- 31
- 0
চার
যুগ পাল্টায়। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদাও। মানুষ এখন আর শুধু গান শুনেই তৃপ্ত নয়। ছবিও দেখতে চায়। অডিও সিডির জায়গা কেড়ে নিচ্ছে ভিডিও সিডি। মোটে আটটা, দশটা কি বারোটা গানের একেকটা অ্যালবাম। নায়ক নায়িকারা সুন্দর সুন্দর লোকেশনে নাচে, অভিনয় করে আর লিপ মেলায় প্লেব্যাক সিঙ্গিং এর সঙ্গে। যেন সিনেমার গানের টুকরো। মাঝেমাঝে গায়ক গায়িকার এক ঝলক তারই মধ্যে। প্রথম দিকে এরকমই ছিল ভিডিও সিডি গুলো। শ্রীমতীও দেখত মাঝেমাঝে সন্ধে বেলায় ঘর অন্ধকার করে বিরাট টিভিতে, মদের গেলাস ঠোঁটে ছুঁইয়ে। কখনো কখনো তারও ইচ্ছে হত এরকম করে গাইতে। আবার ইচ্ছেটা চাপা পড়ে যেত আলস্য আর নেশার আড়ালে। আস্তে আস্তে বাজারে এসে গেল মিউজিক ভিডিও। গায়ক গায়িকারা আর পশ্চাৎপটে থাকতে রাজী নয়। তারাই এখন হিরো কিম্বা হিরোইন। শুধু গাইলেই হবে না। তারা এখন নিজেদেরকে খুব যত্নের সঙ্গে সাজিয়ে গুছিয়ে সিলভার স্ক্রীণ আইডলে পরিণত করতে লাগল। গানের সঙ্গে নাচের চটুলতা, দৃপ্ত, প্রায় উন্মুক্ত শরীর সব কিছুই পণ্য আজকাল। শ্রোতা দর্শকেরা পাগল তাদের জন্যে। আর এগুলো দেখতে দেখতে শ্রীমতীর ইচ্ছেটা আরো প্রবল হয়ে উঠল। সেও গাইবে এমন করে। তার গলার বিচ্যুতি যদি কিছু থাকে, টানটান এই শরীরটা পুষিয়ে দেবে সেটা। নাহ্। সে গাইবেই। এরকমই এক সন্ধ্যায়, একলা অন্ধকারে হঠাৎই শ্রীমতী অনুভব করে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি তার খুব কাছেই। ভীষণ চমকে গেছিল প্রথমটায়। কই কেউ তো নেই টিভির পর্দার আলোয় ঘোলাটে অন্ধকার এই ঘরে। তবু তার কেমন যেন মনে হচ্ছিল, কেউ আছে। গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে গেছিল। আস্তে আস্তে সয়ে গেল অনুভুতিটা। এখন নিজেই উৎসুক হয় দ্বিতীয় অস্তিত্বের জন্যে। খুঁজতে থাকে তার এই একাকিত্বের সঙ্গীকে আকুল হয়ে। অবশেষে একদিন দেখাও পায় তার। টি টেবিলের উল্টো দিকের সোফায় জমে থাকা ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মত আবছা একটা অবয়ব। প্রথম প্রথম কয়েক সেকেণ্ডের মত দেখতে পেত। ক্রমশঃ স্থায়িত্ব বাড়তে লাগল। ভয়ে হাড় হিম হয়ে যেত প্রথমে। আস্তে আস্তে কৌতুহল জয়ী হল ভয়ের ওপরে। অবয়ব এখন অনেক স্পষ্ট। তারপর একদিন কথাও বলল। : কে তুমি? কেন রোজ আসো আমার কাছে? : চিনতে পারলে না বিশ্রী? বহু দিনের পুরনো ওই বিশ্রী নামটা মুহুর্তে ভেঙ্গে খানখান করে দিল শ্রীমতীর বিস্মৃতির পাষাণ। কলেজে এই নামেই তো ডেকে রাগাতো সে। : অভীরূপ! গলাটা কেমন চিরে যায় শ্রীমতীর চীৎকার করে উঠতে গিয়ে। : চিনেছো তাহলে? মৃদু হেসে ওঠে আঁধার অবয়ব। : কেন এসেছো? কি চাও আমার কাছে? গলা কাঁপে শ্রীর। হয়ত ভয়ে। হয়ত স্মৃতির মেদুরতায়। হয়ত বা ........ : কিছু তো চাইনা। নিজের জন্যে আর কিছু দরকার পড়ে না। : তবে? প্রতিশোধ? : নাহ্। বড় বেশি আকুল হয়ে গান গাইতে চাইছিলে। আমারও তাই খুব ইচ্ছে করল। : কি? : তোমার জন্যে গান লিখতে। সুর দিতে। সেই আগের মত। : চর্চা নেই। গলা হারিয়ে গেছে অভী। : কিছু হারায় নি শ্রী। কিচ্ছু না। তুমি আবার গাইবে। আমি লিখব তোমার জন্যে। অন্ধকারটা যেন আরো একটু গাঢ় হয়ে ওঠে সোফার ওপরে। : কি করে অভী? : গানের খাতাটা নিয়ে এস শ্রী। আর পেনটা। টলমলে পায়ে উঠে গিয়ে নিয়ে আসে শ্রীমতী। : এবার পেনটা ধর খাতার ওপরে। তাই করে সে। আর কে যেন তার হাতটা ধরে লিখে যেতে থাকে। নোটেশন দেয়। একটা বরফ ঠাণ্ডা অনুভুতি শ্রীমতীর শরীরে। আর বুকের খুব তলায় অনেকটা কান্না।
পাঁচ
রাতে একা একাই ডিনার করছিল সোমেশ। শ্রীমতী ধীরে ধীরে এসে চেয়ারে বসল। নতুন ঘটনা। শ্রীমতী রাতের খাবার নিজের ঘরেই খায়। যদি আদৌ খায়। আজ হঠাৎ....... একটু থমকাল সোমেশ। : কিছু বলবে? : আমি আবার গান গাইব। চমকে ওঠে সোমেশ। মদের খেয়াল? ভাল করে দেখল শ্রীমতীর মুখের দিকে। নাহ্। মুখ চোখ পরিষ্কার। সন্ধের ঝোঁকে খেয়েছিল কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তবে এখন যথেষ্ট সোবার। : পারবে? কত দিন চর্চা নেই। আচমকা খাটলে শরীর খারাপ করবে। সোমেশ পাশ কাটাতে চেষ্টা করে। : আমি পারব। রিহ্যাবে গিয়ে থাকব ক'টা দিন। তারপর রেওয়াজ করব। ঠিক পারব। শ্রীমতী গলায় জোর দিয়ে বলে। সোমেশ একটু চুপ করে থাকে। বিরক্তও হয় খানিকটা। ফালতু ঝামেলা। অবশ্য মনের ভাব মুখে প্রকাশ করে না। : পুরনো গান গুলোই....... : না। নতুন গান। অ্যালবাম বের করব। মিউজিক ভিডিও। তুমি ব্যবস্থা কর। খাওয়ার ইচ্ছে চলে গেছিল সোমেশের। প্লেটটা একটু ঠেলে, সোজা হয়ে বসে। শ্রীমতী দেখেও কিছু বলল না। : তার জন্যে নতুন গান লেখাতে হবে। সুর দিতে হবে। : গান আছে। সুরও দেওয়া আছে। আটটা গানের একটা অ্যালবাম। : কোথায় পেলে গান? কে লিখল? কিছু না বলে, শ্রীমতী তার গানের খাতাটা এগিয়ে দেয় সোমেশের দিকে। সোমেশ ঝুঁকে পড়ে দেখতে থাকে, পাতা উল্টে উল্টে। একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যায় তার মেরুদণ্ড দিয়ে। হাতের লেখা, শব্দ চয়ন, নোটেশন, সবই তার ভীষণ ভীষণ চেনা। : কে লিখেছে? নিজের গলাটা কেমন ফ্যাঁসফেঁসে শোনায় নিজের কানে। : অভী। : অভীরূপ মারা গেছে আজ অনেক দিন হল। তুমি বলতে চাও, তার অশরীরী আত্মা এসে তোমার খাতায় গান লিখে দিয়ে গেল? তীব্র ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে সোমেশের গলায়। কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকায় শ্রীমতী। কথাটা গিলে ফেলে। : ধরে নাও, পুরনো লেখা। ছিল আমার কাছে। প্লীজ তুমি হেল্প কর। স্টেজ আমাকে ডাকে। আমি ফিরতে চাই লাইম লাইটে, পেজ থ্রীতে। তোমার কাছে ছাড়া কার কাছে যাব বল। কেউ তো নেই আমার আর। শেষের দিকে একটা আকুল হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে শ্রীমতীর গলায়। সোমেশ দেখতে থাকে শ্রীকে। কি রোগা হয়ে গেছে। