Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব - ১২)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব - ১২)

গোপনে গড়েছে কত স্বপ্নিল সাঁকো

পরদিন সত্যিই দুধ নিয়ে এল লোকটা পড়ন্ত বিকেলে। হাতে ঝকঝকে কাঁসার ঘটি। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, হে ঠাকরান! দুধ লিয়ে আইলম। ছুটি ছুটে গিয়ে মা-কে বলে - মা, ধান এসেছে। ধান দুধ নিয়ে এসেছে। মা অবাক হয়ে বললেন -ধান এসেছে মানে কি? ছুটি লাফাতে লাফাতে বলে - ঐ যে কু ঝিকঝিক কু ঝিকঝিক কু ঝিকঝিক ধান ধান.... মা হাসতে হাসতে বললেন - দুধ এনেছে? - হ্যাঁ তো। সোনার ঘটিতে করে। সত্যিই সোনার মত সেই কাঁসার ঘটি। চকচক করছে। দুধ রেখে লোকটা বারান্দায় বসে পড়ে। বলে - হে ঠাকরান, হামকে কিছু আটা দিবি? বুঢ়া হ্যয়ে গেছি। কাম নাই। ঘরের বুঢ়িটারও কাম নাইখে। কাইল আটা দিয়েছিলি রাতে সকালে খাইলম। এখন তো ফুরাই গেল। রাইতে ঘরে কুছু নাইখে। আটা দে, দুধের দাম লে কাটাই দিবি। মা আটা দিয়ে বললেন - বেকার দফায় কাম মিলে না? -নাই ঠাকরান। ওখানে ভি জোয়ান মানুষ লিবে। বুড়ার কুনো দাম নাই। -কেন কাম পেলে তো করতে পারবে। -পারব তো। বুঢ়ি হামি দুজনাই পারব। বইলে ছিলাম তো বেকার দফার সর্দারকে। কুনো কথাই নাই শোনে। হে ঠাকরান, তুই তো মা ভগবতী আছিস, হামদের দেইখে রাখিস। -আমি আর কতদূর দেখে রাখতে পারব? তোমার নামটা কি? -আইজ্ঞে শিউলাল। শিউলাল কুরমি। বেকার দফা হল চা বাগানে যারা কাজ পায় না তাদের দিয়ে অসুবিধেয় কাজ চালিয়ে দেওয়া অল্প মজুরিতে। একেবারে বেকার থেকে খানিকটা ভালো।শিউলাল কি আর ততটা বুড়ো? ওকে তো কাজে নেওয়া যেতেই পারে। এভাবে ওরা বাঁচে কী করে! ৷ শিউলাল রোজ দুধ নিয়ে আসে। দুধ খুব ভালো। একটুও জল মেশায় না। খুব মিষ্টি দুধ। মুশকিল এই যে, এই অবস্থার মধ্যেও শিউলাল খুব মদ খায়। নিভু নিভু সন্ধ্যায় সে দুধ নিয়ে আসে। সেদিন বিকেলে মা বাড়ি নেই, শিউলাল দুধ নিয়ে এলো সেই ঝকঝকে সোনার মত কাঁসার ঘটিতে। কিন্তু তার পা দুটো অল্প অল্প কাঁপছে। দুধ ঢালবার সময় হাত অল্প অল্প কাঁপছে। সারাদেহে ধেনো মদের গন্ধ। সুধাময় ব্যাপারটা দেখলেন। বললেন - হাত কাঁপছে কেন? মদ খাও? লোকটা মাথা নীচু করে ভাবছে। তারপর বলল - হঁ খাইলম। খাইলম মদ। পেটে দানাপানি নাই, পা টলছে, আর মদ খাইলম পা টলছে.. বহোত ফারাক। দুনিয়াটায় বহোত রঙ। মদ লিলে দিখা যায়... সুধাময় বললেন - কত পয়সা গেল মদে? -বেশি নাই বাবু। এই আট আনা। বাজারের পাট্টা লে আইনেছিলম বুধবার। বোতলে থোড়া রয়্যেছিল। হামি লিলাম, বুড়িটাকেও দিলাম। মাস্টরবাবু, রাগ করলি? এখন একে কিছু বুঝিয়ে লাভ নেই, ভাবলেন সুধাময়। বললে বুঝবে না। নেশা বুঝি কষ্ট ভুলিয়ে দেয়? খিদের জ্বালা ভুলিয়ে দেয়? শিউলালের দেহ থেকে মদের গন্ধ ছাড়ছে। দুধ দেওয়া শেষ, তবু বসে আছে। কিছুক্ষণ পর বলে উঠল - বাবু, কিছু পইসা দে। ফাগুয়া সামনে- "আইল রে বসন্তকাল/ দুঃখিনীর দুঃখের কপাল... "পইসা না দিস তো এই ঘটি বন্ধক রাইখ্যে টাকা লিতে হব্যেক।" সুধাময় জানেন এখন পয়সা দিলে শিউলাল আবার মদ গিলবে। ফাগুয়া মানে দোলযাত্রা মানে হোলি। এখনও দিন পনের বাকি। লেবার লাইন থেকে সন্ধ্যার পর লাঠিখেলা ও মাদলের আওয়াজ আসতে শুরু করেছে। হোলির দিনে এরা কোয়ার্টারগুলোতে এসে লাঠিখেলা দেখাবে হোলির গান গাইবে। কিন্তু শিউলাল এই বয়েসে ঠিক কী করবে? ওসবের কোনওটাই নয়। তাহলে? সুধাময় জিজ্ঞেস করলেন -তুমি ফাগুয়ায় কি করবে? লাঠি খেলতেও পারবে না। গাইতে পারো নাকি? -না বাবু। তবে রঙ কিনব। বুড়িকে রঙ মাখাব। সুধাময় হাসলেন। -হঁ বাবু বুড়ি গাইতে পারে। "আইল রে বসন্তকাল / দুখিনীর দুঃখের কপাল.. " বহোত সুন্দর গান। বুড়ি গাইবে আর হামি কানব। -তুমি কাঁদবে? -হঁ বাবু। রাধারাণীর লিগ্যে কানব। বুড়ি বলে - রাধারাণী বড় দুখী। বহোত দুখী। দুইটা পইসা দে বাবু। সুধাময় বললেন - দিতে পারি, কিন্তু তুমি আগে বলো মদ কিনবে না এই পয়সা দিয়ে। আর ঘটিটা বন্ধক দিও না। - নাই বাবু। মদ কিনব লাই। মা কসম। দুধের ঘটিটা তোদের ইখানেই থাক, পরে লিয়ে যাব। -কেন? তুমি এখন কোথায় যাবে? -রঙ লিয়ে আসি। -এত তাড়াতাড়ি রঙের দরকার পড়ল তোমার শিউলাল? এখনও অনেক দিন। দিন পনেরো বাকি আছে ফাগুয়ার। মা কসম করল বটে শিউলাল কিন্তু পয়সা নিয়েই সে উল্টোপথে হাঁটল। ওর গন্তব্য কি এখন মদের পাট্টা? সুধাময় দেখে এলেন সে লাইনের ঘরের দিকে না গিয়ে উল্টোপথে পা বাড়িয়েছে। পাশের হাটখিরা চা বাগানের বাজারে মদের পাট্টা। এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছে শিউলাল আর বেসুরে হোলির গান গাইছে। সুধাময় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ক্রমশ
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register