Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

গল্পকথায় সোনালি

maro news
গল্পকথায় সোনালি

গয়না যখন কথা বলে

কত গয়না মাধুরীলতার । একখান বড় বাক্স ভরে দিয়েছেন বাবা বিয়েতে । বাবামশাই কিনা জমিদার । মাধুরী নাড়েচাড়ে আর একগাল হাসে রোজ দুপুর বেলায় । শাশুড়ি বিয়ের পরে গয়না নিয়ে নিজের সিন্দুকে তুলতে যাচ্ছিলেন । পুতের বিয়েতে পাওয়া জিনিসপত্র তো বরের মায়েরই প্রাপ্য সবাই জানে । বউকে বউভাতের সাজ সাজাতে বসেছিল বরের ছোট পিসি কাকি সবাই । হঠাৎ সে ঘর থেকে সরুগলার চীৎকার শুনে মেয়েমহলের সবাই দৌড়ল সেই দিকে । বটঠাকুমা হাতে কাঁচা ছানার বারকোশ নিয়েই ছুটলেন । সন্দেশ বানাতে বসেছিলেন কয়েকজনে মিলে । সে ঘরের দিকে যেতে যেতে বরের মাকে ডাক দিলেন , “ আরে মেজবউ সাজের ঘর থেকে এমন সাংঘাতিক চীৎকার , চলো চলো , কাজের বাড়ী কার কি হল এমন ? সাপখোপ বিছাটীছা না ত ? এমন আওয়াজ কেন , বাপরে । ” নতুন শাশুড়ি শাড়িজামা গোছাচ্ছিলেন । হাতের কাপড় কাঁধে ফেলে দৌড়লেন । সে ঘরের সামনে গিয়ে ত সবাই অবাক ! দরজায় ভিড় করে মেয়েরা উঁকিঝুঁকি মারছে আর কনেবউ খুড়শাশুড়ির হাত ধরে সরু গলায় চিল চীৎকার করছে । “ আমার বাকি গয়না কই , আমার আরও গয়না আছে । আমার আরও অনেক গয়না আচে , কই সেগুলো ? আমি সব পড়ব । কেন দিচ্ছনা আমায় ? আমি সব গয়না পড়ব ।” ঠাকুমা তাজ্জব হয়ে গালে হাত দেন , “ কি গলা রে বউয়ের । বাবা যেন কান ফাটিয়ে দেবে । কি ভাগ্যি করে একটা মাত্র বেটার বউ এনেছ মেজবউমা । কি সব গয়নাটয়না বলছে , বের করে দাও বাপু । বাড়ীর কারো কানের পর্দা তো আস্ত থাকবে না নইলে ।” তারাসুন্দরী মানে মেজবউমার গা রিরি করতে থাকে । ঘরে ঢুকে এক ধমকে চুপ করিয়ে দেবেন বলে সবাইকে দরজা থেকে সরাতে যেতেই কনেবউ তাঁকে দেখতে পেয়ে আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল , “ ও মা , আমার গয়না দিচ্ছে না এরা দেখো না , আমার বাবামশাই কত সখ করে আমি পড়ব বলে দেছেন । এদের বল না এনে দিতে ।” থতমত খেয়ে তারাসুন্দরী বললেন , “ থামো থামো, অমন চেঁচাচ্ছ কেন বউমানুষ। সব গয়না একসংগে পড়া যায় কখনও ? তাই বলে এমন চেঁচাবে ? বলি বাপ মা কি শিক্ষে দিয়েছে শুনি ? ” ছোটবেলায় এই একটি চিমটি শুনলেই তারাসুন্দরীর চোখে জল এসে যেত । ও মা , বউ তো খিলখিল করে হেসে উঠল । “ কে শিক্ষে দেবে ? গয়নার বাক্স আমার কাছ থেকে সরালে আমি এমন চেঁচাই, মা পিসি মেরে পিটিয়েও থামাতে পারেনা । বাড়ীতে সবাই জানে তো । কেউ হাত দেয় না আমার গয়নায় কখনও । আজ বাবা আসবেন ত এ বাড়ীতে, দেখো সবাইকে বলে যাবেন এবার । ” এক গাল হাসি নিয়ে কনেবউ এই সব বাক্য বলতে থাকে , আর তারাসুন্দরীর বাক্য হরে যায় । “ ঠাকুর , রাধামাধব , একটামাত্র ছেলের কপালে একি বউ জোটালে ? ”