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গেছে। পাতলা রাত পোশাকের আড়ালে সেই দুরন্ত ফিগার অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। মদের প্রভাবে বেলিপ্যাড, টানা টানা, ভাসা ভাসা চোখের কোলে কালি, কলি গুলো ফোলা ফোলা। জল চিকচিক করছে দু চোখে। সেই শ্রী। তার একেবারে নিজের করে পাওয়া সেই শ্রীমতী। আজ তার এই অবস্থার জন্যে সেও কি দায়ী নয় অনেকটা। বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে সোমেশের। তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে বসে শ্রীমতীর পাশে। বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে তাকে। চুমু খায়। বহু বহুদিন পরে। গাল বেয়ে গড়িয়ে আসা জলে সে চুমুর স্বাদ বড় লবণাক্ত। : তাই হবে সোনা। তুমি আবার গাইবে। স্বপ্নের প্রোজেক্ট আবার বের করবে তোমার অ্যালবাম। তোমার মিউজিক ভিডিও। কাঁদতে কাঁদতে, হাসতে হাসতে, পাগলের মত সোমেশের বুকে মুখ ঘষতে থাকে শ্রীমতী। : তুমি একটু কিছু খাও এবার। খাবার দিতে বলি তোমাকে। খানিক পরে বলে সোমেশ। কান্না ভেজা হাসি মুখ তোলে শ্রীমতী। তারপর লাজুক আঙ্গুল তুলে দেখায় সোমেশের ছেড়ে আসা প্লেটটাকে। : তোমার প্লেট থেকে খাব। সেই আগের মত। সোমেশের বুকের মধ্যে থেকে, মৃদু স্বরে বলে শ্রী। হেসে, হাত বাড়িয়ে প্লেটটা টেনে এনে শ্রীমতীকে খাইয়ে দিতে থাকে সোমেশ। : পাগলি একটা! সেই রাতে, অনেক অনেক দিন পরে, অদম্য ভালবাসায় ভেসে যায় দুজনে। এক সময় ক্লান্ত শ্রীমতী ঘুমিয়ে পড়ে সোমেশের বুকের ওপরে। স্খলিত, ঘর্মাক্ত সোমেশও শ্রীর খোলা পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে এক সময় তলিয়ে যায় ঘুমের অতলে। লক্ষ্যও করে না, ঘরের কোনের জমাট বাঁধা অন্ধকার পিণ্ডটা আস্তে আস্তে ধোঁয়ার মত বেরিয়ে গেল জানলা দিয়ে।
ছয়
অন্ধকার ঘরে প্রোজেক্টারের মৃদু কিরকির আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ ছিল না। গান গুলো শেষ হয়ে গেছিল। এডিটিং এর ছেলেরা, প্রোডাকশন ম্যানেজার, ডিস্ট্রিবিউশন ম্যানেজার, ডাইরেক্টর আর তার অ্যাসিস্ট্যান্টেরা, এরকম অনেকেই ছিল। কিন্তু কেউ কোন কথা বলছিল না। নৈঃশব্দ ভেঙ্গে সোমেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর হাতের ইঙ্গিতে আলো জ্বালতে বলে। : এ চলবে না মার্কেটে। আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোমেশ। শ্রীমতীর