Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

গল্পে অজন্তাপ্রবাহিতা

maro news
গল্পে অজন্তাপ্রবাহিতা

জীবন মরণ সীমানা ছাড়ায়ে

ভূমিকা - যখন কোনো জিনিস ফুরিয়ে আসতে শুরু করে, তার কদর তত বেড়ে যায়। যেমন রান্নাঘরে হলুদ ফুরিয়ে আসছে দেখলেই মনটা ওই ফুরিয়ে যাওয়া হলুদের কৌটোতেই আটকে থাকে। সেই সময় হলুদের থেকে মূল্যবান আর কিছুই মনে হয় না। যেই মুহূর্তে কৌটো ভরে রাখি মন চিন্তা মুক্ত হয়ে অন্য কোনো সমস্যায় আটকে যায়। ছোট থেকে ছোট, বড় থেকে বৃহত্তর প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সব ব্যাপারেই মনের অবাধ আনাগোনা। সব বেঁধে রাখলেও মনকে বাঁধা যায় কেমন করে, তা কারো জানা নেই।
এই মুহূর্তে প্রতি ক্ষণে প্রাণ হারানোর ভয়ে জীবনকে আরো মূল্যবান মনে হয়। বুঝতে পেরেছি প্রতিটি নিঃশ্বাস অমূল্য।
এক সময়,কথায় কথায় রাগ করে হয়তো বলে বসতাম,"এই সব দেখার চেয়ে মরণ অনেক ভালো। " এখন এই কথা উচ্চারণ করতেও বুক কেঁপে ওঠে। চারিদিকে মৃত্যুর কোলাহল আর মৃতদেহের মিছিল। মৃত্যু যে আর সুখের নয়, ভয়াবহ। সেই কথা অনুভব করেছি। মৃত্যু এখন ক্রমবর্ধমান তালিকার একটি সংখ্যা মাত্র। পরিজনের মৃত্যুতে জীবন মৃত্যুর এই রহস্যের ধাঁধায় মুষড়ে পড়েছিলাম ভীষণ ভাবে। হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম বাঁচার আশ্রয়। বোঝার চেষ্টা করছিলাম শরীর,আত্মা ও পরমাত্মার জটিল সমীকরণ। সাধারণ মাথায় এই সব অসাধারণ যুক্তি বোঝা দায়। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পড়ে অশান্ত মনকে শান্ত করবার উপায় পেয়েছিলাম একটি বইয়ের পাতায় ,অটোবায়োগ্রাফি অফ এন যোগী। বইটি বহু পঠিত এবং বিশেষ সমাদৃত। সেখানে অনেক অদ্ভুত গল্পের মাঝে একটি গল্প ছিল,শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়কে নিয়ে।গল্পটি পড়বার পরে লাহিড়ী মহাশয়ের জীবনের প্রতি বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হই ,সবজান্তা গুগল ও ইউ টিউব ঘেঁটে একটি রোমাঞ্চকর গল্পের সন্ধান পাই, সেই গল্পটি নিজের মতো করে সহজ ভাবে বলার চেষ্টা করছি। যদিও এই চেষ্টা সূর্য্যকে আলো দেখানোর মতো অসাধ্য তাও আমি চেষ্টা করছি।
আজ আমার এই চেষ্টা স্বরূপ লেখা যোগিরাজের পাদপদ্মে অর্পণ করলাম।

শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়

ইংরেজি -১৮৬১ সাল। ভারত তখন ব্রিটিশ শাসনাধীন। দানাপুরের পাবলিক ওয়র্কস, মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং অফিস। অফিসের কেরানী বাবু একজন ভারতীয়। এক বিকেলে বেশ কয়েকটি ফাইল নিয়ে বড় বাবুর কেবিনে যান। দরজার বাইরে থেকে ভেতরে যাবার অনুমতি চেয়ে অনেকক্ষণ প্রতীক্ষার পরেও ভেতরে থেকে কোনো জবাব আসে না। নিরুপায় হয়ে কেরানী বাবু বিনা অনুমতিতেই বড়বাবুর ঘরে ঢুকে ওনার টেবিলে সব ফাইল পত্র রেখে দেন। বড়বাবু দার্শনিকের মতো জানলা দিয়ে বাইরে দেখছিলেন। কেরানী বাবুর উপস্থিতি তেমন কোনো গ্রাহ্য করলেন না। আধা ঘন্টা বাদে আবার আরো কিছু ফাইল হাতে কেরানী বাবু এসে দেখেন, বড় সাহেব একই রকম উদাস নেত্রে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন।
'স্যার '
কেরানী বাবুর সম্বোধনে বড় বাবু ফিরে তাকালেন। "আজ কাজে মন বসাতে পারছি না। আপনি ফাইল গুলো রেখে যান। আমি সময়মতো দেখে নেবো। "
বিনম্র কণ্ঠে কেরানী বাবু বড় বাবুর উদাসীনতার কারণ জিজ্ঞাসা করায় উনি উত্তর দিলেন," ইংল্যান্ড থেকে চিঠি এসেছে। আমার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ। বুঝে উঠতে পারছি না,কি করবো ? ওখানে থাকলে সেবা ও যত্ন করতে পারতাম। "

