও দোষ করে ফেলায় যদুস্যার তাকে স্কুলের বাথরুমে টিফিন থেকে ছুটি অবধি আটকে রাখে। খবরটি গিয়ে পৌঁছায় বন্ধুর মায়ের কানে। পরের দিন প্রেয়ারের আগে ছেলেকে নিয়ে স্কুলে হাজির। খোঁজ নিয়ে যদুবাবুর হদিস পেয়ে সোজা চলে গেলেন টিচার্স রুমে। সেখান থেকে একখানা তালাচাবি সংগ্রহ করে শীর্ণ যদুবাবুকে প্রায় তুলে নিয়ে চললেন বাথরুমে। সেখানে তাঁকে বন্দী করে, তালা মেরে, কাউকে পরোয়া না করে চাবি নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। সারা স্কুল বন্ধ সেদিন যদুবাবুকে উদ্ধার করতে। গোটা স্কুল হাজির ছিল বন্ধুর বাড়িতে। যদুবাবু ছাড়া পেয়েছিলেন ঠিক বিকেল চারটের সময়, যখন স্কুল ছুটি হয়।
তবে তারকের মা ছিল এদের থেকে অনেক আলাদা। তারক ছিল তার খুব গুণী ছেলে। প্রাইভেট টিউশনে ছেলেকে নিয়মিত পাঠাত, মাসের শেষে মাইনেও ঠিকঠাক দিয়ে দিত। উপরন্তু সকালে বিকালে নানা মাস্টারমশাইদের বাড়িতেও তাকে দৈনন্দিন কাজকর্ম করে দিয়ে আসতে পাঠাত। আমরা লক্ষ্য করে দেখতাম কোনও স্কুলটিচার নয়, শুধুমাত্র প্রাইভেট টিচারদের বাড়িতেই তারককে পাঠানো হয়। একদিন এক মাস্টারমশাই তারককে ব্যাচের মধ্যে বলে দিলেন যে সে বিনা পয়সায় যেন এর পরের মাস থেকে পড়ে তার কাছে। আর বাড়িতে আসার প্রয়োজন নেই, ফাইফরমাশ খাটারও দরকার নেই সারাদিন। কয়েকদিনের মধ্যেই প্রত্যেকটি স্যারও এই পদ্ধতি অবলম্বন করায় আমরা যারপরনাই আশ্চর্য হলাম। একদিন সুকান্ত এসে জানালো তারকের কীর্তি। এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালো যে তারকের একটি মুদ্রাদোষ ছিল পরের দ্রব্য হস্তগত করা। নানা প্রমাণেও তার মা ছেলের এই স্বভাবটির কথা কিছুতেই স্বীকার করত না। ক্রমে জানা গেল যে প্রতি মাসের প্রথমে মাস্টারদের মাইনেটি ঠিক সময়ে দিয়ে দিলেও মাসিক হিসাবে তাদের মাধ্যমে তারকদের আয়ের পরিমাণ তার তিনগুণ।
এবার একটি অন্য প্রসঙ্গের গল্প বলে লেখাটি শেষ করি। আমাদের সুরভীস্থানের পাশের পাড়া পাটুলি। সেই সময়ে সেখানে আমাদের এক বান্ধবী ববিতার বাড়ি। অঞ্জনগড়ের বিভাসদা তাকে গান শেখাতে যেত বহু বছর ধরে। গানের তালিম নিতে নিতে দুজনের প্রেমের সূত্রপাত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দুজনের প্রেম জনপ্রিয় হয়ে পড়ে বাদকুল্লায়। ববিতার বাড়ির থেকেও তাদের এই সম্পর্কে আপত্তি ছিল না বলেই আমরা জানতাম। তাই গলিতে, বনে-জঙ্গলে, নির্মিয়মান বাড়িতে, আশ্রমে, স্টেশনে – কোথাও তাদের কোনও দিন দেখা যেত না। বড় মধুর ছিল তাদের প্রেম, সভ্য প্রেমের আক্ষরিক ও আদর্শ নমুনা।
কিন্তু চমকটা ভাঙলো সেদিন, যেদিন খবর পেলাম ববিতার মা কোনও অজ্ঞাত কারণে বিভাসদার সাথে পালিয়েছে ঘর-সংসার ছেড়ে।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register