কোন দোষ নেই। বরং প্রাণ মন ঢেলে কাজ করেছিল। তিন মাস রিহ্যাবে ছিল। একটু একটু করে তার মদের আসক্তিকে তাড়ানো হয়। তারপর রেওয়াজ। দিনে ষোল সতেরো ঘন্টা খাটত শ্রীমতী। সেই মুক্তো ঝরা গলার অনেকটাই তুলে এনে ছিল প্রায় গানে গানে। কথা সুন্দর, সুর সুন্দর। লোকেশন দারুণ। তবু সোমেশের মত আর সকলেই বুঝে ছিল, চলবে না। কস্টিয়ুম ডিজানাররা, মেকাপম্যানরা, দারুণ চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিভিন্ন গানে, ইভনিং গাউন, ল্যাহেঙ্গা চোলি, লো স্লাং জিনস্ যাই পরুক না কেন, বারবার শ্রীমতীর অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে তার বয়েস। চড়া মেকাপে সুসজ্জিতা এক প্রায় বিগত যৌবনা, যতই ভাল গান না কেন, মিউজিক ভিডিওয় ভাল লাগছে না। এটাই যদি কোন নবাগতা সুন্দরী কম বয়েসী গায়িকা গাইত, মারমার কাটকাট করে সেল হত মার্কেটে। মিটিংয়ে উপস্থিত বাকিরাও একই মত জানালেন এবার সাহস পেয়ে। : স্যার এটাকে ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট বলে মেনে নিন। হাজার হোক, ম্যাডাম....... ইতস্তত করে বলে সোমেশের সেক্রেটারী। : অনেক গুলো টাকা ইনভল্ভড হয়ে গেছে। তাছাড়া স্বপ্নের প্রোজেক্টের সম্মানের প্রশ্নও জড়িয়ে রয়েছে। সোমেশের কথায় নড়েচড়ে বসে অনেকে। : নতুন কাউকে দিয়ে লিপ দেওয়ালে কেমন হয়। অল্প বাজেটে হয়ে যেত। এক প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট আমতা আমতা করে। সবাই যখন এগোচ্ছে, স্বপ্নের প্রোজেক্ট তখন পোছোবে? ভাবতে থাকে সোমেশ। শেষমেষ রাজী হয়। : আছে কেউ সেরকম? : হ্যাঁ স্যার। তানিয়া বলে একটা নতুন মেয়ে কাজ খুঁজছিল... তারপর সবাই মিলে আলোচনা করে স্থির হয়, লিপ নয়, কিছুটা নাচবে মেয়েটা। ভিডিও মিক্সিং করে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে অরিজিনাল গানের সঙ্গে। : অডিশন দিতে বল তোমার ওই তানিয়াকে। বলে সোমেশ। নির্দিষ্ট দিনে তানিয়াকে দেখল সোমেশ। এবং তার শরীর জ্বলে উঠল। বাইশ তেইশ বছরের মেয়েটার চাবুকের মত শরীর থেকে ফুলঝুরির মত ছিটকোচ্ছিল যৌনতা, অডিশনে পপুলার দুয়েকটা আইটেম সং করার সময়। খুব সহজেই সিলেক্ট হয়ে গেল মেয়েটা। শ্রীমতীকে কনভিন্স করতে সময় লেগেছিল। প্রথমে রাজী হয় নি। শেষে অনেক করে বোঝাতে নিমরাজী মত হল। সোমেশ কথা দিল, জান লড়িয়ে দেবে। অ্যালবামটা তো বেরোবে। তার প্রথম মিউজিক ভিডিও। তার ফিরে আসার পদক্ষেপ। এত করেও কিন্তু চললো না অ্যালবামটা। ফ্লপ করল। আর এই সেটব্যাকটা সহ্য করতে পারল না শ্রীমতী। ফের ফিরে গেল তার মদের দুনিয়ায়। একা একাই দেখত তার গান গুলো, তরল পানীয়কে সঙ্গী করে। না একা নয়। উল্টো দিকের সোফায় বসে থাকত সেই আঁধার অবয়ব।
0 Comments.