" তাই বুঝতে পারছিলাম না, কি হলো,স্যার আজ ফাইলের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না। চিন্তা করবেন না,কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসছি। "
কেরানী বাবুর কথা শুনে বড়োবাবু মৃদু হাসলেন। বুঝলেন, কেরানী বাবু ওনাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছেন। অফিসের সবাই এই কেরানী বাবুকে 'পাগলা বাবু' বলে ডাকে। সর্বদাই ইনি কেমন যেন হয়ে থাকেন, কথা বলবার সময় সর্বদা ওনার মুখে হাসি লেগে থাকে। চোখ অর্ধ নিমগ্ন। অনেকে আবার এনাকে 'আনন্দ নিমগ্ন' বাবুও বলে ডাকতেন। সর্বদাই আনন্দে নিমগ্ন থাকতেন। কোনো চিন্তাই ওনাকে গ্রাস করতে পারতো না।
কিছুক্ষণ বাদে আবার কেরানী বাবু বড়োবাবুর ঘরে এলেন। এবারে বড় বাবু একটু কঠিন সুরেই বললেন, "আমি এখন আর কোনো কাজ করতে পারবো না। ফাইলের কাজ আগামী কাল হবে। আপনি এখন আসুন।"
সাহেবের কথা শেষ হতেই কেরানী বাবু বললেন," স্যার আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আপনার স্ত্রী এখন অনেকটাই সুস্থ আছেন। উনি আজকের তারিখে আপনাকে চিঠি লিখছেন। আগামী ডাকে আপনি ওনার চিঠি পাবেন। শুধু তাই নয়, টিকিট বুকিং হলেই উনি পরের জাহাজে ভারতের জন্য রওয়ানা হবেন। "

"আপনি তো এমন ভাবে বলছেন কথা গুলো, যেন আপনি আমার স্ত্রীর সাথে দেখা করে এসেছেন। পাগলা বাবু আপনার কোথায় আমি আশ্বস্ত হলাম বটে কিন্তু নিশ্চিন্ত হলাম না। ধন্যবাদ। ঈশ্বর করেন আপনার সব কথা সত্যি হয়। এখন আপনি আপনার টেবিলে ফিরে যান। "

কেরানী বাবু বুঝতে পারলেন, সাহেব ওনার কোথায় বিশ্বাস করেন নি। সময়মতো উনি সব বুঝতে পারবেন।

এই ঘটনার ঠিক একমাস বাদে সাহেব কেরানী বাবুকে ডেকে পাঠালেন,"আপনি কি জ্যোতিষ জানেন পাগলা বাবু ? আপনার কথা একদম ঠিক। "
সব কিছু বুঝতে পেরেও অজ্ঞানতার ভান করে কেরানী বাবু বললেন,"কোন কথার ব্যাপারে বলছেন স্যার ?"
অত্যন্ত প্রসন্ন চিত্তে সাহেব বললেন," পাগলা বাবু ! আপনি আমার স্ত্রীর ব্যাপারে যা বলেছেন সব সত্যি। আমার স্ত্রী এখন সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ এবং ভারতে আসার জন্য রওয়ানা হয়েছেন। সত্যি বলতে আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। আজ স্ত্রীর পত্র পেয়ে মনটা হালকা হয়েছে। মেমসাহেব এলে আপনার সাথে অবশ্যই দেখা করাবো। "

এই ঘটনার ঠিক কুড়ি পঁচিশ দিন পরে আবার কেরানী বাবুর ডাক পড়ে সাহেবের ঘরে।

" আসুন পাগলা বাবু। ইনি আমার স্ত্রী। "
আর ইনি - কথা শেষ হবার আগেই মেমসাহেব চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন।
" ওহ মাই গড ! "
বিস্মিত সাহেব জিজ্ঞাসা করেন,কি হলো ?
মেমসাহেব কেরানী বাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, " আপনি কখন এলেন ?"
"পাগলা বাবু কখন এসেছেন ? এসব কি জিজ্ঞেস করছো ?"
কেরানী বাবু সব বুঝতে পেরে বিনা বাক্য ব্যয় করে বাইরে চলে গেলেন।
ওনার চলে যাবার পর মেমসাহেব বলে শুরু করলেন," এসব যেন জাদু। আমি যখন ইংল্যান্ডে অসুস্থ ছিলাম ,তখন এই ব্যক্তিই আমার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম,এই অপরিচিত ব্যক্তি আমার ঘরে এলেন কি করে ?কিন্তু পর মুহূর্তেই উনি আমায় উঠে বসতে সাহায্য করেন। আমিও সুস্থ অনুভব করি নিজেকে। "
"তোমার আর কোনো ভয় নেই। তুমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। শীঘ্রই সুস্থতা জানিয়ে তোমার স্বামীকে একটি চিঠি লেখো এবং কালই জাহাজ কোম্পানিতে ভারত যাবার একটি টিকিট বুক করার জন্য বলে দাও। তোমার স্বামীর কাছে যাও। নইলে তোমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে সাহেব চাকরি ছেড়ে বাড়ী ফিরে আসবেন। " এই কথা শেষ হওয়া মাত্রই উনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। উনি কে ? কোথা থেকে এসেছেন ? আমার স্বামীর সাথে কি ভাবে পরিচয় এই সব প্রশ্ন করবার কোনো সুযোগই আমি পাই নি।

মেমসাহেবের কাছে সব বৃত্তান্ত শুনে সাহেবও খুব আশ্চর্য্য হলেন।
এই পাগলা বাবুই বাংলার মহা সাধক শ্যামাচরণ লাহিড়ী।

পৌরাণিক যুগে যে সব মুনি ঋষি ছিলেন,তাঁদের অধিকাংশই গৃহস্থ ছিলেন। তাঁরা গৃহে থেকে সাধনা করে প্রতক্ষ্য অনুভূতি লাভ করেছিলেন। তাঁদেরই মতন শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ও একজন। গৃহস্থ আশ্রমে সমস্ত জীবন কাটিয়ে সাধনার দ্বারা আধ্যাত্মিক জগতের সন্ধান করেছেন।

গুরু কৃপা হী কেবলমঃ।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register