রাত্তিরে ক্লান্ত পায়ে ঘরে ঢুকে তারের কাজ করা নেকলেশটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখতে গিয়ে দুহাতের মধ্যে অঞ্জলি করে ধরে শ্রীমতী । কি সুন্দর কাজটা । আজ পার্টিতে সব্বাই এসে কমেন্ট করেছে । সুনন্দর অফিসের অ্যানুয়াল পার্টি ছিল । সব বউয়েরাই এখানে জবরদস্ত সেজে আসে । তাদের মত নতুন সংসারকরা দম্পতির রেস্ত কম । তবু সবাই সিনিয়রদের সংগে পাল্লা দিতে বিয়ের দামি গয়না বের করে এ দিনে লকার থেকে । অনেক উঁচু অফিসার মুখার্জীদার মিসেস দেখে বললেন , “ বাহ কি সুন্দর কাজ শ্রীমতী , এটা কিন্তু নেকলেশ নয় , এটা খুব বাহারের চিক । ফাঁকিবাজি দেওয়া লাল ভেলভেটের ওপর চিক আজকাল সোনা দুর্মুল্য হওয়াতে দেখা যায় । এ তো সাবেকি এন্টিক গয়না , এর কাজের আভিজাত্যই আলাদা । খুব সুন্দর । ” ব্লাশারের আভার ওপর দিয়ে আনন্দের গোলাপি ছিটে লেগেছিল শ্রীমতীর মসৃণ গালে। খুব ফুরফুরে আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে তাই । ভাল করে আবার দেখছিল ডিজাইনটা । অনেক কষ্টে এক বছর ধরে পয়সা জমিয়ে সুনন্দ কিনে দিয়েছে এই গয়নাটা এইবারের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে। অনেক দিন ধরে কোন দোকানের শোকেশে দেখে রেখেছিল নাকি । বড় ব্র্যান্ড নয় , তাও পছন্দ করে নিয়ে এসেছে এত ভাল লেগেছে বলে । গয়নাটা পাশে রেখে কানের ঝুমকো খুলতে খুলতে শ্রী ভাবে , যাক সুনন্দর কষ্ট করে কেনা সার্থক । হঠাৎ মনে হল পাশে কে কথা বলছে । “ যত্তসব হাড়হাভাতে । জালিকাজের মনিপুরী হাঁসুলির সঙ্গে চাড্ডী মেকি ঝুমকো পরেছে । ছ্যাঃ । বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা যেন ।” চমকে ওঠে শ্রী । ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকায় ? ঘুম পেয়েছে ? তাই স্বপ্ন দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ? কে কথা বলল রে ? “ কেন হে ? রোজ বিজ্ঞাপনে দেখো না ? গয়না যেখানে কথা বলে ? আমার গয়নারা আমার প্রাণ ছিল । ওদের সংগে কথা বলেই ত দিন কেটে যেত আমার । ” ড্রেসিং টেবিলের আয়নার কাঁচে রোগা কাঠিসার একটা ফর্সা মেয়ে । বাংলা করে শাড়ী পরা । গায়ে কত গয়না , বাবা ! “ দেখেছ কত গয়না ? এ তো কিছুই না । এক বড় বাক্স ভর্তি গয়না দিয়েছিলেন আমার বাবা বিয়েতে । তোমার ত কিছুই নেই । ভিখিরির দশা। নেহাত আমার একখান চিক কোন রকমে জোগাড় করে দিয়েছে বর তাই। ” রাগের চোটে ভয় পেতে ভুলে যায় শ্রীমতী । “ বটে । তা বাপ ত দিয়েছিলেন , বর কি দিয়েছিল শুনি ? ” কেমন ম্লান দেখায় মেয়েটাকে । “ সে আর কোথায় দেবে । সব সময়েই বলত , তোমার বাবা ত আর দেবার জায়গাই রাখেননি । তাও ছেলেপুলে হলে মুখ দেখে দিতাম । সে ত আর হয়নি । তা বাপু , তুমি অত লুটিয়ে শাড়ি পড়েছ কেন ? অমন কুঁচি করাই ত ঝেমেলা।” মুচকি হাসে শ্রী , “ আমি ত খাটের ওপর দাঁড়িয়ে পরি , আমার তাই অসুবিধে হয় না ।” “ গেল যা , পায়ে জড়িয়ে পড়ে গেলে কি সব্বনাশ হবে জান ? আমার সেই একবারই পেটে বাচ্চা এসেছিল । পড়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে যেতে , আর আসেনি। তোমার ত এখনো হয়নি । ধিঙ্গিপনা করতে আছে ? ” শ্রী ছুরির ধার মেশায় মিষ্টি হাসিতে , গয়নার অহংকারকে হারিয়ে দেবার গর্বে । “ কেন গো , আমার বর যে রোজ আমার কুঁচি গুঁজে দিয়ে কোলে করে নামিয়ে নেয় খাট থেকে , আমার কোন অসুবিধেই হয় না । তোমার বর তোমায় আদর করত না বুঝি অমন করে ?” একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে মিলিয়ে যায় গয়নার দেমাক , আর তাকে দেখা যায় না। আর আদরের পালিশ লেগে টেবিলের ওপর চিক ফিকফিক করে হাসে ।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register